'আপনারা প্রবীণ। চশমা বাগিয়ে পালাটার ভিতর থেকে একটা গূঢ় অর্থ খুঁটিয়ে বের করবার চেষ্টা করবেন। আমার নিবেদন, যেটা গূঢ় তাকে প্রকাশ্য করলেই তার স্বার্থকতা চলে যায়। হৃৎপিন্ডটা পাঁজরের আড়াল থেকেই কাজ করে। তাকে বের করে তার কার্যপ্রণালী তদারক করতে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে'। … রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এখানে যে পালার কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক 'রক্তকরবী'। ১০০ বছর পেরিয়ে গেল প্রথমে 'যক্ষপুরী' ও পরবর্তীতে 'নন্দিনী' নামে লেখা এই নাটকটির। আর সে নাটকের একটি শোয়ের প্রাক্কালে এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে এভাবেই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এর অভিভাষণে, যা রক্তকরবীর মুদ্রিত বিভিন্ন সংস্করণে সংযুক্ত করা হয়েছে পরে।
একবার ভেবে দেখুন, রক্তকরবী সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে থাকলে রবীন্দ্রনাথ এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করেছেন সমাজের মূলধারার কূপমন্ডুকদের কাছ থেকে!তাই এর প্রধান দুটি চরিত্র নন্দিনী আর রঞ্জনকে এই একশ বছরের তিনটি ভিন্ন সময়কালে কল্পনা ও রিক্রিয়েট করার সময় আমরাও পিছপা হইনি নিরীক্ষা করতে। নতুন করে ভাবতে।
রক্তকরবীর 'যক্ষপুরী' যেন ভীষণ চেনা চেনা লাগে আমাদের। মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে একটি সরলরৈখিক নগর গড়ার পরিকল্পনা চলছে। ভবিষ্যৎকামী নকশায় নির্মিত হবে এই নগর। স্থাপত্য, প্রযুক্তি আর নানাবিধ সুবিধায় এ নগর উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা। এ নগর নিয়ে আবিশ্বের কৌতূহল কম নয়। আমারও যে নেহায়েত নেই তাও অস্বীকার করব না। বরং একটুআধটু খবরাখবর যা মেলে তাতে আমি এই নগরের সঙ্গে কেন যেন রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর পাতালপুরীর মিল খুঁজে পাই। কে জানে এখানেও হয়ত কোন নন্দিনী আর রঞ্জনের দেখা পাবে ভবিষ্যতের বিশ্ববাসী। আর আমরা যেখানে বসবাস করি, যক্ষপুরীর সঙ্গে সে জায়গারও বিভিন্ন অস্বস্তিকর মিল পাওয়া যাবে একটু চোখ মেলে চাইলেই। আমাদের মাঝেও তাই নন্দিনী আছে। রঞ্জনও হয়তো আসবে।
এই জুটির কথা যখন এল তখন না হয় রক্তকরবীতেই ফিরে যাওয়া যাক। এই নাটকটি যে রূপক সেটা আর নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বরং ১০০ বছর আগে অন্তত দশবার ঘষামাজা করে, একাধিক নামে প্রকাশের পর চূড়ান্তভাবে রক্তকরবী নামাঙ্কনের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই নাটক ও এর কুশিলবদের প্রতীকী অস্তিত্ত্বকে আরও স্পষ্ট করেছেন। প্রসঙ্গক্রমেই প্রতীয়মান, ভুবনায়নের বাস্তবতায় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নৈতিকতাহীনতার প্রেক্ষাপটে এই নাটক ভয়ানক সমকালীন। এই আলোচনায় সেসবের বিস্তার আমাদের অভিপ্রায় না হলেও কিছু বিষয়কে উপেক্ষারও জো নেই।
এখানে দুটি চরিত্রই, যাপনের নিরিখে আমাদের এই আয়োজনের মধ্যমণি। নাটকের মতোই বলা যেতে পারে। প্রথম দৃশ্য থেকে যবনিকা পতন অবধি উপস্থিত নন্দিনী। অন্যদিকে কেবল শেষ দৃশ্যে নিথর ও রক্তস্নাত রঞ্জন দৃষ্টিগোচর হলেও তার উপস্থিতি ছিল গোটা নাটক জুড়েই। সরবে। তাই আমরা তাঁকেও সমান আলোয় দেখার প্রয়াস পেয়েছি নন্দিনীর সঙ্গে। আমাদের নন্দিনী সপ্রাণ এক স্বত্ত্বা। যার উপস্থিতি বুলিয়ে যায় প্রশান্তির পরশ। লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণে প্রকাশ অনন্ত আনন্দের। এসবই তো প্রাণিত করে চারপাশের মানুষকে। রঞ্জন অকাতরে বিলায় প্রাণ; সেই রেশ, সেই উৎসর্গ মুক্তিকে ত্বরান্বিত করে। এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাক। এর আগে আমরা এই নাটকের রং ছুঁয়ে যাই। নন্দিনী যে অলংকার পরে সেটা রক্তকরবীর। আবার রঞ্জনের টুপির রংও লাল।
তবে নন্দিনীর শাড়ি ধানি রংয়ের। এখন এই ধানি রং কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলে যায়। মূলত সবুজ আর স্বর্ণালী। ধান যত পরিণত হয় সবুজ ততই প্রগাঢ় হয়। সেই সবুজ সোনালী হয়ে ওঠে পূর্ণতায়। এই দুটি রংকে রক্তকরবীতে সরাসরি উল্লেখ করা না হলেও লালের বিষয়টা স্পষ্ট। রক্তকরবী তো লাল করবী। এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখলে মন্দ হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অ্যাটম বোমার আঘাতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি তছনছ হয়ে গেলেও দুটি শহরে সাকল্যে কোনোভাবে বেঁচে যায় নানা প্রজাতির ১৭০টি গাছ। এর মধ্যে রক্তকরবীও ছিল। অন্যদিকে এই বিস্ফোরণের পর মার্কিন বিজ্ঞানী ড. হ্যারল্ড জেকবসেন বলেছিলেন যে, আগামী ৭০ বছর হিরোশিমায় কোনো কিছুই জন্মাবে না। অথচ সে বছরই আশ্চর্যজনকভাবে হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে প্রথম যে ফুলটি ফুটেছিল, সেটি ছিল রক্তকরবী! এই ফুল সুন্দর হলেও বিষাক্ত। নানাভাবে সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথও ব্যবহার করেছেন প্রতীকী অর্থে। কাকতালীয় হলেও হিরোশিমায় যেমন একটি গাছ বেঁচে ছিল, যক্ষপুরীতেও একটি গাছের উপস্থিতি আমরা টের পাই।
লাল এখানে ভীষণই প্রতীকী। শোষণ, নিপীড়ন, নিষ্পেষণ, বঞ্চনা আর বিচারহীনতা বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। আত্মবিশ্বাস, শক্তি ও সামর্থ্যের দ্যোতনা; যাকে বলে সিম্বল অব স্ট্রেন্থ। লাল এজন্যই কালোত্তীর্ণ; যুগে যুগে বিপ্লবের চিরন্তন প্রেরণা। আবার ভালোবাসার রংও এই লাল। নিঃশেষেরও কি!
এই লালকে আমরা সঙ্গী করেছি জুলাই বিপ্লবেও। সামাজিক মাধ্যমে প্রোফাইল লাল করে তরুণরা বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের সামর্থ্যের মাত্রা, ভাবনার ভার আর সাহসের গভীরতা। সেখানেও আমরা পেয়েছি অসংখ্য নন্দিনী আর রঞ্জনকে। তাই তো শতবর্ষ পেরিয়ে এই দুটি চরিত্রের আলোচনায় আমরা রক্তকরবীর সমসাময়িকতায় মুগ্ধ না হয়ে পারি না; বরং অপার বিস্ময় আর অনিঃশেষ শ্রদ্ধায় প্রণত হই রবীন্দ্রনাথের প্রতি। নন্দিনী আর রঞ্জনকে নিয়ে পুনর্ভাবনা আমাদের চমৎকৃত করে বলেই সমান্তরালে উজ্জীবীত হই বর্তমানের ব্যাখ্যায়। সর্বশক্তি দিয়ে পুলিশের গাড়ি আটকে দেওয়া, সতীর্থদের নিরাপত্তা দিতে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর মত আত্মশক্তিতে বলীয়ান অসংখ্য নন্দিনীকে আমরা পেয়েছি জুলাই বিপ্লবে। দেখছি প্রতিনিয়ত। এ ছবি তো কেবল বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীরই। একইভাবে পানি দিতে গিয়ে, সেবা দিতে গিয়ে, সতীর্থকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন দেওয়া, রক্তস্নাত রঞ্জনদেরও আমরা মনে রেখেছি। কোন সন্দেহ নেই দুটি প্রাণ এখানে পরিপূরক। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় একে অপরকে জড়িয়ে মৃত্যূবরণের দৃশ্যও আমাদের তাড়িত করে। ঐ ঘটনাও বদলে দেয় বিশ্বকে। অন্যভাবে।
যাহোক, আমরা যে নন্দিনীকে দেখি, সে শাড়ি পরে। রক্তকরবীর গয়না পরে। এই নন্দিনী লাবণ্যময়ী আবার দৃঢ়চেতাও। অধ্যাপকের ভাষায় বলতে হয়, পৃথিবীর খুশিখানা নিজের সর্বাঙ্গে টেনে নিয়েছে, ঐ আমাদের নন্দিনী। অন্যদিকে রঞ্জন পরোপকারী, প্রত্যয়ী আবার প্রেমিকও। নন্দিনী এবং রঞ্জনের পোশাকের যতটুকু বর্ণনা এখানে মেলে, তাতে এর বহুমাত্রিকতাকে উপেক্ষার অবকাশ নেই। আমরা এই চরিত্র দুটিকে তিনভাবে চিত্রণের প্রয়াস পেয়েছি, তিন অধ্যায় মাথায় রেখেই। কারণ নন্দিনী ও রঞ্জন চিরকালীন ও সমকালীন।
এখানে নন্দিনী ও রঞ্জনের রিক্রিয়েট করা তিনটি ভিন্ন লুক প্রসঙ্গে একটু সবিস্তার আলাপ করা যাক। সূচনার জুটি একেবারেই ক্লাসিক বাঙালি রূপ। এখানে বাঙালিয়ানার উদযাপনই মুখ্য। লালকে পোশাক আর আবহে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথের যে কোন চরিত্রের উপস্থাপনায় একটা 'ক্লিশে' বা গতানুগতিক স্টাইলিংয়ে থাকার চেষ্টা সবসময়েই লক্ষ করা যায়। এ থেকে কিছুটা মুক্ত ছিলেন সত্যজিৎ রায়।
আমরা নিজেদের নন্দিনী ও রঞ্জনকে আমাদের পংক্তিতে বসিয়ে ভেবেছি। এজন্য তাদের পোশাকও তেমন। সময়নির্ভর অথচ সর্বকালের। লাল জামদানি (রবীন্দ্রনাথ হলে বলতেন ঢাকাই) সঙ্গে সাদা মুক্তার হার। দ্যুতিময়, আভিজাত্যপূর্ণ। এই মেলবন্ধনে মুক্তির আনন্দ যেমন আছে তেমনি আছে সাহসী মনোভাবের প্রকাশও। অন্যদিকে ধুতি আর লালের পরশ বোলানো সাদা পাঞ্জাবি রঞ্জন যেন একে অন্যের পরিপূরক।
জীবনে ফ্যাশন অনুপেক্ষণীয়। অমোঘ। অবধারিত। আমরা এই ফ্যাশনকে স্টাইল হিসেবে টিকিয়ে রাখব নাকি ট্রেন্ডের হাওয়ায় ভাসিয়েে নিয়ে যাব, সেটা নির্ভর করছে আমাদের ওপর। অবশ্য হ্যাঁ অতীতকে যেমন উপেক্ষা করার সমীচীন না তেমন বর্তমানকে এড়িয়ে চলাও অসঙ্গত। আমরা উভয়কেই সঙ্গী করেছি।
এজন্যই বাঙালিয়ানার বাইরে গিয়ে কতুর লুকে উপস্থিত করেছি দুটি চরিত্রকে। ফলে এখানে আদ্যান্ত ক্লাসি লুকে ধরা পড়েছে উভয়ে। নন্দিনীর পোশাকে ধানি রংয়ের (সবুজ) পরশ চোখের আরাম হয়েছে। টাক্সিডো আর ফর্মাল প্যান্টের সঙ্গে অক্সফোর্ড শুজ রঞ্জনকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে গত শতকের মধ্যভাগে। রবীন্দ্রনাথ ঐতিহ্যে বিশ্বাসী থেকেও প্রথা ভেঙেছেন নানা সময়ে, সৃজনের নানা ক্ষেত্রে।
নিরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাই তো অবলীলায় বলতে পেরেছেন:
'পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে...'
এই সমন্বয়ের সেতুবন্ধ রচনার চেষ্টা আমরা করেছি তৃতীয় লুকে। যেটাকে এই সময়ের বলছি। এখানে শাড়িকে পরানো হয়েছে স্কার্টের মতো করে। ড্রেপিংয়ের নান্দনিকতায়। এর একটা উদ্দেশ্য আরও আছে। শাড়িকে কেবলই শাড়ি হিসেবে টিকিয়ে রাখা কতদিন সম্ভব হবে সেটা ভাববার বিষয়। বরং শাড়িকে নানাভাবে পরা গেলেও সেই সম্ভাবনা দীর্ঘায়িত হয়।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই প্রয়াস আমাকে ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহিত করে। এর সঙ্গে কেমিসোল, শর্ট ব্লেজার আর বুট লুককে পূর্ণতা দেয়। শাড়ির পাড়, আর শর্ট ব্লেজারের সোনালি পাকা ধানের রংকে প্রতীয়মান করে। অন্যদিকে জিন্স, প্রিন্ট শার্ট আর বুটের সঙ্গে বন্ধগলাকে প্রপসের মতো ব্যবহার করা হয়েছে রঞ্জনের লুক ফুটিয়ে তোলার জন্য। উভয়েই সমসময়ের প্রতিনিধি। স্ট্রিট ফ্যাশনের রেশ রেখে হাইস্ট্রিট ফ্যাশনে উন্নীত করার প্রচেষ্টা এখানে লক্ষণীয়। এটা তুল্য হতে পারে কেকের ওপর চেরি বসানোর সঙ্গে।
আমরা, টিম হাল ফ্যাশন তিনভাবে, তিন লুকে এভাবেই ভেবেছি নন্দিনী আর রঞ্জনকে। পুরোটা নিছকই আমাদের ভাবনা। নিরীক্ষপ্রবণ রবীন্দ্রনাথই আমাদের প্রেরণা। আজকে তাঁর জন্মজয়ন্তীতে কেবল বলতে পারি, আজি প্রণমি তোমাের।
ভাবনা: শেখ সাইফুর রহমান
সমন্বয়: নাদিমা জাহান ও জাহিদুল হক
কুশিলব: রুনা খান ও গাজী আব্দুন নূর
স্টাইলিং: দিদারুল দীপু
মেকওভার : পারসোনা
লোকেশন: স্টুডিও ক্যানভাস
পোশাক: জুরহেম, মো. জামাল হোসেন, গাজী আব্দুন নূর, পটের বিবি, ক্যানভাস
ছবি: হাদী উদ্দীন
ভিডিওগ্রাফি: কানিজ ফাতেমা
পৃষ্ঠপোষক: প্রাইম ব্যাংক
আয়োজন: টিম হাল ফ্যাশন