ফ্যাশন–জগতে একজন ফ্যাশন নির্দেশককে ক্যামেরার পেছনের শিল্পী বলা চলে। মঞ্চের পেছনে অনবরত তাঁদের কারিগরি দেখান তাঁরা। দৃশ্যপট তৈরি করেন। গৌতম সাহা এমনই একজন শিল্পী। তিনি দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে জড়িয়ে আছেন ফ্যাশন–জগতের সঙ্গে।
ময়মনসিংহে জন্ম ও বেড়ে ওঠা গৌতম সাহার। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। মামার বদৌলতে বাড়িতে ছিল ফ্যাশন ম্যাগাজিনের আনাগোনা। ‘সানন্দা’, ‘আনন্দলোক’ ও ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের পুরোনো কপির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আগ্রহ জন্মে ফ্যাশনের প্রতি। তবে কখনো ভাবেননি এ পেশায় আসবেন। গৌতমের ভাষ্যে, তিনি ফ্যাশন নির্দেশনাকে পেশা হিসেবে বাছেননি, বরং পেশাটিই তাঁকে নিজের জন্য বেছে নিয়েছে। তবে ফ্যাশন ও ফটোগ্রাফির প্রতি ভালোবাসাটা তাঁর বরাবরই ছিল। ‘আনন্দলোক’ ম্যাগাজিনে জগদীশ মালির তোলা ছবি মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। ছবির ফ্রেম ও লাইটিংয়ের প্রতি কৌতূহল কাজ করত। এটিই তাঁর প্রথম অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
শুরুটা মূলত হয় ২০০২ সালে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘আইস টুডে’তে। তবে ফ্যাশন ডিরেক্টর হিসেবে নয়, নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রশাসনিক নির্বাহী হিসেবে। এখানে কাজ করতে করতেই ছবির প্রতি আগ্রহ আরও গভীর হয়। কাজ করেছেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনেও। সেখানকার পরিবেশ, নান্দনিকতা, সৃজনশীল ব্যক্তিদের সঙ্গ গৌতমের ফ্যাশন নির্দেশক হয়ে ওঠার পেছনে বড় চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সহকর্মীদের প্রচুর সহযোগিতাও পেয়েছেন এ কাজে।
ফ্যাশন নির্দেশক হিসেবে গৌতম তাঁর মেধা, সৃজনশক্তি ও পরিশ্রমের মাধ্যমে বেশ নাম করেছেন। শুধু বাংলাদেশের ফ্যাশন–জগতে নয়, কাজ করেছেন ওপার বাংলাতেও।
সুমন মুখার্জির পরিচালনায় ‘শেষের কবিতা’ সিনেমার ফ্যাশন কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। সিনেমাটি ১৯৩০ সালের প্রেক্ষাপটে বানানো। তাই প্রতিটি চরিত্রের পোশাক, অনুষঙ্গ ও স্টাইল মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। এমনও হয়েছে, সারা দিন কলকাতা শহরের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চরিত্রের অনুপ্রেরণার রসদ জোগাড় করেছেন। পুরো অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য ছিল বেশ অন্য রকম। এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে এখনো বেশ ফারাক আছে বলে মনে করেন গৌতম। তাঁর অভিমত, ‘এ দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এখনো তৈরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন কাজের সুযোগ বাড়ছে। তবে ওপার বাংলার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি আমাদের চেয়ে এই একটি ব্যাপারে বেশ এগিয়ে। ওদের কাজের সুযোগ এ দেশের চেয়ে বেশি, সেই সঙ্গে ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহী মানুষের সংখ্যাও। আমাদের দেশের মানুষ এখনো এই ব্যাপারে শিখছে, জানছে। তাই এ জায়গায় পৌঁছাতে আমাদের আরও সময়ের প্রয়োজন।’
একটি ফ্যাশন শো বা ফ্যাশন ফটোশুটে ব্যবস্থাপনার সময় ক্যামেরার পেছনে একজন নীরব কারিগর হিসেবে গৌতম কাজ করেন বটে, তবে তাঁর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মূল বিবেচনার বিষয় থাকে যে পোশাকগুলোর প্রদর্শনী হবে, তার ধরন। কোন প্রেক্ষাপটে পোশাকগুলো বেশি মানাবে, তা একজন ফ্যাশন নির্দেশকের মূল ভাবনাগুলোর একটি। প্রতিটি শোয়ের থিম অনুসারে সব মিলিয়ে কাজ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন তিনি। তবে যিনি পোশাকটি পরছেন এবং একই সঙ্গে, যাঁদের জন্য ছবিটি তোলা হচ্ছে, বরাবরই তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্য ও পছন্দ গৌতমের প্রাধান্য।
আজ অবধি অসংখ্য ফ্যাশন শো এবং ফটোশুটে কোরিওগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের ও সফল কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো জনপ্রিয় অভিনেত্রী দিলারা জামানের দাপুটে ফটোশুট। এই ফটোশুটটিতে এভারগ্রিন এই অভিনেত্রী সব্যসাচী মুখার্জির মডেলের আদলে হাজির হন। বার্ধক্য লুকাননি মোটেও। চেহারার ভাঁজ ও কাঁচা–পাকা চুলে করা এই সাহসী ফটোশুট সবাই বেশ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন। ফটোশুটটি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও বেশ প্রশংসিত হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে দক্ষ করে তুলেছেন গৌতম সাহা। কুড়িয়েছেন প্রশংসা। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন তিনি। তবে সেই সঙ্গে মনে করেন, দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এখনো যথেষ্ট বিস্তৃতি পায়নি। এ জন্য বড় কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং নির্ভয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা থাকাটা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
গৌতম আমেরিকায় যান প্রায় এক দশক আগে। ২০১৫ সালে। বর্তমানে সেখানেই আছেন। আগে ভিনদেশের বিভিন্ন শহরে কাজ করলেও এত বড় পরিসরে ফ্যাশন শোতে ডেনিস বাসোর মতো বড় মাপের ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে কাজ করতে পারার সুযোগ পেয়েছেন এই প্রথম। এটি তাঁর অভিজ্ঞতার তালিকায় নতুন মাত্রা যোগ করে। এ ছাড়া তিনি নিউইয়র্কের ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ফ্যাশন বিভাগে গেস্ট ক্রিটিক হিসেবে একাধিকবার আমন্ত্রিত হয়েছেন।
বরাবর পর্দার আড়ালেই কাজ করেছেন গৌতম সাহা। সামনে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। সম্প্রতি ঢাকায় তাঁকে সেরা ফ্যাশন ডিরেক্টর হিসেবে জভিরোজ বাংলাদেশ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০২৩ সম্মাননা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি সেখানে। নিউইয়র্কেও সমসাময়িক সৃজনশীল কাজের জন্য এটিভি ইউএসএ কর্তৃক পেয়েছেন ‘আইকনিক স্টার অ্যান্ড ফ্যাশন’ পুরস্কার এবং সেই সঙ্গে অ্যাবাউট দ্য টাইম ইভেন্ট সেরা ফ্যাশন ডিরেক্টর হিসেবে মনোনীত হন তিনি।
এ ছাড়া বছর দুয়েক আগে দারাজের উদ্যোগে ‘আইস টুডে’ ম্যাগাজিনকে সেরা ম্যাগাজিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গৌতমের করা কাজের ভিত্তিতে এই সম্মাননা পায় ম্যাগাজিনটি।
কর্মজীবনের শুরুতে স্বেচ্ছায় ফ্যাশন নির্দেশনাকে বেছে না নিলেও এখন এই কাজ করতে পেরে আনন্দিত গৌতম সাহা। সৃজনশীল ভাবনা, মানুষের সহযোগিতা ও ভালোবাসা ফ্যাশন–জগতে তাঁর চলার পথের পাথেয়।
ছবি: গৌতম সাহার সৌজন্যে