ফ্যাশন বিশ্বে কাঁঠালের জয়জয়কার
শেয়ার করুন
ফলো করুন

হাল ফ্যাশন ডেস্ক

সারা বিশ্বে পরিবেশবান্ধব ফ্যাশন ব্র্যান্ড অনেক রয়েছে। সবার একটাই উদ্দেশ্য, পরিবেশের ক্ষতি না করে ভালো মানের স্টাইলিশ ও টেকসই ফ্যাশন সামগ্রী সরবরাহ করা। দ্য ইকেএনও একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলেও আদর্শগত দিক থেকে অন্য পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ড থেকে কিছুটা আলাদা। আমরা মোটামুটি সবাই জানি, ফ্যাশনশিল্প পরিবেশ দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। অনৈতিক সাপ্লাই চেইন প্রথা ও ফ্যাশন সামগ্রী তৈরির জন্য তুলনামূলক অনুন্নত দেশের শ্রমিকদের শোষণের জন্যও এই শিল্পের ভালোই দুর্নাম আছে।

রোকাইয়ার ডিজাইনে তৈরি ভিগান জুতা
রোকাইয়ার ডিজাইনে তৈরি ভিগান জুতা
ছবি: ইকেএন

দ্য ইকেএন কাজ করে সেই সব অনুন্নত দেশের মেধাবী ও প্রতিভাবান ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে, যাঁরা ফ্যাশন শিল্পের শোষণের স্বীকার। বাংলাদেশের ফ্যাশন ডিজাইনারদের নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর তারা কোলাবরেশনের জন্য বেছে নেন ডিজাইনার রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণাকে। তাঁকে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

পূর্ণা সব সময় নিজের কাজের মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁতে বোনা সুতি, খাদি ও পাট দিয়ে তৈরি কাপড় নিয়ে কাজ করেছেন। এ ছাড়া পোশাকের মোটিফে তিনি ফুটিয়ে তোলেন আমাদের অতি প্রিয় মিনা ও ঐতিহ্যবাহী গাজীর পট। তাঁর এই কালেকশনগুলো ইতিমধ্যে বিশ্ব ফ্যাশনে বেশ সমাদৃত হয়েছে। গতানুগতিক ফ্যাশন ধারার বাইরে কাজ করা পূর্ণা স্নিকারে নিজের দেশকে সবার কাছে একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই এই স্নিকারের অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিয়েছেন জাতীয় ফল কাঁঠালকে।

নিজের ডিজাইন করা জুতা হাতে রোকাইয়া
নিজের ডিজাইন করা জুতা হাতে রোকাইয়া
ছবি: ইকেএন

স্নিকারে চারটি রং ব্যবহার করা হয়েছে—হলুদ, সবুজ, বাদামি ও ধূসর। শুধু লেসের রং সাদা। হলুদ পাকা কাঁঠাল, সবুজ এই গাছের পাতা এবং বাদামি ও ধূসরের প্যাটার্ন কাঁঠাল গাছের ছালকে নির্দেশ করে। স্নিকারের মেটাল ডুব্রের ওপর বাংলা অক্ষরে লেখা ‘কাঁঠাল’। স্নিকারটি পর্তুগালের দক্ষ কারিগরেরা সম্পূর্ণ হাতে তৈরি করেছেন। তাই এর সোলে লেখা আছে ডিজাইন ইন বাংলাদেশ (বাংলা ও ইংরেজি অক্ষরে) এবং মেইড ইন পর্তুগাল।

বিজ্ঞাপন

জেন্ডার নিউট্রাল বা লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভিগান স্নিকার বানাতে ব্যবহার হয়েছে পুনর্ব্যবহৃত সিনথেটিক লেদার ও নিওপ্রিন ফেব্রিক। এর লাইনিং দেওয়া হয়েছে নিওপ্রিন ও মেশ ফেব্রিকে। এতে আরও আছে ইভিএ (ইথিলিন-ভিনাইল অ্যাসিটেট) সোল। এই সোল সাধারণ রাবার সোলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আরামদায়ক।

কাঁঠালের প্রেরণায় ভিগান চামড়ায় রোকাইয়ার ডিজাইন করা জুতা
কাঁঠালের প্রেরণায় ভিগান চামড়ায় রোকাইয়ার ডিজাইন করা জুতা
ছবি: ইকেএন

এই স্নিকার নিয়ে কথা হয় পূর্ণার সঙ্গে। তিনি জানান যে, দ্য ইকেএন টিম প্রায় তিন বছর আগে ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাঁর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। প্রথমে পুরো ব্যাপারটা তাঁর কাছে সত্যি মনে হয়নি। কোন প্রতারকের চক্করে পড়েছেন কি না, এটা নিশ্চিত হতে তিনি তাদের সঙ্গে একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করেন। নিজের সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হয়ে এই ‘কাঁঠাল’ প্রজেক্টের কাজ শুরু করেন। প্রায় তিন বছর লেগেছে এই স্নিকার ডিজাইন ও ডেভেলপ করতে। পূর্ণা ভিগান লেদার নিয়ে এই প্রথমবার কাজ করলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। ভিগান লেদার জিনিসটা আমার কাছে একদমই নতুন ছিল। ফলে ভেবেছিলাম পোশাকের বাইরে গিয়ে এই লেদার দিয়ে কিছু করাটা আমার জন্য হবে নতুন অভিজ্ঞতা। এই চিন্তা থেকেই কাজটা শুরু করি। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে ভিগান লেদার নিয়ে দেশেই কাজ করার ইচ্ছা আছে।’

এর আগে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করা পূর্ণা এই স্নিকার ডিজাইনের মাধ্যমে পশ্চিমা ফ্যাশন বিশ্বে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। একজন বাংলাদেশি ডিজাইনার ও জার্মানির নামকরা পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ড দ্য ইকেএনের কোলাবরেশনের খবর বেশ কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। কিছুদিন আগে ফোর্বস ম্যাগাজিনে পূর্ণার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি নিজের কাজের পাশাপাশি শহর ঢাকাকে নিয়ে আলোচনা করেন।

পর্তুগালের কারখানায় তৈরি হচ্ছে জুতা
পর্তুগালের কারখানায় তৈরি হচ্ছে জুতা
ছবি: ইকেএন

ছোটবেলা থেকেই পূর্ণার ছবি আঁকা ও পোশাক বানানোর শখ। সেই শখই ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্নে রূপান্তরিত হয়। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তিনি যোগ দেন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে। প্রথম সেমিস্টার পার হতে না হতেই ডাক আসে সেই সময় বিপিএলে অংশগ্রহণকারী অন্যতম জনপ্রিয় দল রংপুর রাইডার্সের টিভিসি শুটের কস্টিউম ডিজাইনের জন্য। সেটা ২০১৫ সাল। এই থেকেই শুরু। সেই যাত্রা এখনো চলছে। যাত্রাপথে ঝুলিতে জমেছে বেশ কিছু পুরস্কারও। অংশগ্রহণ করেছেন ফ্যাশনের অনেক আন্তর্জাতিক ইভেন্টে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৭ সালে উহান ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন উইক, ২০১৮ আইডি ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন উইক, ২০১৯ সালে রাশিয়ায় মার্সিডিজ-বেঞ্জ ফ্যাশন উইক ইত্যাদি। এ ছাড়া তাঁর পোশাক প্রদর্শিত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের ওটাগো মিউজিয়ামে। তিনি ২০১৮ সালে আইডি ইন্টারন্যাশনাল এমারজিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। দেশে আরএপি (নিজের নামের আদ্যক্ষর) নামের একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে দেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড় ও কারুশিল্প ব্যবহার করে তৈরি করছেন ট্রেন্ডি পোশাক।

এর পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজেও রয়েছে তাঁর উপস্থিতি। তাঁর ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তিনি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রান্তিক কারুশিল্পীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন।

স্নিকার ডিজাইনের মধ্য দিয়ে পূর্ণা ও বাংলাদেশের নাম আরও ভালোভাবে ছড়িয়ে গেল ফ্যাশন দুনিয়ায়। বেশ প্রশংসিত হচ্ছে তাঁর সৃজনকর্ম।

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯: ৪৪
বিজ্ঞাপন