জিআই সনদ মিরপুরের বয়নশিল্পীদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

এপ্রিলের শেষদিনে মিরপুরের কাতান শাড়িসহ ২৪টি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হয়। এই সনদ হস্তান্তরের পর সংশ্লিষ্ট পণ্যের উৎপাদন এলাকায় উৎপাদকেরা তো বটেই সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও উচ্ছ্বাস লক্ষ করা যায়।

তাঁত আছে কারিগর নেই
তাঁত আছে কারিগর নেই

এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল মিরপুরের বেনারসিপল্লি। তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো ভাবান্তর দেখা যায়নি। কারণ, সেখানকার বয়নশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্তত ৯৯ শতাংশ মানুষই জানেন না ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) কী। এতে কী লাভ হয়। এমনকি জিআইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহে তাঁদের বলতে গেলে কোনো ভূমিকাই ছিল না। দিন কয়েক আগে সরেজমিনে ঘুরে তাঁদের মধ্যে বরাবরের মতো হাতাশা লক্ষ করা গেছে। একাধিক কারাখানায় গিয়ে যা দৃষ্টিগোচর হয়েছে তাতে তাঁদের হতাশ না হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। সব কারখানাতেই বেশির ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে আছে। ঝুল জমেছে। অনেকে তাঁত খুলে বিক্রি করে দিয়েছেন। কোথাও একটা বা দুটো তাঁত হয়তো চলছে।

বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছিল ফুটপাতে বসে একজন জ্যাকার্ড মাস্টারকে কাজ করতে দেখা। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। কয়েক মাস আগেও তাঁকে দোকানে বসে কাজ করতে দেখেছি। অথচ ভাড়া দিতে না পারায় মালিক অ্যাডভান্সের টাকা কেটে নিয়েছেন। অন্যের দয়ায় একটা দোকানের সামনে বসে তিনি এখন কাজ করেন। যিনি তাঁকে বসতে দিয়েছেন তিনি একজন কার্ড পাঞ্চের শিল্পী। তিনিও কাজ না পেয়ে এখন শিঙাড়া বিক্রি করছেন।

দোকান হারিয়ে ফুটপাতে কাজ করছেন জ্যাকার্ড মাস্টার (বাঁয়ে)। আর কার্ড পাঞ্চের কাজ নেই, তাই তেলেভাজা বিক্রি করছেন
দোকান হারিয়ে ফুটপাতে কাজ করছেন জ্যাকার্ড মাস্টার (বাঁয়ে)। আর কার্ড পাঞ্চের কাজ নেই, তাই তেলেভাজা বিক্রি করছেন

পুরস্কার পাওয়া বয়নশিল্পী মো. রফিক আক্ষেপ করে বলেন, ‘আর তো কিছু শিখিনি, তাই এ ছাড়া উপায়ই বা কী।’ এখনো তাঁত বুনছেন এমন বয়নশিল্পীদেরও একই বক্তব্য। বর্ষীয়ানরা ধুঁকছেন। আবদুর রশিদ খান তো বলেই ফেললেন, ‘এই যে জিআইয়ের কথা বললেন এতে আমাদের কি কোনো উপকার হবে? এখন তো কোনোমতে দিন গুজরান হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

বরিষ্ঠ বয়নশিল্পীদের ছেলেরা কেউ ভ্যান চালান, কেউ সবজি বিক্রি করেন। কেউ তাঁতে বসতে চান না। কারণ, মজুরিতে পোষায় না।

এই বয়নশিল্পী জানেনই না জিআই কি
এই বয়নশিল্পী জানেনই না জিআই কি

করোনার আগেও এখানে অনেক তাঁত ছিল। করোনার সময় পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় প্রচুর তাঁত বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় অনেকেই অনন্যোপায় হয়ে মিরপুরের করবস্থানে গোরগোদকের কাজ নেন। অথচ সেই সময়ে এসব বয়নশিল্পী কোনো সহায়তা পাননি। বাংলাদেশে তাঁত বোর্ড থেকে বিভিন্ন এলাকার অনেক বয়নশিল্পীকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের তথ্য দেওয়া হলেও আসল বয়নশিল্পীরা সেই সাহায্য পাননি। স্থানীয় বয়নশিল্পী এবং তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পূবর্তন সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা ও তাঁদের প্রিয়ভাজনেরা এই সহায়তা পেয়েছেন, যাঁদের কেউই বলতে গেলে বয়নশিল্পী নন।

অন্যদিকে এই সমীকরণ মেলানো কঠিন—মিরপুরে তাঁত যত কমছে, সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দোকানের সংখ্যা। তাহলে কী বিক্রি হয় এসব দোকানে? খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সব দোকানেই দেদার বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের ভারতীয় শাড়ি। দেশি কাপড় তুলনায় কম। এর মধ্যে আবার আছে মেশিনে সিন্থেটিক সুতায় বোনা কাপড়ও। এসব শাড়ির কতটা সোজা পথে আসে, সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই জানেন।

নকশার জন্য কার্ড পাঞ্চ করা হচ্ছে
নকশার জন্য কার্ড পাঞ্চ করা হচ্ছে

আবার মিরপুরে তৈরি কাপড়কে ভারতীয় বলেও বিক্রি করা হয়। এই ট্র্যাডিশন নতুন নয়, এ ক্ষেত্রে বরং আমাদের দেশি ক্রেতাদের হীনম্মন্যতার অন্যতর চিত্র ফুটে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিরপুরের বয়নশিল্পীরা খাঁটি রেশমের সুতায় কাপড় যেমন বুনে থাকেন তেমনি কৃত্রিম সুতায়ও বোনেন পেটের দায়ে, বাধ্য হয়ে। তবে বেশির ভাগ বয়নশিল্পীর মধ্যে বর্তমানে চরম অনীহা দেখা যাচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের বোনা শাড়ি নিয়ে মহাজনেরা সঠিক দাম তো দেনই না, বরং শাড়ি রেখে আসতে হয়। আর সেই টাকার জন্য ঘুরতে হয় দিনের পর দিন।

গত দশকেও মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বরের রাস্তার ধারে প্রতিদিন অসংখ্য টানা দিতে দেখা যেত। অথচ এখন কোথায় যে টানা দেওয়া হয় তা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। একসময়ের সরগরম এই বয়ন–জনপদ বিরান হলেও, একটি বয়নশিল্পী গোষ্ঠীর নিঃশেষ হলেও কারও কোনো তৎপরতা এত বছরেও লক্ষ করা যায় না। নব্বই–পরবর্তী সময়ে ভাষানটেকে তাঁদের পুনর্বাসনের প্রকল্প নেওয়া হয়। সে সময় প্লট বরাদ্দের জন্য ১ হাজার ৮৬৬ জন বয়নশিল্পীর কাছ থেকে জামানত হিসেবে ১০ হাজার করে টাকাও নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে ৯০৬ জনকে ৩ শতাংশের প্লট দেওয়ার কথা ছিল। অথচ এত বছরেও এর কোনো সুরাহা হয়নি।

দুই দিন আগে তাঁত বোর্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন বিভাগের প্রধান মো. আইয়ুব আলীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি জানান, বয়নশিল্পীদের পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তাঁত বোর্ড প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি সেখানে তাঁত ভবনও তৈরি হবে। আশা করা যায় দ্রুত এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। কারণ, মিরপুরের কাতান শাড়ির জিআই প্রাপ্তি এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করছে।
বাঙালি আসলে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করতে হয় জানে না, না হয় করে না। ভারতীয় পরিচালক সঞ্জয়লীলা বানসালির ‘দেবদাস’ ছায়াছবিতে মাধুরী দীক্ষিত ও ঐশ্বরিয়া রাই যে শাড়ি পরেছিলেন, সে দুটো শাড়িই এই মিরপুরে বোনা ও কাজ করা। এ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি না।

এ প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য, ঢাকা তো বটেই, পুরো বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংখ্য বিয়ে হয়। এসব বিয়েতে মেয়েদের এখনো প্রথম পছন্দ বেনারসি শাড়ি। অথচ বিরাট এই বাজারটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই শিল্পের এমন দুর্দশা কেন হবে, কেন বিলুপ্তপ্রায় শিল্পে পরিণত হবে? হাতে গোনা দু–একটি ব্র্যান্ড আর ডিজাইনার বাদে মিরপুরের শাড়ি নিয়ে কাউকে কাজ করতে দেখা যায়নি। সবাই মেতে আছে জামদানিতে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে সচতেনতা সৃষ্টি ও জিআইয়ের সুফল সম্পর্কে সবাইকে অবগত করার জরুরি। একই সঙ্গে জিআই জার্নালকে আরও তথ্যসমৃদ্ধ, নির্ভুল ও অন্তত দ্বিভাষিক করা আবশ্যক বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

ছবি: হাল ফ্যাশন

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন