স্থাপত্য আসলে রান্নার মতো, যেখানে উপকরণগুলো একদম পরিমাণমতো হতে হয়: মেরিনা তাবাশ্যুম
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মুনির হাসান: আপনি ঢাকায় বড় হয়েছেন। তখন ঢাকা নিশ্চয়ই খোলামেলা ছিল। আপনি কিন্তু আর দশজনের মতো চিন্তা করছেন না। আপনি স্থাপনা করার সময় একদম মৌলিক প্রশ্নে যেতে চাচ্ছেন। একটা মৌলিক প্রশ্ন করার যে প্রবণতা, এই ইচ্ছা আপনার মধ্যে কীভাবে তৈরি হয়েছে? এটা কি আপনার ছোটবেলার পরিবেশের জন্য, এটা কি আপনার পরিবারগত কারণে, নাকি এটা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তেন, তখনকার কোনো কারণ?

মেরিনা তাবাশ্যুম: ছোটবেলা থেকে বড় হওয়ার সময় স্থাপত্য নিয়ে যে খুব চিন্তা করেছি, তা বলব না। স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা হলো উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর। উচ্চমাধ্যমিকে আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। কেন হয়নি, আমি জানি না। কারণ, ছাত্রী হিসেবে আমি খুব একটা খারাপ ছিলাম না। আমার পরিবার মানে আমার বাবারা ৯ ভাইবোন এবং প্রত্যেকে তাঁরা হয় ডাক্তার, অন্যথায় প্রকৌশলী। বস্তুত আমার চাচাতো ভাইবোনদেরও কেউ হয়তো ডাক্তার না হয় প্রকৌশলী। এ জন্য আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমাকে ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী হতে হবে এবং দুইটার কোনোটাতে যে আমার খুব ইচ্ছা ছিল, তা অবশ্য না। তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আমার বাবা আমাকে বলল, ‘তুমি স্থাপত্যবিদ্যা চেষ্টা করে দেখতে পারো।’ তখনই আসলে আমার স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। দেখলাম, খুব মজার একটা জিনিস। পড়াশোনা কম, বরং নিজের ভেতর থেকে বের করতে হয় বেশি। যার মানে হলো আপনি নিজেই একটা প্রোডাকশন হাউস বা কারখানা। আর কারখানা তো কাঁচামাল ছাড়া চলে না। তাই নিজেকে অনেকটা জ্ঞান–গরিমায় পরিণত করতে হয়। আমাদের বাসায় ছোটবেলায় টিনের চাল ছিল। একদিন দেখলাম, টিনের চাল সরিয়ে ফেলা হলো এবং ওপর থেকে আলো আসা শুরু করল। মূলত এই কারণে হয়তো আমার স্থাপত্যে ওপর থেকে আলো আসে। আলোর প্রতি যে আমার আসক্তি, এইটা বলতে পারেন আমার ছোটবেলা থেকেই এসেছে। আবার আমার কাছে মনে হয়, একটা বাড়ির আঙিনা হলো সেই বাড়ির আত্মা। যেমনটা আপনি গ্রামের বাড়িগুলোতে দেখতে পাবেন। আমাদের ঢাকাতেও কিন্তু ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, বাড়ির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস ছিল উঠান। তবে এই জায়গাগুলো এখন আর দেখা যায় না। দ্রুত নগরায়ণের ফলে এখন আস্তে আস্তে এই ব্যাপারগুলো চলে যাচ্ছে, যেগুলো আসলে আমাদের সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করে। আমার কাছে মনে হয়, এটা কোনো আর্থিক বা সামাজিক নয়, বরং আত্মিক বা মানসিক শান্তির বার্তা আনে।
স্থাপত্যবিদেরা আসলে কোনো বিষয়ে এক্সপার্ট না, আবার সকল বিষয় নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়। আমি একজন প্রকৌশলী, আমি একজন কবি, আমি একজন চিত্রশিল্পী, আমি একজন মনোবিজ্ঞানী, আমি একজন অর্থনীতিবিদ, আমি একজন দার্শনিক—তো অনেকগুলো দায়িত্ব নিয়েই কিন্তু আমাকে স্থপতি হতে হয়েছে। আপনি যদি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কাজ করতে চান, তাহলে প্রতিটা জিনিস নিয়েই চিন্তা করতে হবে। ওটা আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় স্থাপনার ব্যাপারে।

মুনির হাসান: এই যে আপনার চিন্তার পদ্ধতি, আপনি যে একটা মৌলিক প্রশ্ন করতে পারেন বা আপনার ডিজাইনে আমরা যে জিনিসগুলো দেখতে পাই, সেটা কীভাবে এসেছে?

মেরিনা তাবাশ্যুম: এটা কিছুটা বলতে পারেন সাধনার ব্যাপার। স্কুলে যে শেখানো হয়েছে, তা নয়; তবে অনেক স্থপতির কাজ দেখে অনুপ্রেরণা তো পেয়েছি। উদাহরণস্বরূপ মাজহারুল স্যার আমাদের বাংলাদেশের প্রথম স্থপতি। আসলে এই ব্যাপারগুলো সাধারণত স্কুলে শেখানোর নয়, বরং নিজের একটা সাধনা এবং সেখান থেকেই আজ এই পর্যন্ত এসেছি। আমি মনে করি, যেকোনো ক্রিয়েটিভ ফিল্ডে আসলে সাধনার প্রয়োজন আছে। স্থপতিদের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, মৌলিকতা, ভিন্নতা নকশায় থাকলে আপনাকে তা সাধনার দিক থেকে এগিয়ে রাখবে।

বিজ্ঞাপন

মুনির হাসান: আমি আপনার জামিল পুরস্কার পাওয়ার পর একটা ইন্টারভিউ পড়েছি। আপনি বলেছেন, স্থাপত্য আসলে রান্নার মতো, যেখানে উপকরণগুলো একদম পরিমাণমতো হতে হয়। এরপর আমি বাইতুল রউফ তো দেখে এলাম, যেখানে আপনি লাল ইট ব্যবহার করেছেন। আস্তর পরতে দেননি, অর্থাৎ সেখানে রং করার চেয়ে ধোয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে হয়তো সামাজিক ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হবে, এ রকম আমার মনে হয়েছে। এরপর আপনি স্বাধীনতাস্তম্ভে বিশেষভাবে কাচ ব্যবহার করেছেন। আপনার যে কাজটা নিয়ে খুব বেশি আলাপ হয় না, সেটা হলো যশোরের পানিগ্রাম অঞ্চলের। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের ঘর মাটির ছিল। মাটির দেয়াল আর ওপরে টিন ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে, শুধু নকশা নয়, বরং কোন উপাদান ব্যবহার করবেন, সেটাও আপনি স্থানীয়ভাবে চিন্তা করেন। আপনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে আপনি কোন উপাদান ব্যবহার করবেন আপনার স্থাপত্যে? যখন আপনি একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু করেন, তখন কোন তিনটা জিনিসকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: প্রথমত, কোথায় বানাচ্ছি, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোথায় যখন বলব, তখন অনেকগুলো প্রশ্ন চলে আসে। সেটার মধ্যে যেখানে বানাচ্ছি, তার ভৌগোলিক গঠন, তার আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিকতা, সংস্কৃতি, সেখানকার ব্যবহারযোগ্য উপাদান—এই সবকিছু মিলিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আসে। তারপর যে প্রশ্নটা আসে, সেটা হলো, কী বানাতে চাচ্ছি? তার মানে হলো প্রয়োজনগুলো কী, কার্যক্রমগুলো কী? উপাদানের ব্যাপারটা আসে দ্বিতীয় প্রশ্ন হিসেবে। তখন আমি যে ডিজাইন নিয়ে আগাতে চাচ্ছি, তার জন্য যে উপাদান উপযোগী হবে, সেই উপাদান নিয়ে ভাবব তখন। ধরেন মসজিদ বানালাম, তখন আমার গবেষণা থেকে উঠে এল, আমি মসজিদের আর্কিটেকচারকে যেকোনোভাবে সুলতানের আমলের মসজিদের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে চাই। কিন্তু সেই ধরনের উপাদান আমাদের দেশে খুব একটা তৈরি হয় না, তাই তখন উপাদান হিসেবে লাল ইট ব্যবহার করা। আর যেটা বললেন, আস্তর দিয়ে ঢাকা নেই। এর আসলে কয়েকটা কারণ রয়েছে। প্রথমত, একটা অপ্রয়োজনীয় খরচ যুক্ত করতে চাইনি। দ্বিতীয়ত, তৈরির সময় খরচ ও মেইনটেন্যান্স খরচের অঙ্ক কমে যায় এবং খুব সহজ হয়ে যায়, যেমন বছরে বছরে যে রং করা লাগে, বৃষ্টির মৌসুমে যে শেওলা ধরে যায়, সেটা থাকে না। আর স্বাধীনতাস্তম্ভের উপাদানের কথা যে বললেন, আসলে স্বাধীনতা স্তম্ভের উপাদান কিন্তু গ্লাস না। সেটা আসলে আলো। আলো যেহেতু সবচেয়ে বেশি কাচ ধারণ করতে পারে, সেই হিসেবে গ্লাসের ব্যবহার। আপনি জানেন, কাচের বেশ ভালো একটা গুণ রয়েছে, যা আলোর প্রতিফলন ঘটায় আর মূলত এই জন্য কাচ ব্যবহার করা। আর পানিদাহ রিসোর্টের কথা যেহেতু বললেন, আসলে পানিদাহ রিসোর্ট হলো যশোর ও ঝিনাইদহের মাঝামাঝি একটা জায়গায়, কপোতাক্ষ নদের ধারে একটা জায়গা। ওই জায়গা একদম আমাদের গ্রামবাংলার চিত্র যেন বহন করে, এখনো গরুর গাড়ি চলে। আমরা বাংলাদেশে যে সবজি খাই, তার অধিকাংশ ওই জায়গা থেকে কিন্তু আসছে। পানিদাহ রিসোর্টের আশপাশে যে গ্রামগুলো আছে, সেখানে প্রায় সবাই মাটির বাড়িতেই থাকে। যখন আমরা জায়গাটা পছন্দ করলাম রিসোর্টের জন্য, তখন আমাদের তরফ থেকে এবং ক্লায়েন্টের তরফ থেকে একটা চাওয়া ছিল যে রিসোর্টটা পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব হবে। এ জন্য তখন হুট করে কিছু না করে চিন্তাভাবনা করে এমন একটা কিছু তৈরি করা, যাকে হয়তো সেভাবে স্থাপত্য বলা যায় না। তবে এসব কারণেই গ্রামবাংলার সঙ্গে মিল রেখে মাটি ও বাঁশের ব্যবহার। যেহেতু আমি মাটি ও বাঁশ নিয়ে কখনো এর আগে কাজ করিনি, তাই অনেকটাই গ্রামের মানুষের সাহায্য নিতে হয়েছে। আমরা যখন মাটির বাড়ি নিয়ে গ্রামের মানুষকে প্রশ্ন করতাম, এটা কীভাবে বানায়, মাটির সঙ্গে কী মেশানো হয়? তখন সবার একটা প্রশ্ন ছিল, এটা কেন জানতে চাচ্ছি? এটা তো আসলে গরিব মানুষের বাড়ি। আসলে মাটির ঘর গরিবের ঘর, এটা প্রচলিত হয়ে আসছে এবং যার একটু পয়সা হয়, সে ইটের বাড়ি বানাতে চায় গ্রামে। মাটির ঘরের যে একটা গর্ব, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমি যদি মাটি দিয়ে রিসোর্ট তৈরি করি এবং মানুষ যদি পয়সা দিয়ে মাটির বাড়িতে আসে থাকতে, তাহলে এটা হয়তো গ্রামের মানুষের মাঝে একটা গর্বের ব্যাপার সৃষ্টি করবে। এটাও মাথায় ছিল যে কীভাবে সেই গর্বের জায়গা মানুষের মাঝে আবার কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। তারপর তৃতীয় প্রশ্ন, কার জন্য ও কীভাবে? তো এই কীভাবে বানাব, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

মুনির হাসান: আমি সেই পানিগ্রামের কথায় আসি। আমরা পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখলাম যে আপনারা পানিগ্রামে সাধারণ মানুষের কাছে থেকে শিখেছেন, তা নয়, বরং তাদের চুলাগুলোকে কীভাবে আরেকটু সুন্দর ও উপযোগী করা যায়, সে বিষয়ে তাদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু আপনি গিয়েছেন একটা স্থাপত্যশিল্পের প্রজেক্টে। আপনারা এই সময়গুলো কীভাবে ম্যানেজ করেন? এতে কি আপনাদের নিজের সময় নষ্ট হয় না? যেমন আমরা যখন একটা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধও বানাই, আমরা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলি না। আমাদের একটা বোল্ডার ফেলতে হবে এবং এ রকম যা যা করতে হবে, সেগুলো আমরা ধুমধাম করেও ফেলি। কিন্তু আপনার বেলায় দেখলাম একটু ভিন্ন। আপনি শুধু শিখছেন না, বরং সাহায্যও করছেন। আপনার কি এগুলোকে সময় নষ্ট মনে হয় না?

মেরিনা তাবাশ্যুম: দেখেন, আপনিও বুয়েটে পড়েছেন এবং আমিও বুয়েটে পড়েছি। আমরা প্রায় বিনা পয়সায় পড়েছি এবং এর সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু একটা দায়িত্ববোধ চলেই আসে যে আমাদের এবার দেশকে কিছু দিতে হবে। আমরা যারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছি, তারা মনে হয়, সারা জীবনের জন্য ঋণী হয়ে যাই এবং দেশ আশা করে আমাদের কাছ থেকে দেশ কিছু পাবে। আমি এই কাজগুলো ওই তাগিদে আসলে করি। এখন অবধি আমাদের দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ আর্কিটেকচারের খরচ বহন করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ আমাদের কাছে আসতে পারছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের আরও বেশি মানুষের কাছে যাওয়া উচিত ওই তাগিদ থেকেই। এই জন্য আমি সময় দিই এবং শুধু আমি না, আমার অফিসের সবাই দেয় আসলে। আমি দেখি, আমাদের তরুণ প্রজন্মের অনেক স্থাপত্যবিদ ওই তাগিদ আসলে অনুভব করে এবং এভাবে সময় দেয়। আমার যা জ্ঞান আছে, তার একটু দিলে হয়তো অনেকের থাকার জায়গাটা আরেকটু সুন্দর হতে পারে। তাই আমার মনে হয়, এই জ্ঞানটুকু ধরে রাখা তো একধরনের ক্রাইম।

মুনির হাসান: আপনাকে ধন্যবাদ

মেরিনা তাবাশ্যুম: আপনাকেও ধন্যবাদ

বিজ্ঞাপন
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৬: ০০
বিজ্ঞাপন