আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে বাংলাদেশি মডেল ও ডিজাইনারদের পরিচিত করানোই উদ্দেশ্য ওমর চৌধুরীর
শেয়ার করুন
ফলো করুন

নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, মিলান বিশ্বের ফ্যাশন ক্যাপিটাল নামে সুপরিচিত। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে এই শহরগুলোতে অনুষ্ঠিত হয় জমজমাট ফ্যাশন উইক। এতে বিশ্বের সব নামীদামি ডিজাইনার তাঁদের নতুন কালেকশন প্রদর্শন করেন এবং র‌্যাম্পে ইন্ডাস্ট্রির সেরা মডেলরা হাঁটেন। বেশ কয়েক বছর ধরে চার ফ্যাশন উইকে বিভিন্ন ফ্যাশন শোতে বাংলাদেশি মডেলদের হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। যে এজেন্সির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশি মডেলরা এ ধরনের আয়োজনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে, তার নাম হলো সাউন্ডপেস ইন্টারন্যাশনাল। নিউইয়র্কভিত্তিক এই মিউজিক ও মডেলিং এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ওমর চৌধুরী। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে ঘুরে গেছেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল সাউন্ডপেস ইন্টারন্যাশনালের নানা কথা।

সাউন্ডপেস ইন্টারন্যাশনালের যাত্রা শুরু ২০০৭ সালে। প্রথম দিকে মিউজিক নিয়ে কাজ হতো। বিশেষ করে আর্টিস্ট রিলেশন নিয়ে। নিউইয়র্ক, দুবাই, ব্যাংককের বিভিন্ন ক্লাবে সাউন্ডপেস বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করত।

সাউন্ডপেস ইন্টারন্যাশনালের যাত্রা শুরু ২০০৭ সালে। প্রথম দিকে মিউজিক নিয়ে কাজ হতো। বিশেষ করে আর্টিস্ট রিলেশন নিয়ে। নিউইয়র্ক, দুবাই, ব্যাংককের বিভিন্ন ক্লাবে সাউন্ডপেস বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করত। এখনো এ ধরনের অনেক ইভেন্ট করে প্রতিষ্ঠানটি। এরই সুবাদে এজেন্সিটির সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুপরিচিত কিছু ডিজেদের রয়েছে বেশ ভালো সম্পর্ক। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিপলো ও টেল অফ আস। ইলেকট্রনিক ড্যান্স মিউজিক (ইডিএম) গোত্রের সংগীতপ্রেমীদের কাছে যাদের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সাউন্ডপেসের মোট চারটি শাখা আছে।

বিজ্ঞাপন

কথায় কথায় জানা গেল ওমর চৌধুরীর জন্ম লন্ডনে। বাবার চাকরির সুবাদে সেখানেই থাকত তাঁর পরিবার। তাঁর যখন ১০ বছর বয়স, তখন পরিবারের সবাই নিউইয়র্কে চলে আসেন। ওমর চৌধুরীর বেড়ে ওঠা ওখানেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি রয়েছে তাঁর টান। সেই টান থেকেই তিনি সাউন্ডপেস নিয়ে বাংলাদেশেও কাজ করা শুরু করেন। এ দেশের একটি মিউজিক চ্যানেলের সঙ্গেও রয়েছে যোগাযোগ। এই চ্যানেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরিফুল ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের কাজগুলো করেন ওমর। সাউন্ডপেস নিবন্ধিত লন্ডনে। সেখানে তাঁর আরও এক অংশীদার আছে।

ওমর চৌধুরী বলেন, ‘২০১৭ সালে আরিফুল ইসলাম আমাকে বলেন, আপনি তো মিউজিক নিয়ে অনেক কিছু করেন, এবার ফ্যাশন নিয়ে করতে পারেন।’ এখানে বলে রাখা ভালো, ছোটবেলা থেকে ফ্যাশনের প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন ওমর চৌধুরী। গুচি, শ্যানেলের মতো ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। র‌্যাম্প শোয়ের সঙ্গে মিউজিকের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এ জন্যই অনেক ফ্যাশন ডিজাইনারের শোতে ওমর চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। এভাবেই অনেক ডিজাইনার ও মডেলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তাই আরিফুল ইসলামের কথাকে গুরুত্ব দিয়েই ফ্যাশন নিয়ে কাজ শুরু করেন ওমর।

বিজ্ঞাপন

২০১৯ সালে ওমর চৌধুরীর পরিচয় হয় বাংলাদেশি ফ্যাশন ডিজাইনার পিয়াল হোসেনের সঙ্গে। তিনি ওমর চৌধুরীকে একটি দারুণ পরামর্শ দেন। বাংলাদেশে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক ভালো করছে। সেখানে ভালো ডিজাইনার ও মডেল আছেন, তাঁদের নিউইয়র্কে কাজের সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উপস্থাপনার পরামর্শ দেন পিয়াল। এটা মনে ধরে ওমরের। তিনিও মনে করেন এর মধ্য দিয়ে নিজের দেশকে ফ্যাশন বিশ্বে তুলে ধরার যায়। সেই থেকে শুরু। ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারিতে সাউন্ডপেসের সহযোগিতায় পিয়াল হোসেন তাঁর কালেকশন প্রদর্শন করেন। সেই ফ্যাশন শোয়ের শোস্টপার হয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী ও মডেল তমা মির্জা। আয়োজনটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

সে বছর গোটা বিশ্ব আক্রান্ত হলো করোনা মহামারিতে। ফ্যাশন দুনিয়া অবশ্য থেমে থাকেনি। ফ্যাশন উইকগুলো ভার্চ্যুয়াল রূপে দেখা দিল। সে সময় বিরতি নেন ওমর চৌধুরী। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আবার নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে র‌্যাম্পে হাঁটেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি মডেল নুসরাত তিসাম।  

গত বছর সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত প্যারিস ফ্যাশন উইকে হাঁটেন মিস গ্র্যান্ড বাংলাদেশ বিজয়ী মডেল তৌহিদা তাসনিম তিফা। এ নিয়ে ওমর চৌধুরী বলেন, ‘আমার পরিচিত একজন তিফার কথা আমাকে বলেন। সে মিস গ্র্যান্ড বাংলাদেশ বিজয়ী এবং বেশ মেধাবী শুনেছিলাম। সবকিছু বিবেচনা করে প্যারিস ফ্যাশন উইকের জন্য তাঁকে সিলেক্ট করি। আমি আসলে চাচ্ছিলাম স্বল্প পরিচিত কিন্তু প্রতিভাবান কাউকে খুঁজতে। কারণ, তারা দেশের বাইরে গিয়ে ভালো কাজ করে এবং সুন্দরভাবে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারে। তিফা প্যারিসে তার কাজ দিয়ে খুব সুনাম কুড়িয়েছে।’
একই ফ্যাশন উইকে হেঁটেছেন লস অ্যাঞ্জেলেসপ্রবাসী বাংলাদেশি মডেল জেরিন সাদিয়া সোহা। তিনি এর আগে নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকেও একাধিকবার অংশগ্রহণ করেছেন।

রাইসা ইন্টারমিডিয়েট লেভেল শো করবেন। সেখানে তিনি দুটি কালেকশন শোকেস করবেন। তাঁর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর সারা আলমকে একটি কালেকশনের জন্য শোস্টপার নির্ধারণ করা হয়েছে।

ওমর চৌধুরী জানান, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইনভিত্তিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘রাই বা রাইসা রফিক’ কালেকশন প্রদর্শন করবে। সেই প্রদর্শনীতে শোস্টপার হিসেবে হাঁটবেন দেশের সুপরিচিত উপস্থাপক, মডেল ও অভিনেত্রী সারা আলম। ওমর চৌধুরী বলেন, ‘রাই-এর প্রধান নির্বাহী ও সিনিয়র ডিজাইনার রাইসা রফিক বিশ্বের অন্যতম সেরা ফ্যাশন স্কুল নিউইয়র্কের ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েট। সে খুবই মেধাবী। তার কাজ দেখে আমি তাকে পছন্দ করি। এ ছাড়া প্রতিবার আমাদের কিউতে একজন–দুজন হলেও বাঙালি ডিজাইনার বা মডেল রাখার চেষ্টা করে থাকি। সেভাবেই তাকে নেওয়া। নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে তিন ধরনের কিউ হয়ে থাকে। টপ অব মাইন্ড, ইন্টারমিডিয়েট ও বিগেনার লেভেল। রাইসা ইন্টারমিডিয়েট লেভেল শো করবেন। সেখানে তিনি দুটি কালেকশন শোকেস করবেন। তাঁর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর সারা আলমকে একটি কালেকশনের জন্য শোস্টপার নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্য কালেকশনের শোস্টপার এখনো নির্বাচন করা হয়নি।’

ওমর চৌধুরীর কাছে আরও জানা গেল এ বছরে সেপ্টেম্বরে মিলান ফ্যাশন উইকেও থাকছে সাউন্ডপেস টিম। সেখানে বাংলাদেশ থিমে একটি ফ্যাশন শো করার পরিকল্পনা তাঁর। ফ্যাশন ডিজাইনার, মডেল, মেকআপ আর্টিস্ট বাংলাদেশ থেকে নেওয়া হবে।
বাংলাদেশের ফ্যাশন ডিজাইনার ও মডেলরা এ ধরনের ফ্যাশন উইকে কাজ করতে চাইলে সাউন্ডপেসের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। এ ছাড়া ওমর চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগও করা যাবে।

চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হলে ডিজাইনার ও মডেলদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কিছু ফি নেওয়া হয়। ওমর চৌধুরী জানান, বাংলাদেশ থেকে ডিজাইনার বা মডেলদের নিয়ে দেশের বাইরে কাজ করা সত্যিই বেশ আনন্দের অভিজ্ঞতা হলেও পুরো প্রসেসটা কখনো কখনো বেশ চ্যালেঞ্জিংও। কারণ, ভিসাসংক্রান্ত বিষয়। এসব ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ হলো স্বচ্ছতা। এ ছাড়া যে দেশে শো করতে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁরা থেকে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা দিতে হয়। কারণ, বাংলাদেশিদের এ ক্ষেত্রে দুর্নাম আছে অনেক আগে থেকে।  

ওমর চৌধুরীর কাছে এখন পর্যন্ত সব নারী ডিজাইনার ও মডেলরা কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তবে ভবিষ্যতে পুরুষ ডিজাইনার ও মডেলদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে তাঁর।  

বাংলাদেশে ভালো মডেল আছে কিন্তু ভালো গ্রুমিং প্রতিষ্ঠান নেই, সে ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাওয়া হলে ওমর চৌধুরী বলেন, ‘এখানে আজরা মাহমুদের এএমটিসি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মডেলদের সবচেয়ে ভালো গ্রুমিং করে থাকে। কিন্তু অন্যদের ব্যাপারে একই কথা বলতে পারছি না। কারণ, তারা ভালো গ্রুমিং করছে। সেখানে মডেলিং বাদ দিয়ে মিডিয়ার অন্য সেক্টরে চলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি।

বাইরের দেশে এজেন্সির মাধ্যমে মডেলরা এসে থাকে, কারও ব্যক্তিগত রেফারেন্সে নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এই সেক্টরে অনেক এগিয়ে। ওখানে র‌্যাম্প মডেলরা টিভিসি, মুভি, ড্রামা এসব করেন না। বাংলাদেশিরা অনেক বুদ্ধিমান। তাঁদের শেখার আগ্রহ আছে এবং তাঁরা অনেক দ্রুত শিখে ফেলেন। তবে এই পথছুট ব্যাপারের জন্য আর্থিক বিষয়টা অনেক বড় ইস্যু। কারণ, এখানে শুধু র‌্যাম্পে হেঁটে ভালো অর্থ উপার্জন করার সুযোগ কম। এদিকটা পরিবর্তন করতে চাই।’

আমার এজেন্সিতে অনেক দক্ষ কর্মী কাজ করেন, যাঁদের পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে আন্তর্জাতিক মানের শো করার ক্ষমতা আছে। তাঁদের নিয়ে আমি বাংলাদেশে একটি গ্রুমিং স্কুল খুলতে চাই। সেখানে মডেলদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষক দিয়ে হাঁটা, কথা বলা ও ফিটনেস ট্রেনিং দেওয়া হবে।

ওমর চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমার এজেন্সিতে অনেক দক্ষ কর্মী কাজ করেন, যাঁদের পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে আন্তর্জাতিক মানের শো করার ক্ষমতা আছে। তাঁদের নিয়ে আমি বাংলাদেশে একটি গ্রুমিং স্কুল খুলতে চাই। সেখানে মডেলদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষক দিয়ে হাঁটা, কথা বলা ও ফিটনেস ট্রেনিং দেওয়া হবে। এখানে শুধু এজেন্সি খোলাই হবে না, এর মাধ্যমে কাজের সুযোগও দেওয়া হবে। নিউইয়র্ক, প্যারিস, মিলান, লন্ডন—সব ফ্যাশন উইকে মডেলদের কাজের সুযোগ করে দিতে চাই আমরা।’

ছবি: ওমর চৌধুরী

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯: ৪৩
বিজ্ঞাপন