পাঁচ তারকা হোটেলে প্রথম বাংলাদেশি জেনারেল ম্যানেজার মো. আল আমিন: 
অতিথিরা কেবল সন্তুষ্ট নন, উল্লসিত হবেন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

হাল ফ্যাশন: প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন ও শুভকামনা। কারণ, এই প্রথম কোনো বাংলাদেশি এমন সাফল্য অর্জন করলেন।

আল আমিন: ধন্যবাদ আপনাদের।

বিজ্ঞাপন

হাল ফ্যাশন: এত বছর পরে এসে এই প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে কোনো পাঁচতারকা হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার হয়েছেন। বিষয়টি জানার মুহূর্তটা কেমন ছিল?

বাংলাদেশের কোন পাঁচতারকা হোটেলের প্রথম জেনারেল ম্যানেনার মো. আল আমিন
বাংলাদেশের কোন পাঁচতারকা হোটেলের প্রথম জেনারেল ম্যানেনার মো. আল আমিন

আল আমিন: সত্যি বলতে, এটা শুধু আমার জন্য নয়, বাংলাদেশের আতিথেয়তা খাতের জন্যও এক বড় স্বীকৃতি। ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের মতো আমেরিকান কোম্পানিতে এই পদ পাওয়া সহজ নয়। এখানে কমপ্লায়েন্স, মানদণ্ড আর আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড সবই খুব কঠোর। তাই যখন ১ সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি দায়িত্ব নিই, তখন মনে হয়েছিল যেন নিজের নয়, দেশের একটা স্বপ্ন পূরণ হলো।
এর আগে বাংলাদেশি একজন জেনারেল ম্যানেজার হয়েছেন। তবে তিনি ছিলে বাংলাদেশি আমেরিকান। তাঁর কাছে অবশ্য আমি কাজ শিখেছি।

বিজ্ঞাপন

হাল ফ্যাশন: আপনার পেশাগত জীবনের কথা শুনতে চাই?

আল আমিন: অনেকেই জানেন না আমি কিন্তু প্রথমে হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলাম না। আমার প্রথম চাকরি ছিল গ্রামীণফোনের করপোরেট সেলসে। সেখান থেকেই মানুষ, পেশাদার পরিবেশ আর সার্ভিস সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। এক বন্ধুর মাধ্যমে হোটেল সেলসের চাকরির সুযোগ পাই এবং সেখান থেকেই শুরু প্যান প্যাসিফিকে। ২০১০ সালে আমি ওয়েস্টিনে যোগ দিই।  প্রথমে খুব কঠিন লেগেছিল, কিন্তু এই শিল্পের রং, সংস্কৃতি এবং মানুষের সঙ্গে প্রতিদিনের সম্পর্ক আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলি।

হাল ফ্যাশন: আপনার ক্যারিয়ারে কোনটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’?

নানা পথ পাড়ি দিয়ে মো. আল আমিন আজ এখানে
নানা পথ পাড়ি দিয়ে মো. আল আমিন আজ এখানে

আল আমিন: একাধিকবার এমন মুহূর্ত এসেছে। একসময় করপোরেট চাকরি ছেড়ে আতিথেয়তায় পুরোপুরি ঝুঁকে পড়া, পরে চার তারকা হোটেল থেকে পাঁচ তারকার দায়িত্ব নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্তই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু আমি সব সময় ভেবেছি, যদি নিজের দক্ষতা ও সততায় বিশ্বাস রাখি, তাহলে কঠিন সিদ্ধান্তও সুযোগে পরিণত হয়। এর মধ্যে সিক্স সিজন অব ঢাকা বুটিক হোটেলের দায়িত্ব নিই। সে সময় কোভিড চলছে, সবাই তখন লোকসানে আছে। আমি কুর্মিটোলা হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য এখানে থাকার ব্যবস্থা করি। অন্যান্য জটিল পরিস্থিতি সফলভাবে সামলাই; যা আমাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে হোটেল বিজনেসকে সামলানো শেখায়। এখানে বলে রাখি, সেই সময়ে যখন সব হোটেল খালি, তখন আমরা পুরো ব্যবসা করেছি। হ্যাঁ, ঝুঁকি ছিল। সেটা নিযেছি। সফলও হয়েছি।

হাল ফ্যাশন: বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড হোটেলে কাজ করার সময় কি কোনো বিশেষ চ্যালেঞ্জ এসেছে?

আল আমিন: এসেছে, অবশ্যই। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশের কর্মীদের অনেক সময় যোগ্যতর হিসেবে দেখা দেখা হয় না। কিন্তু আমি সব সময় কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছি যে আমরা কোনো অংশে কম নয়। আমি বরং চ্যালেঞ্জগুলোকে অনুপ্রেরণায় পরিণত করেছি।

হাল ফ্যাশন: একজন জেনারেল ম্যানেজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ কী বলে মনে করেন?

কৌশল, যোগাযোগ ও মানবিকতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন মো. আল আমিন
কৌশল, যোগাযোগ ও মানবিকতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন মো. আল আমিন

আল আমিন: আমি মনে করি তিনটি গুণ গুরুত্বপূর্ণ—কৌশল, যোগাযোগ ও মানবিকতা। তবে আমি বলব, কৌশলই প্রথম। একজন জিএম আসলে মালিক, ব্র্যান্ড ও কর্মীদের মধ্যকার সেতু। তাই কৌশলগত দৃষ্টি ছাড়া নেতৃত্ব অসম্পূর্ণ। এই পেশায় একাডেমিক যোগ্যতা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দিনের শেষে কর্মচারীদের সন্তুষ্ট রাখা এবং কাজের প্রতি তাঁদের উৎসাহ ধরে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। করপোরেট রাজনীতি এবং কঠোর নিয়মকানুন থাকা সত্ত্বেও আমি সহকর্মীদের সমর্থন দিয়ে এবং তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশ নিশ্চিত করে কাজ করার চেষ্টা করি।

হাল ফ্যাশন: প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে কীভাবে টিমকে মোটিভেটেড রাখেন?

আল আমিন: আমার বিশ্বাস, একজন কর্মী যদি বুঝতে পারে যে তার কাজের মূল্য আছে, সে নিজেই মোটিভেটেড থাকে। আমি সব সময় বলি, সেলিব্রেট স্মল উইনস; সাফল্য যত ছোটই হোক, সেটাকে উদ্‌যাপন করা দরকার। এতে কর্মীদের মধ্যে ওনারশিপ ও গর্ব জন্মায়। আর আমি মনে করি, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে একটা ভালো দলই সবচেয়ে বড় সম্পদ।

হাল ফ্যাশন: আপনার ম্যানেজমেন্ট দর্শনকে তিন শব্দে যদি বলেন?

স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার পক্ষে মো. আল আমিন
স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার পক্ষে মো. আল আমিন

আল আমিন: ইন্টিগ্রিটি, নন–বায়াসনেস ও সেলিব্রেশন। আমি স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার পক্ষে। কাজের জায়গায় সম্পর্ক নয়, ফলই প্রাধান্য পায়। আমি এটাও মনে করি যে ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া একজন নেতার প্রথম দায়িত্ব।

হাল ফ্যাশন: সার্ভিস কালচার কীভাবে গড়ে তোলা যায় বলে আপনি মনে করেন?

আল আমিন: আমাদের সংস্কৃতিতে আতিথেয়তা শুরু হয় আমাদের বাসা থেকেই। আর মানবিকতা তো আছেই, কিন্তু আমরা অনেক সময় সেটাকে পেশাগতভাবে সংগঠিত করতে পারি না। আমার লক্ষ্য এমন একটি সার্ভিস কালচার তৈরি করা, যেখানে কর্মীরা মনে করবেন, ‘উই লিভ আ হিরোজ লাইফ’; অতিথি সন্তুষ্ট না হলে হোটেলের নাম, ব্র্যান্ড কিছুই অর্থ বহন করে না। আমি চাই, অতিথি যেন শুধু সন্তুষ্ট না হয় ডিলাইটেড হয়।

হাল ফ্যাশন: বাংলাদেশের হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আল আমিন: আমি খুবই আশাবাদী। আমরা এখনো উন্নয়নের পর্যায়ে আছি; কিন্তু প্রতিভা আছে, পরিশ্রম আছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা মানুষ। আমরা স্বভাবগতভাবে অতিথিপরায়ণ। এই শক্তিটাই পেশাদারভাবে ব্যবহার করতে হবে।

হাল ফ্যাশন: আগামী ১০ বছরে আতিথেয়তা খাত কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?

আগামী ১০ বছরে ‘স্বনির্ভর আতিথেয়তা খাত তৈরি হবে বলেই তাঁর ধারণা
আগামী ১০ বছরে ‘স্বনির্ভর আতিথেয়তা খাত তৈরি হবে বলেই তাঁর ধারণা

আল আমিন: আমি মনে করি, আগামী ১০ বছরে আমরা একটি ‘স্বনির্ভর আতিথেয়তা খাত (সেল্ফ–সাফিসিয়েন্ট হসপিটালিটি ইকোসিস্টেম)’ তৈরি করতে পারব। দেশীয় দক্ষতা, প্রাইভেট-গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক হোটেল মানচিত্রে জায়গা করে নেবে। আমি বিশ্বাস করি, আগামী ৫–১০ বছরে বাংলাদেশে স্বনির্ভর হোটেল ইকোসিস্টেম গড়ে উঠবে। দক্ষ মানবসম্পদ এবং সঠিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এন্ট্রি-লেভেলের বেতন তুলনামূলকভাবে ভালো এবং সিনিয়র লিডারশিপ প্রতিযোগিতামূলক। রাতারাতি সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়; ধৈর্য এবং বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।

হাল ফ্যাশন: প্রতিদিন সকালে কাজ শুরু করার আগে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেন?

আল আমিন: আমি ইউটিউব বা নিউজে দেশ-বিদেশের খবর দেখি, ট্রেন্ড জানি। এরপর নিজের দিনের প্ল্যান সাজাই। আমার জন্য প্রতিটি দিন নতুন এক সুযোগ।

হাল ফ্যাশন: সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কার কাছ থেকে পেয়েছেন?

আল আমিন: আমার মা-বাবা এবং কিছু চমৎকার বস, যাঁরা আমাকে শুধু কাজ নয়, জীবন সম্পর্কে বোঝাতে সাহায্য করেছেন।

হাল ফ্যাশন: আপনার কাছে ‘সাকসেস’ মানে কী?

কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সংমিশ্রণ চান তিনি
কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সংমিশ্রণ চান তিনি

আল আমিন: সাফল্য মানে পদবি নয়, প্রভাব। এমন কিছু করা, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে, সেটাই প্রকৃত সাফল্য। আমি কঠোর পরিশ্রম করি, তবে তা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করি। পারিবারিক মূল্যবোধ এবং মধ্যবিত্ত জীবনধারা বজায় রাখি। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সক্রিয় নই, তবে দেশের ও কমিউনিটির উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই। আমার জীবনের মূল লক্ষ্য হলো অর্থ নয়, বরং সন্তুষ্টি, শিক্ষা এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। আমি চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে যাবে।

হাল ফ্যাশন: আগামী দিনে কী করতে চান? পরিকল্পনা কী?

আল আমিন: আমি চাই একসময় প্রপার্টির বাইরে, রিজিওনাল বা গ্লোবাল লেভেলে কাজ করতে, যেখানে আমি শুধু একটি হোটেল নয়, একটি দেশ বা অঞ্চলের হসপিটালিটি ডেভেলপমেন্টে ভূমিকা রাখতে পারব।

হাল ফ্যাশন: তরুণদের জন্য কোন বার্তা?

হাল ফ্যাশনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে রেনেসন্স ঢাকা গুলশান হোটেলের বাংলাদেশি জেনারেল ম্যানেজারের মো. আল আমিনকে
হাল ফ্যাশনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে রেনেসন্স ঢাকা গুলশান হোটেলের বাংলাদেশি জেনারেল ম্যানেজারের মো. আল আমিনকে

আল আমিন: অনেকেই ভাবে, হোটেল ইন্ডাস্ট্রি শুধু সার্ভিসের কাজ। আসলে এটি মানুষের সঙ্গে কাজ করার সবচেয়ে সুন্দর পেশা। এখানে আপনি প্রতিদিন নতুন অভিজ্ঞতা পাবেন। তাই আমি বলব, স্মার্ট ওয়ার্ক নয়, ওয়ার্ক স্মার্টলি। ধৈর্য রাখুন, ফল আসবেই।

হাল ফ্যাশন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়া জন্য।

আল আমিন: ধন্যবাদ আপনাদেরও।

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন