প্রতিকূলতা যে সবসময় ব্যর্থতার নামান্তর নয়, তার অনন্য উদাহরণ ফ্যাশন উদ্যোক্তা আফরোজা সুলতানা শিউলি। দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনভিত্তিক কাজের মাধ্যমে তিনি দেশিয় ফেব্রিকে প্রাকৃতিক রঙে (ন্যাচারাল ডাই) রাঙিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ফ্যাশন ব্র্যান্ড 'যারীনস ক্রিয়েশন'। ৪ জুলাই ২০২৫, তাঁর স্বপ্নের প্রথম স্টোর উদ্বোধন হলো ঢাকার গুলশানে অবস্থিত ভেনচুরা মল-এর তৃতীয় তলায়।
প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো পোশাক, দেশিয় কাপড়ের প্রতি ভালোবাসা আর স্বপ্নের পথ ধরে অবিচল এগিয়ে চলা- এই তিনে মিলে এক অসাধারণ সাফল্যের গল্পের রূপকার আফরোজা সুলতানা শিউলি। একাধারে তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা, জীবনযোদ্ধা ও পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনের প্রতিনিধি।
দীর্ঘদিন অনলাইনে নিজের উদ্যোগটি পরিচালনার পর অবশেষে অত্যন্ত প্রতীক্ষিত অফলাইন স্টোর চালু করেছেন তিনি। তাঁর এই স্বপ্নযাত্রার উদ্বোধনী আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন মাইডাস চেয়ারম্যান পারভিন মাহমুদ, এমডি খাইরুল বাশারসহ অনেক শুভানুধ্যায়ী, পরিবারের সদস্য ও ক্রেতারা।
অন্যান্য ফ্যাশন উদ্যোগের বন্ধুদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। ফিতা ও কেক কাটা আর অফুরান শুভেচ্ছায় মুখর হয়ে উঠেছিল এই আন্তরিক আয়োজনের মুহূর্তগুলো।
নতুন এই স্টোরজুড়ে সাজানো আছে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, ওড়না, পর্দা, বেডশিটসহ নানা ধরনের পোশাক, যা তৈরি হয়েছে দেশিয় ফেব্রিক ও শতভাগ প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে। তবে আফরোজা সুলতানা শিউলির এই উদ্যোগের পেছনে আছে অবিচল সংগ্রামের গল্প। সেটাই জানব আজ আমরা।
ব্যাধির ছায়ায় নয়, সাহসের আলোয় হাঁটা এক নারী শিউলি। সময়কাল ১৯৯৭; হঠাৎ থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে আফরোজা সুলতানা শিউলির। তবে এতে থেমে বা পিছিয়ে যাওয়ার পাত্রী তিনি নন। ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল কাজের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। তাই নিজের শখ পূরণ করতে সেসময় বাবার সহায়তায় ভর্তি হন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কোর্সে।
সেখান থেকেই ব্লকপ্রিন্ট, বাটিক ও প্রাকৃতিক রং নিয়ে শুরু হয় তাঁর আনুষ্ঠানিক পথচলা। তবে এরপরে সময়ের ফেরে করতে হয় তাঁকে আরো বড় এক যুদ্ধ । ২০১৫ সালে তাঁর মায়োলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম বা এক কথায় অস্থিমজ্জার ক্যানসার ধরা পড়ে। শুরু হয় কেমোথেরাপির জীবন। আর ঠিক সেই সময়ই শিউলি সিদ্ধান্ত নেন, রোগকে নয়, নিজের স্বপ্নকেই গুরুত্ব দেবেন। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেই লক্ষ্যে। সে বছরেই স্বামীর সহায়তা আর নিজের জমানো সঞ্চয় নিয়ে গড়ে তোলেন আদরের মেয়ের নামে ব্র্যান্ড 'যারীনস ক্রিয়েশন'। আর বড় ছেলের খুলে দেওয়া অনলাইনে ফেসবুক পেজ দিয়ে শুরু হয় এই সাহসী ও শক্তিময়ী নারীর নতুন যাত্রা। তবে এই সবকিছুর জন্য সবসময় যাকে তিনি পাশে পেয়েছেন তিনি হলেন তাঁর স্বামী, বলেন তিনি।
প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো স্বপ্ন
আজ যখন পোশাকশিল্পে কৃত্রিম রঙের রাজত্ব চলছে, তখন কিছু মানুষ প্রকৃতির কাছেই খুঁজে নিচ্ছেন রঙের আদি সৌন্দর্য। তাঁদের মধ্যে একজন আফরোজা সুলতানা শিউলি। তাঁর হাতে তৈরি প্রতিটি পোশাক রাঙানো হয় ন্যাচারাল ডাই, অর্থাৎ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি রঙে। পেঁয়াজের খোসা ,হরিতকী , ডালিমের খোসা, ইন্ডিগো, খয়ের-সুপারির খোসা ও গোটা সুপারি, গাঁদা ফুলের মত প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয় প্রতিটি পণ্যে। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় নরম, মোলায়েম ও বিষমুক্ত রং, যা শুধু কাপড়কেই নয় স্পর্শ করে পরিধানকারীর মনকেও। একেকটার একেক রং। দেখলে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রতিটি রঙে থাকে ভিন্নতা। আবার একই উৎস থেকে তৈরি রঙের একেক ব্যাচে একেক ধরনের আভার দেখা মেলে যা কৃত্রিম রঙে কখনো পাওয়া যায় না।
শিউলি জানান, ইকোফ্রেন্ডলি ফ্যাশনের সঙ্গে ফ্যাশন সচেতনদের পরিচয় করানো তাঁর মূল লক্ষ্য। ক্রেতাদেরকে পরিবেশবান্ধব পোশাক দিতে চান তিনি। কাপড়ে ন্যাচারাল ডাইয়ের প্রক্রিয়া আর খরচের বিষয়েও জানান তিনি। কষ্টসাধ্য হলেও পরিবেশ আর ক্রেতাদের সুবিধার কথা ভেবে পণ্যগুলো যথাসাধ্য কম মূল্যে দিচ্ছেন তিনি। এই পণ্যগুলো শিউলি নিজেই ডিজাইন করেন আর রং তৈরি করে বিভিন্ন নকশা- মোটিফ ফুটিয়ে তোলেন। সৃজনশীল এইসব কাজের ক্ষেত্রে নিরীক্ষা করতেও পছন্দ করেন তিনি। এই উদ্যোক্তার কাছে প্রতিটি কাপড় যেন একেকটি ক্যানভাস।
স্বীকৃতি এসেছে সাহসিকতার জন্য
শুধু দেশের ভেতরেই নয়, যারীনস ক্রিয়েশন–এর তৈরি পণ্যের কদর ছড়িয়ে পড়েছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ২০২৪ সালে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আফরোজা সুলতানা শিউলি পেয়েছেন ট্যালি এমএসএমই সম্মাননা। 'ওয়ান্ডারউইম্যান' বিভাগে তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর উদ্যোগে বর্তমানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেকের জন্য।
যারীন'স ক্রিয়েশন আর আফরোজা সুলতানা শিউলির এই গল্প বহু মানুষকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে, সাহস যোগাতে পারে৷ সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিজের স্বপ্নকে লক্ষ্যে পরিণত করা আর সেক্ষেত্রে সফল হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আবার তার ওপরে শিউলি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের তথা পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর ফ্যাশন পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। নতুন অফলাইন স্টোরটি সাফল্যের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল এই প্রশংসনীয় উদ্যোগটিকে, এ কথা বলাই যায়।