ইতালির সবচেয়ে বনেদী ও বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাদার সাম্প্রতিক একটি জুতার কালেকশন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে তোলপাড়। মিলান ফ্যাশন শোয়ে প্রদর্শিত তাদের ব্র্যান্ডের একটি স্যান্ডেল দেখতে ছিল হুবহু ভারতের ঐতিহ্যবাহী কোলাপুরি চপ্পলের মতো। ইটালির বনেদী ব্র্যান্ড প্রাদা প্রথমে সেটিকে বাজারজাত করেছে 'ইটালিয়ান লেদার' ও 'আর্টিসানাল ফিনিশ' যুক্ত পণ্য বলে এবং কোনো উৎস নির্দেশ বা কারিগরের স্বীকৃতি না দিয়েই। আর দাম রাখা হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা, যা সাধারণ কোলাপুরি স্যান্ডেলের প্রকৃত মূল্যের প্রায় ৩৫ গুণ।
এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ভারতের হস্তশিল্পী, ফ্যাশন সমালোচক থেকে শুরু করে সংস্কৃতি গবেষকেরা। তবে অবশেষে প্রাদাও ব্যাপারটি নিয়ে মুখ খুলেছে। ব্র্যান্ডটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারতের ঐতিহ্যবাহী কোলাপুরি স্যান্ডেল থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই তৈরি করা হয়েছে মিলান ফ্যাশন শোতে প্রদর্শিত তাদের সেই জুতা। তবে ভারতের হস্তশিল্পী ও ফ্যাশন সমালোচকদের মতে, এটি শুধু অনুপ্রেরণা নয়, বরং একপ্রকার চুরির শামিল।
কোলাপুরি চপ্পল ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের কোলাপুর অঞ্চলের এক ধরনের হস্তশিল্প। ২০১৯ সালে এটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) ট্যাগ অর্জন করে। স্থানীয় কারিগরেরা প্রাকৃতিক উপায়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এটি তৈরি করেন। একটি স্যান্ডেল তৈরিতে প্রায় আটজন কারিগরের দুই দিন সময় লাগে।
একজোড়া কোলাপুরি স্যান্ডেল ভারতে সাধারণত ১,২০০ থেকে ১,৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়।মূল্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোলাপুরি একজোড়া স্যান্ডেল তৈরির প্রকৃত খরচ পড়ে প্রায় ৯০০ টাকা, যেখানে প্রাদার একই স্টাইলে বানানো স্যান্ডেলের উৎপাদন খরচ অনুমান করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩,৫০০ টাকা। তবুও প্রাদা সেটি বিক্রি করছে প্রায় ৫৫,০০০ টাকায়। আর একজন কোলাপুরি কারিগর প্রতিমাসে ২০ জোড়া চপ্পল তৈরি করে আয় করেন প্রায় ১২,০০০ টাকা। এর বিপরীতে একটি বিলাসবহুল ব্র্যান্ড একজোড়া জুতা বিক্রি করেই অর্জন করছে ৫০,০০০ টাকার বেশি মুনাফা। মুনাফার এই বিপুল পার্থক্য থেকেই তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
দীর্ঘদিন ধরেই বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী 'কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন'-এর অভিযোগ উঠছে। অর্থাৎ, কোনো সংস্কৃতির ঐতিহ্য বা নকশা নিয়ে তা ব্যাখ্যা না করে বা উৎসের স্বীকৃতি না দিয়ে তা নিজেদের নামে চালিয়ে দেওয়া। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রাদার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছে। তারা বলছে তাদের এই জুতা 'ইন্ডিয়ান ট্র্যাভেল থেকে অনুপ্রাণিত', কিন্তু তাতেও কারিগর বা ঐতিহ্যের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত পদক্ষেপ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন অনুযায়ী, কোনো ভৌগোলিক উৎসবিহীন পণ্যকে ঐ অঞ্চলের ঐতিহ্য বলে দাবি করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও এখন পর্যন্ত প্রাদার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তবে সচেতন গ্রাহক ও গবেষকরা বিষয়টি সামনে এনেছেন। ফ্যাশনবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলেন, লোগো আর আলোয় মোড়ানো ফ্যাশন শো দিয়ে শ্রম ও ঐতিহ্যের চিহ্ন মুছে ফেলা যায় না। এর নাম অনুপ্রেরণা নয়, প্রতারণা। এই পরিস্থিতিতে জিআই ট্যাগযুক্ত পণ্যের প্রতি জনসচেতনতা বাড়ানো, স্থানীয় কারিগরের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর ওপর ন্যায্য চাপ প্রয়োগের তাগিদ দিয়েছেন সংস্কৃতি বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলো যদি সত্যিই ঐতিহ্যকে সম্মান করতে চায়, তবে স্থানীয় কারিগরদের সঙ্গে কাজ করা, স্বীকৃতি দেওয়া এবং ন্যায্য ভাগাভাগি করাই হলো একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
ছবি: ইন্সটাগ্রাম