খাদি: দ্য ফিউচার ফেব্রিক শো: বাংলাদেশের ডিজাইনারদের সৃষ্টিতে প্রকৃতি ও জীবনের সৌন্দর্য
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বিজিএমইএর সঙ্গে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেটি জানা গেল বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসানের বক্তব্যে। সে জন্যই বোধহয় এবারের এই ফ্যাশন শোর প্রথম দিন শুরু হয় বিইউএফটির শিক্ষার্থীদের উপস্থাপনায়। দুটি কিউ ছিল তাঁদের।

জাকিয়া আর মাইশার কালেকশন
জাকিয়া আর মাইশার কালেকশন
আবীর ও তাজবীরের সংগ্রহ
আবীর ও তাজবীরের সংগ্রহ

প্রথম কিউতে পোশাক উপস্থাপন করেন জাকিয়া ও মাইশা। এরপর আবীর ও তাজবীরের পোশাক সংগ্রহ উপস্থাপিত হয়। প্রথম জুটি চেষ্টা করেছেন খাদির নিজস্ব রংকে অবিকল রেখে কাট ও প্যাট্যার্নে খেলতে। অন্যদিকে খাদিকে নানা রঙে মাত্রাময় করে নান্দনিক করে তুলেছেন পরের জুটি। হালকা রঙের প্যালেট চোখের আরাম দেয়। এর মাঝে একটু বৈচিত্র্য আনতে সামান্য গাঢ় রঙের ছোঁয়া চমৎকারিত্বের দাবি রাখে। এরাও যে প্যাটার্ন আর কাটের নিরীক্ষা করেননি, তা কিন্তু নয়। তবে একটা বিষয় বলতেই হয়, বাংলাদেশকে মেড ইন বাংলাদেশ তথা উৎপাদক দেশ থেকে ডিজাইন ইন বাংলাদেশ হয়ে উঠতে হলে এসব মেধাবীর প্রয়োজন যথাযথ মেন্টর।

বিজ্ঞাপন

এই পর্বের পরে ছিল এফডিসিবির সদস্যদের সঙ্গে দুজন ভারতীয় ডিজাইনারের উপস্থাপনা। সূচনা করেন ফায়জা আহমেদ। তাঁর পোশাক ছিল মূলত প্রতিবাদের। ইসরাইলের নির্দয় নিষ্পেষণে বিধ্বস্ত গাজার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেই তাঁর প্রয়াস। তাঁর কাপড় ক্যানভাসে বিম্বিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব, আর্তি আর নিষ্ফল প্রতিরোধ। তাঁর ডিজাইন ছিল একেবারেই মিনিমাল। পরিমিতির সৌন্দর্য প্রতিটি পরতে। খাদির টেকশ্চারকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জমিন সামান্যই অলংকৃত হয়েছে। সেখানেও রয়েছে বিশেষ এক ভাবনার প্রতিফলন। বিধ্বস্ত ও হাজারো আহত ফিলিস্তিনির প্রতিচ্ছবিই যেন তিনি প্রতীয়মান করেছেন প্রিন্ট মেশিনে প্রেস করে। তবে তাঁর এই নিরীক্ষাপ্রয়াস একেবারে শিল্পীর অবস্থান থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে। এই সংগ্রহের রিপ্রোডাকশন হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দুটি কিউয়ের মধে৵ চমক ছিল চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরীর উপস্থিতি। তিনি হেঁটেছেন। তাঁর পাঞ্জাবির পিঠে লেখা ছিল ইংরেজি ‘পিস’ শব্দটি। এই অবাণিজ্যিক মনোভাবে ফুটে ওঠে শিল্পীর সচেতন সৃজন অভিব্যক্তি। প্রতীয়মান হয় অসহায় মানুষের প্রতি সংহতি। কোন সন্দেহ নেই, তাঁর একক উপস্থাপনা আত্মবালা ২.০–এরপর এটা ছিল আরেকটি চমক।

কাপড় ক্যানভাসে বিম্বিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব, আর্তি আর নিষ্ফল প্রতিরোধ
কাপড় ক্যানভাসে বিম্বিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব, আর্তি আর নিষ্ফল প্রতিরোধ
 পরিমিতির সৌন্দর্য প্রতিটি পরতে, খাদির টেকশ্চারকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
পরিমিতির সৌন্দর্য প্রতিটি পরতে, খাদির টেকশ্চারকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

হেরিটেজ টেক্সটাইলকে ধরে রেখে কীভাবে সেটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা যায়, তারই উদাহরণ ইবা মালাই। মেঘালয়ের ফ্যাশন ডিজাইনার। তাঁর লেবেল কিনিহো। গেলবারও তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। এবারও এলেন সেই সিগনেচার সংগ্রহ নিয়ে। অতিরঞ্জনহীন পোশাক। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন। হালকা রংয়ের নরম উদ্ভাস চোখের আরাম দেয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশী ফ্যাশন ডিজাইনার আফসানা ফেরদৌসীকে এখানে পাওয়া গেল নতুন করে। তিনি যেন বেরিয়েছেন খোলস ছেড়ে। খাদির আবেগময় বয়নই তাঁর এবারের প্রতিপাদ্য। তাই কোনো রং নিয়ে খেলা না করে খাদির জমিনের সৌন্দর্যকেই নানাভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সেই প্রয়াসে ফুটে উঠেছে মানুষের নানা অভিব্যক্তি আর আবেগ। রাগ, আনন্দ, বেদনা এমন কি ঋতুকালীন বিষণ্নতাও এই সংগ্রহের সেলাইয়ের পরতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি।

টেপা পুতুলের থিমে মুখোশ
টেপা পুতুলের থিমে মুখোশ
শো স্টপার অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম
শো স্টপার অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম

কাপড়ের প্যাটার্ন নিয়ে নিরীক্ষা চোখে পড়েছে। সুচিকর্মের ব্যবহারও উল্লেখের দাবি রাখে। সঙ্গে জুতাসহ অন্যান্য অনুষঙ্গ ছিল দৃষ্টিনন্দন। সবই হাতে তৈরি। সেখানে দেখা গেছে, কাঁকড়া কিংবা মাছের উপস্থিতি, মোটিফ হিসেবে। তাঁর সংগ্রহের বিশেষ দিক ছিল সমতার সৌন্দর্যকে তুলে ধরা। এ জন্যই তাঁর মডেলরা হেঁটেছেন মুখোশ পরে। এই মুখোশগুলো ছিল টেপাপুতুলের মাথার আকারে করা। বিভেদহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি দেশের কারুশিল্পকে শ্রদ্ধা জানানোর এই প্রয়াস প্রশংসনীয়। কারণ, মৃৎশিল্পের এই ধারাও বিলুপ্তির শঙ্কায় আছে। শেষে চমক ছিল শো স্টপার হিসেবে অভিনেত্রী মমর উপস্থিতি।

নাটকীয়তায় শুরু হয়েছে হাসান ইমামের উপস্থাপনা। মৃদু আলোয় মডেল এসেছেন, মুখ ঢেকে পায়চারি করেছেন। তারপর দেখিয়ছেন তাঁর চেহারা। এরপর হেঁটেছেন। তাঁর অনুসরণ করে সতীর্থরাও পা মিলিয়েছেন।

নাটকীয়তায় শুরু হয়েছে হাসান ইমামের উপস্থাপনা
নাটকীয়তায় শুরু হয়েছে হাসান ইমামের উপস্থাপনা
সব মিলিয়ে তাঁর সংগ্রহ যেন প্রকৃতিরই আখ্যান
সব মিলিয়ে তাঁর সংগ্রহ যেন প্রকৃতিরই আখ্যান

মাটির একটা সৌন্দর্য আছে। মেটে ঘরানার শেডগুলোতে আছে প্রকৃতির নান্দনিকতা। সেই চেতনাই মূলত প্রতিভাত হয়েছে ইমামের সৃষ্টিকর্মে। তাঁর এবারের সংগ্রহ বরাবরের মতোই খুবই চটকহীন আর অনাবিল সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা, প্রাকৃতিক রঙের মাধুর্যই তাঁর পোশাককে আলাদা মাত্রা দেয়। এই সংগ্রহেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এবার বরং তিনি জীবনচক্রের রহস্যকে উন্মোচন করেছেন খাদি প্রাকৃতিজ বৈশিষ্ট্যের আত্তীকরণে। খাদি আমাদের ঐতিহ্যের শিকড়ের পরিচায়ক। আমাদের সভ্যতার প্রতিরূপ। হাতে কাটা সুতায় হাতে বোনা এই কাপড়ে কারুশিল্পী তথা বয়নশিল্পের সৌকর্য প্রতিফলিত হয়ে থাকে। আর সেই আদি সৌন্দর্য অমলিন রেখে দৃষ্টিসুখের কারণ হয়, এমন সব রং তিনি ব্যবহার করেছেন। এই সংগ্রহের পোশাকে দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে সার্থকভাবে। এখানে সবুজের নানা শেড আসলে আমাদের প্রকৃতিরই প্রতিরূপ। সব মিলিয়ে তাঁর সংগ্রহ যেন এই প্রকৃতিরই আখ্যান। যা শুনতে হলে কান পেতে থাকতে হয়। অনুভব করতে হয়। আর পরম আবেগে তাকে ভালোবাসতে হয়। ইমাম হাসান সেই আবেগ আর ভালোবাসার মিশেলে নিদারুণ যত্নে প্রকৃতিকে ধরেছেন তাঁর কাপড় ক্যানভাসে।

নতুনদের তালিকায় নবীনতর অবশ্যই সাদিয়া রশিদ চৌধুরী। এটা তাঁর সম্ভবত দ্বিতীয় শো। তবে বড় আসরে প্রথম অবশ্যই। তিনি আকর্ষণীয় রং নিয়ে কাজ করেছেন। খাদির জমিনের বৈশিষ্ট্যকে রঙের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

তাঁর প্যালেটে বৈচিত্র্য অবশ্যই ছিল। কাট আর প্যাটার্ন নিয়েই তিনি খেলেছেন। ফলে পোশাক হয়েছে আকর্ষণীয় আর বৈচিত্রময়। সাদিয়া আরও প্রশংসার্হ্য হবেন নানা ধরনের পোশাক তাঁর সংগ্রহে রাখার জন্য।

সন্ধ্যার পর্দা নামে ভারতীয় ডিজাইনার অভিষেক চৌধুরীর উপস্থাপনায়। শুরুতে ছিল শান্তিনিকেতনের একটি তথ্যচিত্র দিয়ে। এরপর শুরু হয় ক্যাটওয়াক। নানা ধরনের পোশাক ছিল তাঁর সংগ্রহে।

পর্দা নামে ভারতীয় ডিজাইনার অভিষেক চৌধুরীর উপস্থাপনায়
পর্দা নামে ভারতীয় ডিজাইনার অভিষেক চৌধুরীর উপস্থাপনায়
নানা রঙের মধ্যে কালোর উপস্থিতি নজর কাড়ে
নানা রঙের মধ্যে কালোর উপস্থিতি নজর কাড়ে

নানা রঙের মধ্যে কালোর উপস্থিতি নজর কাড়ে। বর্ণের বিন্যাসের সঙ্গে সুচিকর্মের মেলবন্ধন অনবদ্য। তিনিও চেষ্টা করেছেন সংস্কৃতির, ধারা মিশেল ঘটাতে। সেটি স্পষ্ট হয় পোশাকের গাঁথুনিতে।

সবশেষে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলতে হয় কোরিওগ্রাফির কথা। নান্দনিক উপস্থাপনায় ফ্যাশন ডিরেক্টর আজরা মাহমুদের কোরিওগ্রাফির প্রশংসা করতেই হবে। প্রতিটি কিউতে তাঁর অভিজ্ঞ ও সৃজনশীল পরিবেশনার ছাপ দেখা গেছে। পোশাকের সংগ্রহের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী নাটকীয়তা আর পরিমিতিবোধের সঠিক সমন্বয় করেছেন আজরা পুরো শোতে।


তেজগাঁ লিংক রোডের আলোকি বর্তমানে ঢাকার হ্যাপেনিং প্লেসে সেটি আবারও চাক্ষুষ করা গেল খাদি: ফিউচার ফেব্রিক ফেস্টিভ্যালে গিয়ে। বেশ সরগরম চারপাশ। সকালে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়। নিচের মূল হলে চলছে প্রদর্শনী। বাইরে খোলা আকাশের নিচে করা হয়েছে শো। মাঘের হাড়কাঁপানো শীতে সেটি কিছু দর্শকের জন্য একটু কষ্টকরই বটে। তবু আগ্রহের কমতি লক্ষ্য করা যায়নি প্রথম দিন।
সারা দিন নানা আয়োজন ছিলই। বড় হলে হচ্ছে প্রদর্শনী। নানা পণ্যের সমাহার সেখানে। দর্শকেরা আগ্রহভরেই দেখছেন। কিনছেন। কারুশিল্পীরা পাচ্ছেন উৎসাহ।
শোয়ের শুরুতে বক্তব্য রাখেন বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী ও বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান ও এফডিসিবির প্রেসিডেন্ট মাহিন খান।

ছবি: শেখ সাইফুর রহমান

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ১৭: ৫৮
বিজ্ঞাপন