হাতে কাটা সুতা দিয়ে হাতে বোনা কাপড়ই আসলে খাদি কাপড়। একসময় অবিভক্ত বাংলায় তাঁতিদের হাতে তৈরি এই খাদি কাপড় ছিল জগদ্বিখ্যাত। তবে সময়ের পালাবর্তনে এখন বাজারে আসা বিদেশি কাপড়ে আমাদের ঝোঁক বেড়েছে। অন্যদিকে রঙের ক্ষেত্রেও আমরা নির্ভর করছি রাসায়নিক রঙের ওপর। এতে করে প্রাকৃতিক কাপড় আর রঙের সঙ্গে জড়িত কারুশিল্পীদের কর্মসংস্থানের পথও বন্ধ হতে চলেছে।
হাতে তৈরি খাদি কাপড় আর উদ্ভিজ্জ নীল রংকে (ইন্ডিগো) পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বর্ষীয়ান ভারতীয় শিল্পী সঙ্গীতা গুপ্তা ক্যানভাসের বদলে খাদি কাপড় আর কেমিক্যাল রঙের বদলে প্রাকৃতিক নীল রং দিয়ে করছেন পেইন্টিং। আর সেসব বিমূর্ত চিত্রকর্ম নিয়ে বিভিন্ন দেশে করছেন প্রদর্শনী। তারই ধারাবাহিকতায় গেল মাসে ঢাকায় আয়োজন করা হয় এক প্রদর্শনীর। এর পাশাপাশি তিনি চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আয়োজন করেন কর্মশালার। সেই কর্মশালায় ছাত্র–ছাত্রীদের করা কাজের সঙ্গে নিজের কাজ নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনের প্রদর্শনীর।
‘টেক্সটাইল ইন্ডিগো পেইন্টিংস অন হ্যান্ডস্পান খাদি’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার জয়নুল গ্যালারি ১–এ ১৭–১৯ আগস্ট এই তিন দিন ছিল প্রদর্শনী। সঙ্গীতা গুপ্তা ছাড়া এতে প্রদর্শিত হয়েছে ৩৮ জনের খাদি-নীল সমন্বয়ের চিত্রকর্ম। এই প্রদর্শনীর আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কারুশিল্প বিভাগ। ঢাকায় সঙ্গীতার এটি দ্বিতীয় প্রদর্শনী। এর আগে ২৮ ও ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারুশিল্প বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সঙ্গীতা গুপ্ত কর্মশালা পরিচালনা করেন ভারতীয় হাইকমিশনারের ভারত ভবনে। সেই কর্মশালায় শিক্ষার্থীদের তৈরি চিত্রকর্মগুলোই তিন দিনের এই আয়োজনে প্রদর্শিত হয়।
বাঙালির চিরপরিচিত মিথের সেই মৎস্যকন্যা, পদ্ম, টেপা পুতুল, ঘোমটা টানা বউ, নদী, মাঝি, হাতি, ফুল, পাখি, মাছ, নারী-পুরুষের মুখাবয়বসহ নানা কিছু উঠে এসেছে এই খাদি কাপড়ের ক্যানভাসগুলোয়। বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে প্রতিটি ক্যানভাসে। বয়নশিল্পীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা আসল খাদি কাপড় আর ভারত থেকে আনা নীল রং দিয়ে এই পেইন্টিংগুলোর সৃষ্টি। শিক্ষার্থীদের করা এসব পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি মূল আকর্ষণ ছিল সঙ্গীতার দীর্ঘ খাদি কাপড়ে করা নানা বিমূর্ত চিত্রকর্ম।
২০০ গজ খাদি কাপড় আর তাতে প্রাকৃতিক নীল (ইন্ডিগো) দিয়ে আঁকা চিত্রকর্ম দিয়ে দীর্ঘতম পেইন্টিংয়ের অনন্য রেকর্ড আছে সঙ্গীতার গুপ্তের। তিনি রং হিসেবে বেছে নিয়েছেন পরিবেশবান্ধব নীল রং (ইন্ডিগো), যা বহুকাল আগে আমাদের দেশেই চাষ হতো। নতুন করে আবারও হচ্ছে। নীলকে বলা হয় ব্লু গোল্ড। তিনি এই নীল রং দিয়ে খাদি কাপড়কে রঙিন করতে ব্যবহার করেন মাড রেজিস্ট পদ্ধতিতে। এই মাড রেজিস্ট ব্লক পদ্ধতিটি রাজস্থান ও গুজরাটে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ষোড়শ শতাব্দী থেকেই। এ পদ্ধতিতে মোমের বদলে মাটি ও সিমেন্টের মিশ্রণ ব্যবহার করে ব্লক করা হয়।
নিজেদের খাদি, নীল রং আর ব্লকশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতেই সঙ্গীতা গুপ্তের এই প্রচেষ্টা। তাঁর ভাষায়, ‘খাদি আর নীল রং (ইন্ডিগো), ব্লক, ন্যাচারাল ডাই—এগুলো যদি ফ্যাশনেবল করে নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে খাদির চাহিদা পুনরায় বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশীয় কাপড় রপ্তানির সুযোগ যেমন বাড়বে, তেমনি সর্বস্তরের কারুশিল্পীরাও লাভবান হবেন।’
কারুশিল্প বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ফারহানা ফেরদৌসী বলেন, ‘কর্মশালা শেষে আমরা চেয়েছি শিক্ষার্থীদের এই চিত্রকর্মগুলোকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। সেই চিন্তা থেকেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা। কারুশিল্প বিভাগের যে শিক্ষার্থীরা টেক্সটাইল ও ফ্যাশন নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের জন্য খাদির ওপর প্রাকৃতিক নীল রং দিয়ে রাঙানোর এই পদ্ধতির চর্চা ও জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেই সঙ্গীতা গুপ্তের সঙ্গে এই সমন্বয়।’
টেকসই ফ্যাশনের দিকেই এখন হাঁটছে দুনিয়া; খাদি কাপড় আর প্রাকৃতিক রং ব্যবহারের মাধ্যমে ফ্যাশনকে টেকসই করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। খাদিতে নিজের পেইন্টিং নিয়ে শিক্ষার্থীরাও বেশ উদ্দীপ্ত। প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করেই প্রাকৃতিক সামগ্রী ব্যবহার করে ফ্যাশনের এই অনন্য ধারা রপ্ত করছেন তাঁরা।
ছবি: কানিজ ফাতেমা