ইউকি এর আগেও এসেছিলেন বাংলাদেশে ব্যবসায়িক সফরের অংশ হিসেবে। তবে তখন শিল্প এলাকাগুলোতেই সময় কেটেছে তাঁর।
এবারে আসার আগে ঢাকার জীবনযাত্রা নিয়ে খুব বেশি ধারণা তাই ছিল না, বললেন ইউকি। এর আগে সাংহাইয়ের ব্যস্ত মেট্রোপলিটন জীবন কাটিয়ে আসা ইউকিকে ঢাকার নগরসংস্কৃতিও কম চমৎকৃত করেনি, জানালেন তিনি অকপটে। হাসতে হাসতেই অবতারণা করলেন ট্র্যাফিক জ্যামের প্রসঙ্গের। পৃথিবীর অন্যান্য নগরীর সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে বললেন, ঢাকার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ঘণ্টা দুই লেগে যায়, অথচ দূরত্ব খুব বেশি নয়।
অবশ্য ঢাকা নগরীর অবকাঠামোগত উৎকর্ষের প্রশংসাও করলেন তিনি। এখানকার খাবারের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন বলে জানা গেল কথায়–কথায়। তবে খুব বেশি মসলাদার খাবারে স্বচ্ছন্দ নন ইউকি। বরং পাটিসাপটা পিঠাসহ বেশ কিছু বাংলাদেশি মিষ্টি খাবারে তিনি নিজ দেশ জাপানের ছোঁয়া পান। তাঁর খুব পছন্দও হয়েছে এই খাবারগুলো, বললেন তিনি।
এবারে এল বাংলাদেশে ইউনিক্লোর ব্র্যান্ড আইডেনটিটির প্রসঙ্গ। সারা বিশ্বে ৩০টি দেশে ২০০০টি স্টোরের মাধ্যমে ইউনিক্লো এখন এক আলোচিত বৈশ্বিক ব্র্যান্ড। তবে বাংলাদেশে গ্রামীণ-ইউনিক্লো নামে কেন পরিচালিত হচ্ছে এর কার্যক্রম—এমন প্রশ্নের জবাবে কিয়োকো জানালেন নানা তথ্য। সেই এক দশক আগেই গ্রামীণের সঙ্গে একত্রে কাজ শুরু করে ইউনিক্লো। তখন এটি সামাজিক ব্যবসা হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে এ দেশে।
ইউকির মুখ থেকেই জানা গেল, তখন সুবিধাবঞ্চিত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষদেরই ক্রেতা ধরে এগিয়েছিল গ্রামীণ-ইউনিক্লো; এর উৎপাদনেও তাই ছিল অভিন্ন মনোভাব। পরে অবশ্য সে জায়গা থেকে সরে এসে নগরভিত্তিক বিপণনে আসে গ্রামীণ-ইউনিক্লো। তবে ইউকি বললেন, এ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদেরই ফোকাসে রাখা হয়েছে যেন আন্তর্জাতিক মানসম্মত ফ্যাশনপণ্য শুধু উচ্চবিত্তদের নাগালেই না থেকে যায়। তিনি জানালেন, এখন এখানে তাঁদের ১০টি স্টোর চালু আছে। সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে পোশাক সরবরাহ করা হচ্ছে।
পক্ষান্তরে যেকোনো পোশাকের গ্লোবাল ব্র্যান্ডের পক্ষে অন্যান্য দেশের মতো করে বাংলাদেশে বিপণন কার্যক্রম করাটা তত সহজ নয়, বুঝিয়ে বললেন ইউকি, সে ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে একেকটি পোশাকের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামোসম্পন্ন স্টোর করা, স্টাফ ও ব্যবস্থাপকদের সেই মানে প্রশিক্ষিত করে তোলার মতো বিষয় তো আছেই।
তাঁর মতে, ব্র্যান্ড শুধু পোশাকের লোগো নয়। পোশাকের মান, স্টোরের আবহ, কেনাকাটার পুরো অভিজ্ঞতা আর গ্রাহক সেবা—সব মিলিয়েই একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড কাজ করে। গ্রামীণ ইউনিক্লো সেই মানের সেবা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ব্র্যান্ড হিসেবে গ্রামীণ ইউনিক্লোর বিশেষত্ব প্রসঙ্গে ইউকির ব্যাখ্যা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ফ্যাশনে বিশ্বাসী তারা। মূলত ক্যাজুয়াল পোশাকের ক্ষেত্রেই তারা জোর বেশি দেয়। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের ক্যাজুয়াল, আরামদায়ক পোশাক, বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন ওয়্যারে আন্তর্জাতিক মানের পোশাক এখনো সেভাবে প্রচলিত নয়। আর এই জায়গাতেই নিজেদের বিশেষত্বের ছাপ রাখতে চায় গ্রামীণ-ইউনিক্লো।
কামিজ, বিভিন্ন ধরনের শার্ট ও টপে এথনিক ছোঁয়া থাকলে নানা ধরনের বটমের সঙ্গে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে পরার সুযোগ রয়েছে গ্রামীণ-ইউনিক্লোর সংগ্রহে।
ইউকির কথায় উঠে এল, ছেলেমেয়ে উভয়েরই ক্ষেত্রে ক্যাজুয়াল ওয়্যারে গ্লোবল ফ্যাশন সর্বজনীন করে তুলতে চায় গ্রামীণ-ইউনিক্লো। কাইতেকি চিনোজ বা লম্বা শার্ট প্যাটার্নের কামিজের মতো ক্যাজুয়াল পোশাক মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে সব আবহাওয়া ও পরিবেশেই পরা যাবে বলে তিনি মনে করেন। বললেন, কাজের জায়গা হোক বা পার্টি গ্রামীণ ইউনিক্লো আরামদায়ক পোশাক নিয়ে সব জায়গায়ই থাকতে চায়। ইউকির ভাষ্যমতে, এগুলোই গ্রামীণ ইউনিক্লোর ইউনিক সেলিং পয়েন্ট। গ্রামীণ ইউনিক্লো ক্রেতাদের উৎসাহিত করছে তাঁদের চাহিদা আরও বেশি শেয়ার করার জন্য এবং এর মাধ্যমেই গ্রামীণ ইউনিক্লো ক্রেতাবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চায়।
আমাদের দেশের পোশাকসংস্কৃতি জাপানের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় বলে ইউকি মনে করেন। পশ্চিমা দেশগুলোয় যেমন শরীরের বিভিন্ন অংশ উন্মুক্ত রাখা পোশাকের প্রচলন বেশি, এদিকে আবার পশ্চিমা পোশাক হলেও তা কিছুটা রক্ষণশীল ঘরানার হয়ে থাকে। আর এ ব্যাপারে জাপান ও বাংলাদেশের মিল রয়েছে বেশ, বললেন ইউকি।
আবার জাপান বা জাপানি জিনিসের প্রতি একধরনের আগ্রহ রয়েছে এ দেশের সাধারণ মানুষের, পর্যবেক্ষণ থেকে বললেন ইউকি। তাই গ্রামীণ ইউনিক্লোর এ দেশে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে মতামত দিলেন তিনি।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণায় ইউকি জানালেন আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিষয়ে স্নাতক করে ইউনিক্লোতেই কাজ শুরু করেন। স্টোর ম্যানেজার হওয়ার বদলে বরং উৎপাদন ব্যবস্থাপনার দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। আর প্রথম থেকেই দেশের বাইরে ব্যবসা পরিচালনায় অংশ নিয়ে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফলিত রূপটিকে বাস্তবায়নের ইচ্ছা পোষণ করতেন ইউকি। সাংহাইতে প্রোডাকশনের কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে এখন বাংলাদেশে গ্রামীণ-ইউনিক্লোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করছেন তিনি। আর এই চ্যালেঞ্জ তিনি উপভোগ করছেন, বললেন সন্তুষ্টি নিয়ে।
টেকসই বা সাসটেইনেবল ব্যবসায়ের ব্যাপারে খুব বাস্তববাদী চিন্তা ইউকির। তিনি মনে করেন, টেকসই পরিপ্রেক্ষিতে মূল কথা হচ্ছে ব্যবসাটি সফল হতে হবে, টেকসই হতে হবে। বললেন, সেবামূলক কাজের ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা হলো, শুধু কাউকে অনুদান দেওয়ার মাধ্যমে টেকসই কিছু অর্জন করা যাবে না। ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তা মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারবে, তাঁদেরই অংশগ্রহণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
গ্রামীণ ইউনিক্লোকে এখন বাংলাদেশে দাঁড় করাচ্ছেন তিনি দৃঢ় নেতৃত্বগুণে। এই মুহূর্তে সেভাবে সাসটেইনেবিলিটি–ভিত্তিক বড় প্রকল্প বা গ্রিন স্টোর তৈরির পরিকল্পনা না থাকলেও জনকল্যাণমুখী যেকোনো কাজে গ্রামীণ ইউনিক্লো যথাসাধ্য পাশে থাকার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছে, বললেন ইউকি। সঙ্গে যোগ করলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করেছে তাঁর প্রতিষ্ঠান।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাঁদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি প্রদানের মূলনীতি অনুসরণ করে গ্রামীণ ইউনিক্লো। এ ছাড়া নিজেদের পুরুষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের লিঙ্গবৈষম্য সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিং করার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠান ও স্টোরগুলো নারীবান্ধব করে তোলার ভাবনার কথা জানালেন ইউকি।
পরিবেশ বাঁচাতে প্লাস্টিক ব্যাগের বদলে রিসাইকেলড কাগজ ব্যবহার করা, সাপ্লায়াররা পরিবেশদূষণে ভূমিকা রাখছে কি না ও তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না—এসব বিষয়েও লক্ষ রাখা হয়, জানা গেল ইউকির কাছ থেকে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা যা ইউকির ভাষ্যে উঠে এল, তা হলো সহনীয় দামে সবার জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ক্যাজুয়াল ওয়্যার এনে গ্রামীণ ইউনিক্লো এ দেশের ফ্যাশন প্রেক্ষাপটকে সমৃদ্ধ করছে নিঃসন্দেহে। গ্রামীণ ইউনিক্লোর পোশাক তো পরা হয়ই, তবে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের প্রতি ইউকির আগ্রহ খুব। আন্তরিক আলাপচারিতার শেষে এসে জানা গেল, জাপানি কিমোনো তো বটেই, এ দেশের শাড়িও ইউকির খুব পছন্দের।