আজ বিজয় দিবস। অর্ধশতক পূর্ণ করে আরও এক বছর গড়াল মুক্তিযুদ্ধের। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা। কিন্তু এ বিজয়ের জন্য যুদ্ধ যে শুধু সম্মুখসমরে হয়েছিল, তা নয়। কিছু বিশ্বাসঘাতক ছাড়া দেশের ছোট-বড় প্রত্যেক মানুষই তখন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের জীবনে যুদ্ধের প্রভাব, তাঁদের সবার আত্মত্যাগ আর সেই সঙ্গে নিজেকে ও নিজের চারপাশের সবাইকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা—তাঁদের সে সময়ের স্মৃতিতে অমলিন খাবারের গল্প ছাড়া সে আখ্যান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
কথা হচ্ছিল '৭১ এর কিশোরী সুরঞ্জনা মায়ার সঙ্গে। সেসময়ের দিনযাপনের স্মৃতিকথার মালা গেঁথে একটি অত্যন্ত চমৎকার দুটি বই লিখেছেন তিনি কয়েক বছর আগে। কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ আর।রূপকথা নয়’ নামের এই বই দুটি যুদ্ধদিনের গল্পের এক অন্যরকম দিক তুলে ধরে। তাই তো বইগুলো অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছে হাজারো পাঠকের কাছে। স্মৃতি হাতড়ে বললেন মায়া, 'শীতকালের রোজার দিন। মুক্তিযুদ্ধ তখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে–ছিটিয়ে চলছে। মুক্তিবাহিনী জোরকদমে এগিয়ে যাচ্ছে বিজয়ের পথে। সিলেটে ফুফুর বাড়িতে রেখে আসা হয়েছে মায়াকে তাঁর মা–ভাইসহ। বাবা এসেছেন কর্মস্থল মৌলভীবাজার থেকে।' তাঁঅর গল্প থেকেই জানা গেল, ইফতার খেতে বসে মা বাবাকে বললেন, এ বছর আর নতুন কাপড় লাগবে না ঈদে। চোখ থেকে তখন টপটপ করে পানি পড়ছিল ছোলা-মুড়ি খেতে খেতে, স্পষ্ট মনে আছে মায়ার। সঙ্গে এ–ও ভাবছিলেন, ঈদে কি মা তবে এবার মজার কিছু রাঁধবেন না! ঈদের নতুন জামাকাপড় আর বিশেষ খাবার যে সে বয়সে কতটা আবেগের, তা বোধ হয় সবাই অনুভব করবেন।
গল্প বলতে বলতে স্মৃতিমেদূর হয়ে উঠলেন যেন একাত্তর সালের দুরন্ত কিশোরী ১১ বছরের সুরঞ্জনা মায়া। বললেন, বছর দুয়েকের বড় ভাই কামরুল হাসান, বাবা আর মায়ের সঙ্গে থাকতেন মৌলভীবাজারে। বাবা আবু হেনা বাজলুল বাসিত ছিলেন হাবিব ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখার ম্যানেজার। যুদ্ধ শুরু হতেই দিন বদলে গেল। জীবনটা শুধু ভয় আর নিরানন্দে ভরা।
স্মৃতিকথনের ধারাবাহিকতায় জানা গেল, দুষ্টু মেয়ে মায়া যেন এদিক–ওদিক বেরিয়ে বিপদে না পড়েন, মা তাই সদর দরজায় দিলেন তালা। ভিস্তিওয়ালারা পানি ঢালতেন চৌবাচ্চায় গরাদবিহীন জানালা দিয়ে। শুধুই ডাল–ভাত আর আশপাশে জন্মানো গুচ্ছের পেঁপেগাছের পেঁপের ভাজি-তরকারি খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন সেই জানালা গলে মায়া বেরিয়ে পড়লেন পুকুরের কচুরিপানার নিচে কই মাছ আছে কি না, সে রহস্য উদ্ঘাটনে।
মায়া বললেন, তিনি তখন পুকুরে নামতেই দেখেন, উর্দুতে কথা বলতে বলতে দুজন আসছেন। বুদ্ধি করে পুকুরে ডুব দিয়ে নাক ভাসিয়ে নিশ্বাস নিতে নিতে যখন দেখলেন, লোক দুটি তাঁরই ডিম দেওয়া পোষা হলদে মুরগিটা বগলদাবা করে নিয়ে চলে গেলেন, তখন তাঁর মন ভাঙার খান খান শব্দ তিনি ছাড়া আর কেউ শোনেননি। ভেজা গায়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফেরার সময় মায়া ভাবছিলেন, এবার ভাতের পাতের ডিমটুকুও গেল। যুদ্ধের সময় মাসের পর মাস এমন করে সব পরিবারেই চলেছে খাবারের কষ্ট। এ–ও যুদ্ধেরই অবিচ্ছেদ্য চিত্র। মায়ার এই গল্প যেন প্রতিটি ঘরেরই চিত্র ছিল সেসময়।
একটু হেসেই বললেন এই সুলেখিকা, আশপাশে জন্মানো পেঁপেগাছগুলোর ওপরে মাঝেমধ্যে বেজায় রাগ হতো মায়ার। এবেলা-ওবেলার খাবারে তো বটেই, শবেবরাতে হালুয়ার বায়না করাতে মা সেই পেঁপে দিয়েই কিনা হালুয়া বানিয়ে দিলেন। মাস গড়িয়ে ঈদের দিন এল। ঘরে ছিল মসুরের ডাল আর কিছু পোলাওয়ের চাল। তাই দিয়ে মা করলেন প্রায় বিনা তেলে ঝরঝরে সাদা খিচুড়ি। আর সঙ্গে পরম আরাধ্য মুরগির মাংসের ঝোল। সঙ্গে আবার সেই পেঁপে।
গল্প যেন ফুরায় না। মায়া বললেন, প্রতি বছর কত কিছুই না রান্না করতেন মায়ার মা ঈদের দিন। কিন্তু সেদিনের সেই আড়ম্বরহীন ঈদের ভোজ মায়া কোনো দিন ভুলতে পারবেন না। একে তো বহুদিন পর মাংস খাওয়া। আর তার ওপর বাবা নিরাপদে কর্মস্থল থেকে পালিয়ে ঈদের আগে আগেই চলে আসায় ঈদের সেই সাদামাটা ভোজে সোনায় সোহাগা যোগ হয়েছিল অফুরন্ত।
সুলেখিকা সুরঞ্জনা মায়ার গল্পের মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে। এ এক বিশাল অবদান। এই স্মিতহাস্য সুলেখিকা থাকেন সিলেটেই। রন্ধনশিল্পে রয়েছে তাঁর বিশেষ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান। অন্তর্জালে খাদ্যসংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন বহুদিন ধরে।
ছবি’: সুরঞ্জনা মায়া ও পারভীন আলী