আমার বাবা, ‘দ্য কিং অব ঢাকা’
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বাংলাদেশে ছেলেদের পোশাক-আশাক, ফরমাল মেনজ ওয়্যার আর ফ্যাশন নিয়ে সত্যিকার অর্থে অন্তর থেকে কিছু ভেবেছেন এবং করে দেখিয়েছেন, এমন হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই চলে আসবে বীর প্রতীক শাহজামান মজুমদারের নাম। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলি, তিনি আমার বাবা। দ্য কিং অব ঢাকা নামেই বেশি পরিচিত এ দেশের ফ্যাশনসচেতন মানুষের কাছে।

বড় মেয়ের পরে একমাত্র ছেলে হিসেবে বাবাকে পেয়েছি খুব কাছে থেকে। ইন্দিরা রোডের বাসার কাছেই বাবার সঙ্গে ভাইবোন মিলে ভিডিওর দোকানে যাওয়া শৈশবের এক মজার স্মৃতি আমার। তিনি খুব বন্ধুর মতো মিশতেন, মজা করতেন। বকাঝকা সব মায়ের দিক থেকেই আসত। বাবা খুব বেশি হলে হয়তো পুরো জীবনে দশবার রাগ করেছেন আমার ওপর। তবে সহজে রাগতেন না বলেই হয়তো ভয়টা বেশি ছিল। আর রাগলেও তার একটা যৌক্তিক কারণ থাকত।

ভিডিও ও কম্পিউটার গেমস, মুভি দেখা, গান শোনা এগুলো খুবই পছন্দ করতেন তিনি। আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। এ জন্য একই বাসায় আমরা অনেক ভাইবোন একসঙ্গে থাকতাম। কিন্তু আমি বাবার সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করতাম। গেমস খেলা, সিনেমা দেখা, নতুন নতুন বিষয়ে জানা সবই ছিল বাবার সঙ্গে। বাবার ছিল বহু ধরনের শখ। যুদ্ধবিমান, অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারেও আগ্রহ ছিল। প্রায়ই বিভিন্ন ঝোঁক ও খেয়াল নিয়ে মেতে থাকতেন তিনি। আর্চারি, ছবি আঁকা, নৌকা বানানোর খুঁটিনাটি নিয়ে জানা—এমন অনেক শখও ছিল তাঁর। তবে খেয়ালি এই মানুষটি এক কাজ খুব বেশি দিন করতে চাইতেন না। খুব পছন্দ করতেন তরুণদের সঙ্গে সময় কাটাতে। কারণ, তিনি মনে করতেন, তরুণদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। তবে বাবার সবচেয়ে আবেগ আর আগ্রহের জায়গা ছিল ফ্যাশন। যে জগতে আমি পা রেখেছি, আরও অনেক পরে।

বিজ্ঞাপন

একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমার স্মৃতিতে বাবা তাঁর পোশাক-আশাকের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ও সচেতন ছিলেন। খুবই সুশৃঙ্খল জীবন ছিল তাঁর। সকালে উঠেই তিনি ঠিক করতেন তাঁর সাজপোশাক আর অনুষঙ্গ। নিজস্ব ড্রেসার রুমে একেবারে রিচুয়াল মেনেই তিনি রোজ সকালে এই কাজ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজের তৈরি করা কালার হুইল মেনে চলতেন। কোন রঙের সঙ্গে কোন রং কীভাবে পরলে মানাবে, তার জন্যই এ ব্যবস্থা। একই কম্বিনেশনের পোশাকে তাঁকে কখনো একাধিকবার দেখা যেত না। পোশাক নির্বাচনের পর শার্ট, ট্রাউজার্স নিজেই ইস্তিরি করতেন সময় নিয়ে। নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করবেন, সে বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। অকপটেই বলি, সে সময় এই ফরমাল মেনজ ওয়্যার নিয়ে আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। ২০১৬-১৭ সালের দিকে তিনি আমাকে বলেন তাঁর নিজস্ব বেস্পোক টেইলারিং সার্ভিস ‘ড্যাপার বেস্পোক’-এ তাঁর সঙ্গে কাজ করতে। এরপর থেকেই আমার মেনজ ফ্যাশন নিয়ে প্যাশন তৈরি হয়। আমি এ ব্যাপারে পড়াশোনা শুরু করি এবং বাবার কাছে জানতে চাইতাম নানা বিষয়। ফ্যাশন নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কাজ করতে গিয়েও শিখেছি অনেক কিছু।

আইবিএতে থাকার সময়েই ফ্যাশন নিয়ে বাবা এতটা উৎসাহী হন। সেখানে সবার পরা নীল স্যুট তাঁকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। আমার বড় ফুফাও তাঁর স্যুটপ্রীতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। মেনজ ফ্যাশন নিয়ে নিজের প্রতিদিনের ভাবনা, অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১০ সালে লেখা শুরু করলেন নিজের ব্লগ ‘দ্য কিং অব ঢাকা’। এর মাধ্যমে তিনি দেশের পুরুষদের ফরমাল ফ্যাশন সেন্স গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই ব্লগের জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায়ই ২০১৪ সালে তিনি নিজেই বেস্পোক টেইলারিং সার্ভিসের কথা ভাবেন। পরিকল্পনা করেন বিলেত বা ইতালির ঐতিহ্যবাহী কায়দায় তা পরিচালনা করার। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত পুরোপুরি হাতে তৈরি করা হয় ড্যাপার বেস্পোকের স্যুট।

আমি নিজেও এখন বাবার পথ ধরে স্যুটিং, বডি ফিটিং, কোন শারীরিক গঠনে কেমন কাট মানায়, স্যুটিং–সংক্রান্ত প্রোপরশন, কিসের সঙ্গে কি মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করলে ভালো লাগে এই সব নিয়েই ভাবি, পড়ালেখা করি।

বিজ্ঞাপন

বাবা ছিলেন খুবই বিনয়ী। ডাউন টু আর্থ যাকে বলে। আমি কোনো দিন কারও ব্যাপারে নেতিবাচক কথা বলতে শুনিনি। বরং সে কি পরিস্থিতিতে আছে, তা বিচার করতে চেষ্টা করতেন। সামনাসামনি দেখলে তাঁর সাজপোশাক বা শারীরিক গঠনের জন্য তাকে সবাই গম্ভীর স্বভাবের মনে করলেও তিনি আসলে ছিলেন একদমই বিপরীত স্বভাবের। তিনি খুব মজা করতে পছন্দ করতেন। কখনো কাউকে মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেন না।

যেকোনো কাজ তিনি গভীরভাবে মনোযোগ দিয়ে করতেন। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘গেরিলা’ বইটি লেখার সময় তিনি ইংরেজি ও বাংলায় নিজের পারদর্শিতা বাড়াতে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। এই ব্যাপারটি সবকিছুর বেলাতেই সত্য ছিল। তবে ফ্যাশনের ব্যাপারে কিছু শিখতে বা জানতে হলে তিনি আরও বেশি সিরিয়াস হতেন। খুব বেশি আবেগ প্রকাশ করতেন না। যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়েও একেবারেই আলাপ করতেন না আমাদের সঙ্গে। বরং হাসিখুশি থাকা পছন্দ ছিল তাঁর। প্রায়ই বিভিন্ন কৌতুকে মেতে উঠতেন। কখনো কাঁদতে দেখিনি তাঁকে।

জীবনের শেষের দিকে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডায়ালাইসিস চলেছে বহুদিন ধরে। ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ায় করোনাকালে বাবার কাছে যেতে পারতাম না। ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর হঠাৎই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে ভর্তির ১২ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি চলে যান আমাদের ছেড়ে। খুব চাপা স্বভাবের আমার বাবা কাউকে কষ্ট দিতে চাইতেন না, প্রকাশই করতেন না তাঁর খারাপ লাগছে। অসম্ভব রকমের মানসিক শক্তি ছিল তাঁর।

বাবাকে ভীষণ মিস করি। আমার জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে ছিলেন তিনি। শুধু আমি নই, পরিবারের বাকি সবার সঙ্গেও রয়েছে অনেক সুখস্মৃতি। হাসিখুশি, সহজ-সরল স্বভাবের জন্যই সবাই তাঁর অভাব ভীষণ রকমের বোধ করে। বাবার অন্তরের অত্যন্ত কাছাকাছি ‘ড্যাপার’-এ বাবার সঙ্গে একত্রে কাজ করা আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। সে সময় একসঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সারা দিন তাঁর সঙ্গে কাজ করা, একত্রে কফি খাওয়া, লাঞ্চ করা, কাজ নিয়ে কথা বলা—এভাবে আমরা বাবা-ছেলে খুব কাছাকাছি আসি। যা জীবনের এই পর্যায়ে এসে অনেকের ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে না। এ জন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। এখনো আমি তাঁর স্বপ্নের বেস্পোক টেইলারিং সার্ভিসটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি নিজের সবটুকু দিয়ে। তবে কাজের ক্ষেত্রে কোনো বাধা এলে, কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলে, খুবই মিস করি বাবাকে। তিনি ছিলেন আমার অত্যন্ত কাছের বন্ধু। যার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা যেত। আমার জীবনে তাঁর কোনোই বিকল্প নেই। আর ঠিক তেমনি ‘দ্য কিং অব ঢাকা’র স্থানটিও কেউ নিতে পারবে না বাংলাদেশের ফ্যাশনজগতে।

অনুলিখন: নাদিমা জাহান ও ফাহমিদা শিকদার

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২২, ১৪: ১৩
বিজ্ঞাপন