কালাভুনার প্রেমে মজেছেন ইতালিয়ান শেফ ক্রিস্টিয়ানো মারোসু
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ফেভোলার জনপ্রিয়তা সুবিদিত। এখানেই গত বছর অনুষ্ঠিত হয়েছিল থিমভিত্তিক আয়োজন ইতালিয়ান ব্রাঞ্চ। সেই সাফল্য আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ বছরও ফিরিয়ে আনা হয়েছে সেই আয়োজন। নতুনভাবে, নতুন কলেবরে। দায়িত্বে আছেন গতবারের মতোই শেফ ক্রিস্টিয়ানো। সূচনাদিনেই আলাপ হয় ভোজনরসিক আর হাসিখুশি শেফ ক্রিস্টিয়ানো মারোসুর সঙ্গে।

জেনোয়া শহরের মানুষ শেফ ক্রিস্তিয়ানো
জেনোয়া শহরের মানুষ শেফ ক্রিস্তিয়ানো

জেনোয়া শহরের মানুষ। সেখানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা ক্রিস্টিয়ানোর। তাঁর বাবা বেকার। নিজেদের বেকারি ছিল। দাদু পিৎজা বানাতেন। ফলে তিনিও যে এই পেশায় আসবেন, সেটা একপ্রকার বিধিনির্ধারিতই ছিল। অন্তত তিনি এভাবেই ভাবেন। বাবা কিংবা দাদু ছাড়াও মা–চাচি–খালাদের দেখে রান্নার প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায় সেই ছেলেবেলায়।  পেশাগত জীবনে ইতালি, থাইল্যান্ড, আলজেরিয়া, নেদারল্যান্ডস ও বুলগেরিয়ায় কাজ করেছেন। আগে একবার এসেছিলেন। সেটা করোনার আগে। এরপর বেশ কয়েক বছরের বিরতি দিয়ে পুনরায় আসেন। তা–ও প্রায় দুই বছর হয়ে গেল লো মেরিডিয়েন ঢাকায়। নগরীর ভোজনরসিক অতিথিদের জন্য পরিবেশন করে আসছেন ইতালির আসল স্বাদের ঐতিহ্যবাহী সব পদ।

বিজ্ঞাপন

শেফ ক্রিস্টিয়ানো বলেন, ইতালির খাবার শুধু ভোজন নয়, ইতালির ঐতিহ্য, কল্পনা ও নিখুঁত কৌশলের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। বেড়ে ওঠা একান্নবর্তী পরিবারে; যেখানে খাদ্যসংস্কৃতির আছে আলাদা গুরুত্ব। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে রান্না ছিল উৎসব, ভালোবাসা, ঐক্যের প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলায় উৎসবে পরিবারের সবাই রান্নায় অংশ নিতেন।’ সেই পরিবেশই তাঁকে রন্ধনজগতের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
আজ তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, সেই শিকড়ের টান এখনো তাঁর হাতের ছোঁয়ায় টের পাওয়া যায়। বিশালদেহী ক্রিস্টিয়ানো সহাস্যে বলেন, ‘আমাকে দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, খাওয়া আমার কাছে আনন্দের। আমি খাওয়াতেও ভালোবাসি। রন্ধনকে বলতে পারেন আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য।’

রান্নার প্রতি আগ্রহ জন্মেছে একবারে ছেলেবেলায়
রান্নার প্রতি আগ্রহ জন্মেছে একবারে ছেলেবেলায়

তাসকান খাবারের প্রসঙ্গে বলেন, এই বিশেষ ধরনের রন্ধনশৈলীর বিশেষত্ব হচ্ছে সহজ রন্ধন কৌশল আর চিরায়ত স্বাদের সমন্বয়। তাসকান রান্না মানেই কুকিনা পোভেরা—অর্থাৎ ‘গরিবের রান্না’, যেখানে জটিলতা নয় বরং মৌলিক উপাদান দিয়েই সৃষ্টি হয় স্বর্গীয় স্বাদ। জলপাই তেল, মৌসুমি সবজি, শিম ও মাংস—এই উপকরণ দিয়েই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী স্যুপ, গ্রিলড মিট, পাস্তা আর রুটির নানা পদ।

বিজ্ঞাপন

তাসকান অঞ্চল কেবল খাবারের জন্যই নয়, বরং বিশ্বখ্যাত ওয়াইনের জন্য। এই অঞ্চলের বিখ্যাত ওয়াইনগুলো হলো—চিয়ান্তি, ব্রুনেলো দি মোন্তালচিনো, ভিনো নোবিলে দি মন্তেপুলচিয়ানো। বিভিন্ন খাবারে এসব সুরা তাসকান খাবারের স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেয়, বলছিলেন তিনি।  

আমাদের মানে তাসকানের আহারে রুটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রচলিত একধরনের সাদা, লবণবিহীন রুটি পাওয়া যায়, যা প্রায় প্রতিটি খাবারের সঙ্গেই খাওয়া হয়। এই রুটির জন্ম ষোড়শ শতকে। সেই সময়ে লবণের ওপর ছিল অতিমাত্রায় কর। ফলে লবণ–নির্ভরতা কমাতে লবণ ছাড়া রুটি বানানোর প্রথা শুরু হয়, যা আজও তাসকান খাবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বলছিলেন ক্রিস্টিয়ানো।

তাসকান রন্ধনশৈলীতে আছে নানা ধরনের স্যুপ; যেমন রিবোল্লিতা, গ্রিলড মাংস, ব্রুশেটা, ওল্ড স্টাইল পাস্তা ও হালকা রোস্টেড সবজি; সবই মৌলিক উপকরণ আর সহজ পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। শেফের বয়ানে, এসব খাবার কেবল পেট ভরানোর জন্য নয়, বরং স্বাদকোরককে দিয়ে যায় অনাবিল স্পর্শ যা থাকে দীর্ঘসময়। তাসকান খাবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাদের জন্য জটিলতা নয়, বরং প্রকৃতিকে ঘনিষ্ঠভাবে বোঝা ও সততার সঙ্গে পরিবেশন করাই আসল শিল্প।

ইতালিয়ান খাবারে এলাহী আয়োজনের নেপথ্যে আছেন এই শেফ
ইতালিয়ান খাবারে এলাহী আয়োজনের নেপথ্যে আছেন এই শেফ

এদিন ইতালিয়ান পদগুলো ঘুরে দেখার সময় জমে ওঠে আড্ডা। আসলেই এ কেবল খাদ্য উৎসব নয়; বরং ইতালির বিভিন্ন প্রদেশের স্বাদের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো ছিল। শেফ ক্রিস্টিয়ানোর উদ্যোগে লো মেরিডিয়েনের এই ব্রাঞ্চে পরিচিত হওয়া যায় ইতালির চার শহরের রন্ধনশৈলীর সঙ্গে—পালেরমো স্টাইলের সিসিলিয়ান মাছ, সিফুড রিসোত্তো, ভেনিস স্টাইলের গরুর মাংসের স্ট্রিপ, বেলপেপারসহ মুরগির মাংসের চিকেন স্টু, এগপ্ল্যান্ট পারমিজানের মতো মুখরোচক পদ।

মজার ছলেই বলেন, ‘লো মেরিডিয়েনে অনেক অতিথি এসে বলেন পিৎজার মধ্যে তন্দুরি চিকেন বা অন্য রকম উপাদান দিতে। আমার একটু অদ্ভুত লাগলেও এদেশীয় স্বাদেই আমরা তাঁদের আতিথেয়তা করে থাকি।’

ক্লাসিক পিৎজা বেশিরভাগ অতিথি পছন্দ করেন না; তাই তাদের মতো করে বানিয়ে দিতে হয়
ক্লাসিক পিৎজা বেশিরভাগ অতিথি পছন্দ করেন না; তাই তাদের মতো করে বানিয়ে দিতে হয়

একদম ক্ল্যাসিক ইতালিয়ান পিৎজা তবে কী? এর উত্তরে বললেন, পিৎজার জন্মস্থান হচ্ছে ইতালির ‘নেপলস’। ইতালির ক্ল্যাসিক পিৎজা মূলত এর সতেজ উপাদান, পাতলা মচমচে পিৎজা ক্রাস্ট, সান মারজানো টমেটো, খাঁটি  মোজারেলা চিজ, বেসিলপাতা দিয়ে কাঠের চুল্লিতে তৈরি। তাহলেই মিলবে ক্ল্যাসিক পিৎজার আসল স্বাদ। পিৎজা সংস্কৃতি এখন তো আর কেবল ইতালিতে সীমাবদ্ধ নেই বরং সারা পৃথিবীই এর ফ্যান। ক্রিস্টিয়ানো বলেন, লো মেরিডিয়েনে আজ পরিবেশন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রভিন্সের—ক্ল্যাসিক মার্গারিটা পিৎজা, বিফ প্যাপারোনি পিৎজা, মাশরুম ও ভেজিটেবল পিৎজা।
রিসোত্তো নিয়ে বলতে গিয়ে জানালেন, এটি এসেছে ইতালির পো-ভ্যালি অঞ্চল থেকে, যেখানে জন্ম নেয় এক বিশেষ জাতের ধান। ১৮০৯ সালে রিসোত্তোতে স্যাফরনের সংযোজন এক নতুন মাত্রা এনে দেয়। তিনি বলেন, রিসোত্তোর আসল প্রাণ—মাখন, পেঁয়াজ, হোয়াইট ওয়াইন ও পারমিজান চিজ।

পাস্তা নিয়েও তাঁর ভাবনা স্পষ্ট করলেন। এটা জটিল কিছু নয়। ভালো পাস্তা বানাতে লাগে ভালো মানের অলিভ অয়েল, টমেটো সস, অরিগানো, রসুন আর ভালোবাসার ছোঁয়া। পাস্তা কর্নারে আসার পর শেফ জানালেন, অথেনটিক ইতালিয়ান পাস্তায় বোলোগনিস ও পেস্তো সস ব্যবহার করা হয়।

শেফ ক্রিস্টিয়ানোর নির্দেশনায় তৈরি করা হয়েছে লাইভ পাস্তা ও রিসোত্তো কর্নার
শেফ ক্রিস্টিয়ানোর নির্দেশনায় তৈরি করা হয়েছে লাইভ পাস্তা ও রিসোত্তো কর্নার

খাবারে অপচয় নয়—এই নীতিতেই বিশ্বাসী শেফ ক্রিস্টিয়ানো। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আরানিসিন একধরনের রাইস বল, যা আগের দিনের বেঁচে যাওয়া রিসোত্তো ও চিজ দিয়ে বানানো হয়। দক্ষিণ ইতালির এই পদ আমাদের ব্রাঞ্চের অংশ।
ইতালীয়রা স্যুপ খেতে ভালোবাসে। এর মধ্যে আবার মাশরুম ও টমেটো স্যুপ সবার প্রিয়। সেই দুটি স্যুপ দেখা গেল আয়োজনে ‘জুপা দি ফাঙ্গি’ (মাশরুম স্যুপ) ও মাইনস্তোন দি ভার্দুরি (টমেটো-কিডনি বিন স্যুপ)।

একটু–আধটু বাংলাও শিখেছেন। দেশি শেফদের নির্দেশ দেওয়ার সময় কিছু কিছু বাংলা শব্দ কানে আসে। কথার ফাঁকে জেনে নেওয়াও হলো, বাংলাদেশের তাঁর প্রিয় পদগুলো।  

বিরিয়ানি পছন্দ করেন। তবে বেশি মজেছেন কালাভুনায়
বিরিয়ানি পছন্দ করেন। তবে বেশি মজেছেন কালাভুনায়

বললেন, বিরিয়ানি ভালো লাগে। অনেক বেশি মসলাদার। তবে যেটা শুনে বেশ অবাক হলাম; তা হলো, তাঁর পছন্দের তালিকায় আছে কালাভুনা।
বাংলাদেশের মাছ খেতে ভালো। ইলিশ তো বটেই। প্রশংসাও করলেন ইলিশের; কিন্তু অন্তরায় হলো কাঁটা। কাঁটা বাছার ভয়ে খেতে পারি না।

২০ বছরেরও বেশি সময় পাঁচতারকা রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে কাজ করছেন শেফ ক্রিস্টিয়ানো। তাঁর লক্ষ্য সব সময়ই এক—গুণগত মান বজায় রেখে রান্নার মাধ্যমে অতিথিকে ভিন্নতর অভিজ্ঞতা দেওয়া।

রান্না ক্রিস্তিয়ানোর কাছে নিছক পেশা নয়, আবেগের নাম
রান্না ক্রিস্তিয়ানোর কাছে নিছক পেশা নয়, আবেগের নাম

রান্না আমার কাছে কেবল পেশা নয়—অনন্য আবেগ আর অনবদ্য এক শিল্প। প্রতিটি পদ যেন একেকটি গল্প, যেখানে স্বাদ আর সংস্কৃতি একাকার হয়ে ছুঁয়ে যায় অতিথিকে। এরই মধ্য দিয়ে জানা হয়ে যায় এক শিল্পীর সৃজননৈপুণ্যের গল্প।

ছবি: লো মেরিডিয়েন

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন