মায়ের সঙ্গে ছোটবেলায় বেড়ে ওঠা?
আমার মা ছিলেন একটু অগোছালো মানুষ আর আমার বাবা ছিলেন ভবঘুরে। আমাদের ছোটবেলা কেটেছে একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশে। মা ছায়ানটে ছিলেন, তাই ছোটবেলা থেকেই আমি ছায়ানটে যেতাম নাচ শিখতে। মা বিয়ে–সংসার সব মিলিয়ে নাচ করতে পারেননি, তার ইচ্ছা পূরণ করতেই নাচ শিখেছি। ছোটবেলায় আমাদের ঘুম ভাঙত হেমন্ত-মান্নাদে-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শুনে। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছি। আমার ইচ্ছাই ছিল তারকা হব, কিছু একটা করব যাতে মানুষ আমাকে চেনে। সেখান থেকেই পড়াশোনার সঙ্গে নাচ, পরে অভিনয়ে আগ্রহ। সম বয়সী বন্ধুদের দেখেছি কেবল পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকতে। আমি পড়ার সঙ্গে অনেক কিছুই শিখেছি আমার মায়ের আগ্রহ আর আমার ইচ্ছায়। মা এক হাতে সংসার সামলাচ্ছেন, আরেক হাতে আমাদের। আমাদের সুশিক্ষিত আর মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা তাঁরই শেখানো। সেভাবেই বড় হয়েছি আমরা।
মাতৃত্বের অনুভূতি?
আমার ছেলের জন্ম হয়েছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আমার বিয়ে হয় একটু কম বয়সে। শুরু থেকেই আমি চাইতাম মা হতে। কিন্তু আমার স্বামী সেটা চাইতেন না। একদম বিবাহবিচ্ছেদের আগে এসে আমরা সন্তান নিই। কিন্তু সেটা ছিল আসলে মানসিকভাবে আমাকে বিপর্যস্ত করবার একটি কৌশল। এ জন্য আমার ছেলের সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব ছিল শুরুতে। সন্তান জন্ম দেবার তিন সপ্তাহের মধ্যেই আমাকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে বা আমি বাধ্য হয়েছি কাজ করতে। দেশের বাইরে অ্যাওয়ার্ড শোতে অংশগ্রহণ করেছি, ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার এনেছি; কিন্তু এই মানসিক দূরত্ব কুরে খাচ্ছিল আমাকে। তবে এতে যেটা হলো, বহুদিন ধরে যে সিদ্ধান্তহীনতায় আমি ভুগছিলাম, তা নিতে পারলাম। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে ফিরে গেলাম আমার মা-বাবার পরিবারে। ৯-১০ বছর পর ফিরে গিয়ে একটু সময় লেগেছে কিন্তু তাদের সহযোগিতায় মানিয়ে নিয়েছি। মার সঙ্গে আমার মনমালিন্যের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করেছে আমার ছেলে। সে সবকিছু ঠিক করেছে। আমার ছেলে আসলে আমাকে মা বানিয়েছে। সে ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে। একসময় সে তার নানা–নানুর মাঝে ঘুমাত, ধীরে ধীরে আমার অবসাদের জায়গা সে দূর করেছে। সে আসলে আমাকে মা হবার আনন্দ আর মাতৃত্বের আস্বাদন দিয়েছে। আমি এখন পৃথিবীতে আমার ছেলেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। সে আমার সব হাসি–আনন্দের উৎস। যা কিছু করি, ওর জন্য করি। আমি সবকিছুর ইতিবাচকতা পাই আমার ছেলের কাছ থেকে।
আপনি একজন ইয়োগা প্রশিক্ষক ও মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করছেন; ওয়ার্কিং মাদারদের প্রতিবন্ধকতা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কি কিছু বলবেন?
আসলে মাতৃত্ব ব্যাপারটা নারীদের জন্মগত। আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু কেউ বলে দেয় না, মেয়েরা হাঁড়ি–পাতিল নিয়ে খেলবে, কিন্তু আমরা খেলি, ঘরের ছোটখাটো কাজ করি। একটা মেয়েকে আসলে মানুষ হিসেবে বাড়তে দিতে সমাজের প্রতিবন্ধকতা খুব বেশি কাজ করে। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, বাবা অফিস থেকে এসে ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে দিতেন, থালা–বাসন ধুয়ে ফেলতেন—এটাকে তিনি স্বাভাবিক মনে করতেন। কেবল বাড়ির মেয়েরা এই কাজ করবে, তেমনটা নয়। আমি খুবই ভাগ্যবান যে এমন পরিবারে বড় হয়েছি, যেখানে ছেলে–মেয়েতে বিভেদ করতে শেখানো হয়নি। আমি ও আমার ভাই একইভাবে বড় হয়েছি। আমার ছেলেকেও তেমনভাবেই শেখাচ্ছি, যেন সে একজন মানুষকে নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখে। মানসিক জায়গাটা শক্ত করতেই কাউন্সেলিং করি ছোটবেলা থেকে। মা হওয়া পর্যন্ত একটা মেয়েকে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করে আসতে হয়। পূর্ণ বয়সে এসে সে ভেতর থেকে ভেঙে যায়। সেই জায়গায় থেকে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের মানসিকভাবে ঠিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর ইয়োগা প্রশান্তি দেয়, ভালো থাকা যায় আত্মিকভাবে। তাই নিজে যা শিখেছি, অন্যদেরও তা শেখাই। কর্মজীবী মায়েদের মনোবল শক্ত থাকা খুব দরকার।
একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মায়ের ভূমিকা ও মা দিবস নিয়ে যদি কিছু বলতেন...
নারী দিবসেই আসলে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ দেখা যায়, যেমন নারী দ্য বস, নারীবাদী, পুরুষতান্ত্রিক—এই শব্দগুলো একটা ছোট ছেলে বা মেয়ের মনে অনেক প্রভাব ফেলে। নারীকে নারী হিসেবে বেড়ে উঠতে দাও বা পুরুষকে পুরুষ। এই বিভাজন যেন ওদের মাথায় না ঢোকে। স্কুল শুধু পড়ালেখা শেখায়, কিন্তু ব্যবহার, শিষ্টাচার আসে পরিবার থেকে; মা–বাবা, দাদা-দাদি—যাঁদের কাছে বড় হয়, তাঁদের থেকে। গুড প্যারেন্টিং আসলে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই ভাবেন, সারা জীবন একা থাকবেন; সেটা সম্ভব না। কারণ, প্রকৃতি আমাদের ওভাবে সৃষ্টি করেনি। একটা নিদিষ্ট বয়সে এসে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আমাদের আকর্ষণ আসবে, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। বয়ঃসন্ধিতে শারীরিক পরিবর্তন, মেয়েদের ঋতুচক্র—এগুলো স্বাভাবিক বিষয় আগে থেকে ছেলেমেয়েরা জানলে তারা এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। তাই গুড প্যারেন্টিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। সব মায়েদের, অভিভাবকদের কাছে আবেদন—কেবল মা দিবস বলে নয়, সন্তানের সুস্থভাবে গড়ে ওঠায় ইতিবাচক কাজগুলো করুন, যাতে সে সমাজে একজন ভালো মানুষ হিসেবে ভালো কাজের জন্য ভূমিকা রাখতে পারে।