'দ্য ফিউচার ইজ হ্যান্ডমেইড'। সাস্টেনেবল ফ্যাশনের স্বপ্নদ্রষ্টাদের মুখে ও মননে ঘুরতে থাকা এই কথাটি আসলে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে হাজারে-বিজারে সাস্টেনেবল লেবেল লাগানো ফ্যাশনপণ্যের ভীড়ে। রিসাইকল করা, পুরোনো পোশাক কেটে বা জোড়াতালি দিয়ে নতুন পোশাক ও অনুষঙ্গ বানানোই সাস্টেনেবল ফ্যাশনের শেষ কথা নয়। সাস্টেনেবল ফ্যাশনে হাতে বানানো পোশাক আর ন্যাচারাল ফেব্রিক ব্যবহার করার মাধ্যমে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর আছে আলাদা গুরুত্ব। আর্কা ফ্যাশন উইকে প্রদর্শিত দেশের তরুণ ডিজাইনার তানহা শেখের ফ্যাশন লেবেল তান এর ছোট কিন্তু নজরকাড়া কালেকশনটি এ কারণে উল্লেখযোগ্য।
প্রতিটি কালেকশন আর সেই সঙ্গে আলাদা করে পোশাকগুলোর ডিজাইনের পেছনে থাকে কিছু অনুপ্রেরণা৷ তান-এর কর্ণধার ও ডিজাইনার তানহা জানালেন, প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিতে ভালোবাসেন তিনি। আর এবারের কসমিক কালেকশনের ইন্সপিরেশন এসেছে মহাকাশ থেকে। এই কালেকশনের অ্যাপ্রিকট অরেঞ্জ, ডিপ ব্ল্যাক, কসমিক ব্লু আর স্পেস ব্লুসহ দূর অন্তরীক্ষের নানা রঙে সাজানো হয়েছে কালেকশনটি। মহাকাশের নানা ছবিতে আমরা এরকম কালার প্যালেটই দেখতে পাই।
ডিজাইনার নিজেই জানালেন, এখানে দেশের প্রথিতযশা প্রয়াত শিল্পী কালিদাস কর্মকারের বিমূর্ত চিত্রশিল্প থেকে এই পোশাকগুলোর অ্যাবস্ট্রাক্ট ডিজাইনের অনুপ্রেরণা নিয়েছেন তিনি। এই আগলভাঙা চিত্রশিল্পীর কাজেই আমাদের দেশে প্রথম আধুনিক বিমূর্ত চিত্রের দেখা পেয়েছি আমরা।
এছাড়াও তানহা বলেন, জাপানি ওয়াবিসাবি ফিলোসফিতে ইম্পারফেকশনকে ধারণ ও উদযাপন করার যে জীবনদর্শন আছে, সেটির সঙ্গেও মিলে যায় এই কালেকশনের মূলমন্ত্রটি। এই তরুণ ডিজাইনের বয়ানে, মানুষ ও মহাজাগতিক বিশ্বের যে চিরন্তন সম্পর্ক আছে কাল থেকে কালান্তরে, সেই জায়গা থেকেই কাজ করেছেন তিনি।
এই সংগ্রহটির নাম দিয়েছেন তানহা অ্যাস্ট্রেয়া। এই অ্যাস্ট্রেয়া আসলে পবিত্রতা ও ভারসাম্যের গ্রীক দেবী, যিনি মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সংযোগের প্রতীক। মিথোলজি অনুযায়ী, পৃথিবী ও মহাকাশের মাঝে যে যোগসূত্র আছে, এই দেবীর মহাজাগতিক সত্তার মাঝে তা নিহিত আছে। আর সেই অনুপ্রেরণা থেকেই প্রাকৃতিক টেক্সচার, ফ্লুইড লাইন আর জৈব প্যাটার্নের মাধ্যমে এই মিলনের উদযাপন দেখা যায় ডিজাইনে৷
তানহার ডিজাইনে সবসময় ফেব্রিক ম্যানিপুলেশনের সিগনেচার স্টাইল দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি। একদিকে যেমন স্ট্রাকচার্ড ডিজাইন করা হয়েছে, তেমনি প্রথমবারের মতো ফেব্রিক অরিগ্যামির সৃজনশীল এমবেলিশমেন্ট আছে এই সংগ্রহের পোশাকে। এখানে টেক্সচার্ড এফেক্ট আনতে রুশিং টেকনিক ব্যবহার করেছেন তানহা বেশ মুশিয়ানার সঙ্গে। এখানকার সমস্ত মোটিফ এই সুক্ষ্ম রুশিংয়ের মাধ্যমে হাতে ছোট ছোট ভাজ করে, ফেব্রিক গ্যাদার করে তৈরি করা।
কাট আর প্যাটার্নেও থিমের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন ডিজাইনার তানহা। অ্যাবস্ট্রাক্ট ঘরানার সঙ্গে মিল রেখে অ্যাসিমেট্রিক হেমলাইন ও সিলুয়েট, ফ্লুইড লাইন আর লেয়ার্ড টেক্সচার ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। আর যে জিনিসটি সবচেয়ে বড়, তা হলো এই অত্যন্ত আধুনিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত ডিজাইন ডিটেইলসগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছেন দেশি ফেব্রিক দিয়ে।
তানহা বললেন, বলাকা সিল্ক, অরগাঞ্জা সিল্ক, হাফ সিল্ক ইত্যাদি ফেব্রিক ব্যবহার করেছেন তিনি এখানে। আর দেখা যাচ্ছে, মোলায়েম ও ফ্লোউই সিল্ক আর ব্রিদেবল, শিয়ার ফেব্রিক অরগাঞ্জা দিয়ে তিনি এখানে ক্রপ স্টাইল আর স্ট্রেট কাট পোশাকেও টেক্সচার, স্ট্রাকচার, ভলিউম আনতে পেরেছেন। তানহা বললেন, মডার্ন আর্টের অনুপ্রেরণায় আধুনিক, এজি আর বোল্ড পোশাকের নিরীক্ষাধর্মী কালেকশন করতে চেয়েছেন তিনি এখানে। আর ফ্যাশনপ্রেমীরা তান এর পোশাকের এই বিশেষত্বগুলোরই অনুরাগী।
শো স্টপারের পোশাক নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে শোয়ের পর থেকে। কিন্তু ড্রেসের ডিজাইন ডিটেইলস নিয়ে আসলে কথা হচ্ছে না। 'জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও মডেল রুনা খানের চেয়ে পারফেক্ট আর কেউ হতে পারে না এই ড্রেসের জন্য', বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আর জোর দিয়ে বললেন তানহা।
স্পেস ব্লু বলাকা সিল্ক আর কালো অরগাঞ্জা দিয়ে তৈরি এই করসেট ড্রেসে ব্যবহার করা হয়েছে পিকাবু ব্রালেট ডিজাইন। হিপের এক্সেঞ্চুয়েটেড ডিজাইন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডিওরের আইকনিক বার জ্যাকেট থেকে অনুপ্রাণিত। করসেটের ধারনাটি হচ্ছে ব্যাকে সংযুক্ত স্ট্রিং দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ আঁটসাঁট করে বেঁধে রাখা। এই ড্রেসেও কালো ফেব্রিকের রুশিং করা এমবেলিশমেন্ট দেখা গিয়েছে যেগুলো কালিদাস কর্মকারের ছবির অনুপ্রেরণায় ডিজাইন করা। শো স্টপারের এই নজরকাড়া ড্রেসটি ছাড়াও তান এর এবারের কালেকশনে দেখা গিয়েছে স্কার্ট ও টপের অনসম্বল, প্যান্টস্যুট, জ্যাকেট আর ক্রপটপ।
তবে তানহার বয়ানে এই কালেকশনটি ইমপারফেকশনের ফিলোসফি থেকে সাজানো হলেও হাই ফ্যাশন ও কতুর আর্টিস্ট্রির নিরিখে আরো কিছুটা রিফাইন্ড হতে পারত এটি। হাতে বানানো ৭০০ থেকে ৮০০ ফেব্রিক অরিগ্যামি পিস দিয়ে বা রুশিং পদ্ধতিতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে একেকটি এমবেলিশমেন্ট ফেব্রিকে ফুটিয়ে তোলা কোনো সহজ কাজ নয়। তবুও আমরা পারফেক্টভাবে ইমপারফেক্ট হতে চাই। কতুর আর্ট্রিস্ট্রির এক বড় অংশ হচ্ছে কাস্টোমাইজড বা মেড টু মেজার পোশাক। অসংখ্য ফিটিং আর ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একজন ডিজাইনারকে এখানে। সেদিক থেকে ফিটিংয়ের ক্ষেত্রে আরো একটু পারফেকশন আশা করে রানওয়ের ফ্যাশনপ্রেমীরা। তবে যারা ডিজাইন নিয়ে কাজ করেন বা ফ্যাশন বোদ্ধারা অবশ্যই জানেন যে সে জায়গায় কতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় আর সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী। আমাদের সকলের বডি টাইপ বা শারীরিক গড়ন আলাদা। আর এই ইনক্লুসিভ ফ্যাশন ও বডি পজিটিভিটির জোয়ারের সময়ে এসে এসব আলোচনা খুব সংকীর্ণতার পরিচায়ক; বিশেষ করে ফ্যাশন এক্সপার্টদের কাছ থেকে।
তানহা আগেই বলেছেন, এই কালেকশনের মূল ধারনাটি এসেছে ইম্পারফেকশনের দর্শন থেকে। তাই দেশি ফেব্রিকে, দেশি চিত্রশিল্পীর অনুপ্রেরণায় হাতে করা ডিজাইনের মনোমুগ্ধকর রূপায়নের দিকে বরঞ্চ নজর দিই আমরা এখানে। তবে তান এর এবারের সংগ্রহ নিয়ে যে একটি অনুযোগ অবশ্যই করা যায় তা হলো এর কলেবর। এই অল্প কয়টি পোশাকে আসলে পুরো কনসেপ্ট তুলে ধরা বেশ কঠিন। মনে হচ্ছিল যেন হঠাৎই শেষ হয়ে গেল শো। এত দারুণ একটি কনসেপ্টে এখানে আরো বড় পরিসরে কালেকশনটি সাজালে মন ভরত আসলে। সব মিলিয়ে তান এর অ্যাস্ট্রিয়া কালেকশন মুগ্ধ করেছে, নজর কেড়েছে আর দিয়েছে স্রোতের বিপরীতে নতুন পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা।