পরম্পরার ঐতিহ্য অটুট রেখে প্রতিমা নির্মাণ করে চলেছেন হরিপদ পাল
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বাঙালি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রতিমা নির্মাণের শিল্পীরা। প্রতিবছর পূজার আগে যতটা ব্যস্ততা থাকে, এবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সেটায় কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে।

রূপ পরিগ্রহ করছে দেবী
রূপ পরিগ্রহ করছে দেবী

তবু প্রতিমাশিল্পীরা একেবারে বসে নেই। বরং তুলায় কম হলেও প্রতিবছরের মতো এবারও করছেন প্রতিমা নির্মাণের কাজ। কাঠামো তৈরি শেষে এখন চলছে প্রতিমা তৈরি। শাঁখারীবাজারের শিমুলিয়া ভাস্কর শিল্পালয়ের ভাস্কর হরিপদ পাল বংশানুক্রমিকভাবে প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রতিমা তৈরির খুঁটিনাটি নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

হরিপদ পাল বলেন, ‘প্রতিমা তৈরি আমাদের পরম্পরার পেশা। আমার বাবা, ঠাকুরদা, তাঁর বাবা—সবাই প্রতিমা তৈরি করতেন। ছেলেবেলা থেকেই কাজ দেখে বড় হয়েছি। তারপর একসময় নিজেও শিখেতে শুরু করেছি।’

এরপর রং চড়ানো হবে
এরপর রং চড়ানো হবে

অনেকে আবার এই বংশানুক্রমিক ধারা অব্যাহত রাখেননি। চলে গেছেন অন্য পেশায়। শিল্পবোধ ও ভালোবাসার টানেই অনেকেই ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিমা গড়ার কাজ। জানালেন, রথের পূজার পরেই শুরু হয়ে যায় দুর্গাপূজার আগমনী লগ্ন। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা তৈরি।

বিজ্ঞাপন

প্রতিমা তৈরির প্রথম ধাপ হলো কাঠামো ও আবক্ষ তৈরি। তবে সময় লাগে কারুকার্য আর সৌন্দর্যবর্ধনে। হরিপদ পাল জানান, তরুণ বয়সে কোনো বছরে ১০-১১টি প্রতিমাও বানিয়েছেন। এখন ৭০ পেরিয়েছে। তাই আগের মতো ধকল নিতে পারেন না। এবারের পূজায় কেবল একটি প্রতিমা গড়ছেন। তাঁর সঙ্গে আরও তিনজন আছেন সহযোগী হিসেবে। পুরো প্রতিমা বানাতে মাসখানেক সময় লাগে, জানালেন তিনি। বাংলাবাজার, পুরান ঢাকা, কুমারটুলীতে প্রতিমাশিল্পীরা আছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন।

প্রতিমায় রংয়ের পরত পড়ছে
প্রতিমায় রংয়ের পরত পড়ছে

হরিপদ পাল আরও জানান, বনানী ও ঢাকেশ্বরী মণ্ডপের প্রতিমাও করেছেন তিনি। কীভাবে প্রতিমা গড়ার ধাপ নিয়ে কথা হয়, এ নিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে কাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর তার ওপর মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রথমে একমেটে, এরপর দোমেটে, তারপর ধাপে ধাপে মাটির প্রলেপে দেবী রূপ পায়। কাঠামো বানানো হয় বাঁশ দিয়ে, এর ওপর খড় দিয়ে ভেতরের আকৃতি দেওয়া হয়। তারপর দড়ি দিয়ে বেঁধে শক্ত করা হয়।

কাঠামো হয়ে গেলে এর ওপর মাটি লেপন করা হয়। মোটামুটি আবক্ষ তৈরি হয়ে গেলেই দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর হাতে শাঁখা পরিয়ে দেওয়া হয়। হরিপদ পাল জানান, সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, মা দুর্গার প্রতিমা তৈরি করতে চারটি জিনিস আবশ্যক—গঙ্গার পলিমাটি, গোমূত্র, গোবর ও পতিতালয়ের মাটি। এগুলোর সঙ্গে সাধারণ মাটি মিশিয়ে তৈরি করা হয় সব প্রতিমা।

প্রতিমা তৈরির সাজসরঞ্জাম
প্রতিমা তৈরির সাজসরঞ্জাম

হরিপদ পাল আরও বলেন, মহামায়া ৯টি রূপে পূজিত হন—নর্তকী, কাপালিক, ধোপানী, নাপিতানী, ব্রাহ্মণী, শূদ্রাণী, গোয়ালিনী, মালিনী ও পতিতা। সময়ের সঙ্গে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে মাটি সংগ্রহের ক্ষেত্রে। মূলত শিল্পীরা প্রতিমা নির্মাণে তিন ধরনের মাটি ব্যবহার করে থাকেন। বেলে, দোআঁশ ও এঁটেল মাটি একেকভাবে প্রতিমা নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। প্রথমে দেওয়া দোঁআশ মাটির প্রলেপ। শুকানোর পর দেওয়া হয় এঁটেল মাটির পরত। আবার শুকানোর পর ফাটল ধরে। তৃতীয় ধাপে দেওয়া হয় বেলে মাটির প্রলেপ। রং যাতে পাকাপোক্তভাবে বসে, সে কারণে একদম মসৃণ করে লেপন করা জরুরি। বারবার লেপনের পর শুকিয়ে ফাটল বন্ধ হলে রং করা শুরু হয়।

তবে দুর্গার চক্ষুদান করা হয় মহালয়ার দিন। মহালয়ায় মাতৃপক্ষের সূচনা হয়। কাঠি পড়ে পূজার ঢাকে। আক্ষরিক অর্থেই সূচনা হয়ে যায় দুর্গাপূজার। তবে প্রতিমা স্থাপন করা হয় পূজার দু–তিন দিন আগে।

উৎসবে সম্প্রীতির প্রত্যাশা হরিপদ পালের
উৎসবে সম্প্রীতির প্রত্যাশা হরিপদ পালের

পরিশেষে হরিপদ পাল বলেন, বাংলাদেশটা সবার। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই আমরা বাঙালি। দিনশেষে আমরা সবার মঙ্গল চাই। দুর্গাপূজার আবেগ সর্বজনীন।
সব ভেদাভেদ ভুলে মানুষ মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে। সেই আনন্দ যেন কোনোভাবেই ম্লান না হয়, সেটাই প্রত্যাশা এই শিল্পীর।
ছবি: শিশির চৌধুরী ও সংগৃহীত

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন