আনিকার কুকিং ব্লগ ‘কিচেন গ্যাদারিং’-এর রেসিপিগুলোয় শুধু রান্নার ধাপ নয়, উঠে আসে বাংলাদেশি স্বাদের ঐতিহ্য আর পারিবারিক গল্প। তাঁর কাছে রান্না মানে শুধু স্বাদ নয়, তাতে মিশে থাকে আত্মপরিচয়, স্মৃতি আর শিকড়ের টান। এই ভাবনা, তাঁর প্রবাসের গল্প আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আনিকা চৌধুরীর সঙ্গে হয়েছে একান্ত আলাপচারিতা।
আনিকা চৌধুরী একজন স্বপ্নময়, আবেগপ্রবণ ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ। তাঁর শিকড় রয়েছে আশির দশকের ঢাকায়; যৌথ পরিবারের কোলাহল ও বাংলাদেশি আবহে। ঢাকায় জন্ম আনিকার। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়। প্রচণ্ড মেধাবী আনিকার শিক্ষাজীবন শুরু ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সানবিমসে। এরপর স্কলাস্টিকা ও ম্যাপল লিফ এবং পরবর্তী সময়ে শতভাগ স্কলারশিপ নিয়ে সোজা যুক্তরাষ্ট্রে।
তাঁর শৈশবের কিছুটা সময় কেটেছে চট্টগ্রামে আর বাকিটা ঢাকায়। আনিকার ভাষায়, ‘আমাদের নানুবাড়ি ছিল আমাদের বাসার পাশে। আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়ায় সারাক্ষণ গমগম করত বাসা। রোজ গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ না কেউ আসতেন। আর এলেই হতো রান্নাবান্না।’
আনিকার নানা ডা. জিন্নুর আহমেদ চৌধুরী, ছিলেন একজন নামকরা নাক–কান–গলা বিশেষজ্ঞ। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফআরসিএস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চিকিৎসক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। আনিকার মা জারিনা চৌধুরী তাঁর বড় মেয়ে। মাত্র তিন বছর বয়সে নানাকে হারালেও, সেই প্রভাবিত শৈশব আজও তাঁর স্মৃতিতে ভাসে।
রাজশাহীর নানাবাড়ি ও সিলেটের দাদাবাড়ি মিলে তিনি বড় হয়েছেন এক প্রাণবন্ত যৌথ পরিবারে। আনিকার বেড়ে ওঠার পরিবেশ ছিল মুক্ত ও উদার। নানি থেকে শুরু করে মা–বাবা, সবাই ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ। আর এই মুক্ত পরিবেশেই গড়ে উঠেছেন আনিকা।
আশি ও নব্বইয়ের দশকের ঢাকার গল্প বলতেই আনিকার চোখেমুখে ফুটে ওঠে উচ্ছ্বাস। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার রীতি ছিল বাড়িতে। ‘যুক্তরাষ্ট্রে সারা বছর একই সবজি পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে একেক মৌসুমে একেক রকম খাবার, মাছ, সবজি পাওয়া যায়, এই বৈচিত্র্যই আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিকে বিশেষ করে তোলে’, বললেন আনিকা।
বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি, ভর্তা আর ইলিশ খাওয়ার স্মৃতি এখনো তাঁর কাছে অমলিন। বাবা যখন বাজারে যেতেন, আনিকা বলতেন, ‘আমার জন্য লাল শাক নিয়ে এসো!’ এই ছোট ছোট ভালোবাসার গল্পেই গড়া আনিকার ব্যক্তিত্ব।
এই শিকড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের রান্নার ব্লগ কিচেন গ্যাদারিং। আনিকা বলেন, ‘অনেকেই রেসিপি করছে, কিন্তু সব রান্না একই রকম পোলাও, রোস্ট, কোরমা। এগুলো আসলে আমাদের বাংলাদেশের অথেনটিক রান্না নয়।’
তাঁর কাছে মনে হয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও পারিবারিক রন্ধনশৈলী সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। তাই তাঁর ব্লগে জায়গা পায় দাদি, নানি, মা–বাবার শেখানো রান্না, যেগুলোতে লুকিয়ে আছে তাঁর শিকড়ের আসল স্বাদ।
নিউইয়র্কে বসবাস করলেও আনিকা চৌধুরী আজও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে আছেন নিজের শিকড়কে। তাঁদের এলাকায় একটি কমিউনিটি গার্ডেন আছে, যেখানে অবসরে হাঁটেন, বসে থাকেন সবুজের মধ্যে। সেই গার্ডেনের একটি ছোট প্লটে তিনি নিজেই লাল শাক চাষ করেন।
আনিকার ভাষায়, ‘আমি লাল শাক খুব মিস করতাম, তাই নিজের হাতে চাষ শুরু করেছি।’
নিজের শিকড় নিয়ে গর্বের সঙ্গেই বলেন মা–বাবার গল্প। আনিকার ভাষায়, ‘বাবা ছিলেন করপোরেট দুনিয়ার একজন সফল মানুষ, কিন্তু অত্যন্ত সৎ ও বিনয়ী। আমরা ছোটবেলায় কোনো ভুল করলে তিনি রাগ করতেন না, বরং বুঝিয়ে বলতেন। আর মা ছিলেন আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।’
জানালেন, ‘মা–বাবা দুজনেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা, আদর্শ ও জীবনদর্শনই আজ আমার পাথেয়।’
মা–বাবা যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে এলে, তাঁদের কাছ থেকে বহু রান্না শিখে নিয়েছিলেন। সেসব তিনি নোটবুকে লিখে রেখেছিলেন। তাঁর নানিও ডায়রিতে রান্না লিখে রাখতেন, সেই পুরোনো রান্নার রেসিপি নিজে প্রায়ই করেন বলে জানালেন আনিকা।
মায়ের হাতের ঝটপট রান্না—ডাল, সবজি, ভাজি, ভর্তা, পুডিং কিংবা ডিমের হালুয়া সবই ছিল সহজ, কিন্তু অতুলনীয় স্বাদের। আর ইলিশ পাতুরি ছিল মায়ের একটি বিশেষ রেসিপি। ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে আনিকা বলেন, ‘আমরা ভাইবোন মিলে পাতুরির ইলিশের কাঁটা বাছতাম, সেই মুহূর্তগুলো খুব সুন্দর ছিল।’
বাবা আবদুল মুনিম চৌধুরী অসাধারণ মুরগির কারি রান্না করতেন। সেই রেসিপি কিচেন গ্যাদারিং ব্লগে আছে বাবার নামেই। আনিকা বলেন, ' প্রতিটা খাবারের সৌরভ আমাদের কোনো না কোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।’
‘দ্য গ্রেট আমেরিকান রেসিপি’র প্রথম পর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে আনিকার ফুচকার রেসিপি বিজয়ী হয়, যা তাঁকে আত্মবিশ্বাস দেয় যে দেশের খাবারও আন্তর্জাতিক পরিসরে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরা সম্ভব।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রান্নার ভিডিও কনটেন্ট নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণও বাস্তবধর্মী। আনিকা বলেন, ‘এখন অনেকেই ভিডিওতে রান্না শেয়ার করেন, কিন্তু দেখা যায় মসলা ওপর থেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা দেখতে ভালো লাগলেও রন্ধনপ্রক্রিয়ার মূল জায়গাগুলো ঠিক না থাকলে খাবারের আসল স্বাদ পাওয়া যায় না। এতে মানুষ ভুল ধারণা পায় যে এভাবে রান্না করলেই হয়। অথচ, আমার মা ও নানি হাতে রেসিপি লিখে রাখতেন। আমি সেগুলো দেখেই রান্না শিখেছি।’
আনিকা জানান, মা–বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। সন্তান না থাকায় তিনি ভাবতেন এই সুন্দর শেখা, এই গল্পগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে কীভাবে দেওয়া যায়? সেই ভাবনা থেকেই তাঁর ব্লগ কিচেন গ্যাদারিংয়ের শুরু। যেখানে শুধু রেসিপি নয়, আছে রান্নার পেছনের গল্প, ভালোবাসা আর শিকড়ের টান।
‘দ্য গ্রেট আমেরিকান রেসিপি’ সম্পর্কে আনিকা বলেন, ‘এটা একটা অসাধারণ শো। আমার সহপ্রতিযোগীরা আমার বন্ধু আর পরিবারের সদস্যদের মতোই হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তের হোমকুকদের নিয়ে আয়োজিত হয় এই শো। এখানে প্রতিযোগীদের রান্নার সঙ্গে সঙ্গে থাকে তাঁদের শিকড়ের গল্প।’
আনিকা নিজে উত্তর-পূর্ব আমেরিকা থেকে অংশ নিচ্ছেন। আছে ফিলিপিনো, আফগানি, ওহাইও, লুইজিয়ানা, প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের অংশগ্রহণকারীরা। আমেরিকার একেক জায়গার খাবার একেকরকম। আফ্রিকান, মেক্সিকান, আরব কিংবা ভারতীয় খাবারের প্রভাব এখানকার খাবারে স্পষ্ট। সবাই আমেরিকান হলেও সবার নিজস্ব সংস্কৃতি আছে; এই বৈচিত্র্যই এই শোকে এতটা বিশেষ করে তোলে, বললেন তিনি।
গল্পের এক ফাঁকে জানা গেল, আনিকার নানির বংশের দিক থেকে তিনি বিখ্যাত নবাব ফয়জুন্নেছার বংশধর। সেই অভিজাত রুচি ও সৌন্দর্য তাঁর আচরণে প্রকাশ পায়। তাঁর স্বামী চাক লুডিন্সকি একজন আমেরিকান। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশেই দেশীয় রীতিনীতি মেনে।
প্রবাসে থেকেও আনিকার শিকড় ধরে রাখার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার। আনিকা চৌধুরীর মতো মানুষদের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাদ, সংস্কৃতি, এতিহ্য আর গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকবে দেশের সৌরভ নিয়েই।
ছবি: আনিকা ও আনিকার ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল