অ্যানিমেল লাভারস বাংলাদেশের শুরু কবে থেকে?
অ্যানিমেল লাভারস বাংলাদেশ গ্রুপের যাত্রা শুরু ২০১২ সালে। পরের বছর আমি নারায়ণগঞ্জে নিজের বাসায় চলে যাই এবং শেল্টারের কাজ শুরু করি। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম।
কনটেন্ট রাইটিং এবং লেখালেখির পাশাপাশি কী চিন্তা থেকে এই প্রতিষ্ঠানের শুরু?
আমি আসলে ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের রেস্কিউ করে থাকি। সেটা সেই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়, ১৯৯৮ সাল থেকে। এরপর পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নেওয়া ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ বড় একটা সময় চলে গেছে। এরপর ২০১০ সালে আবার কাজ শুরু করি। ঢাকায় সে সময় আমার নিজের ফ্ল্যাটে ১৫টির বেশি বিড়াল ছিল। কিন্তু কুকুর ফ্ল্যাটে রেখে পালা সম্ভব নয়। তা ছাড়া চিন্তা করলাম, খুব বেশি বিড়াল তো এই ফ্ল্যাটে রাখা সম্ভব নয়। তাই ২০১৩ সালে আমার মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর আমি নারায়ণগঞ্জে চলে যাই। এ সময় আমি কোনো পেশাগত প্রতিষ্ঠানে যোগদান না করে পুরো সময়টা শেল্টারে দিই, ২০১৮ সাল পর্যন্ত। এরপর আমি ঢাকায় চলে আসি। সেখানে চারজন কর্মী আছেন। মূলত শেল্টারের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতেই আমি চাকরিতে ঢুকি। আমার মা–বাবা দুজনই চাকরি করতেন। এর ফলে আগে তাঁরাই আমাকে অর্থসহায়তা দিতেন। আমি আমার স্বামীর কাছ থেকেও সহযোগিতা পেতাম। এর মধ্যেই আমার বিবাহবিচ্ছেদ হয় এবং আমার মা–বাবাও অবসরে চলে যান। শেল্টার চালানোর জন্য আমাকে কর্মক্ষেত্রে ফিরতেই হয়। আমার পড়ালেখা ইংরেজি সাহিত্যে। তাই আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারতাম। কোভিডের সময় এই কাজের পরিমাণ বাড়ে। এটা আমার মূল পেশা নয়। তবে শেল্টারের জন্য অর্থের জোগান দিতেই এই কাজের শুরু।
এদের আশ্রয় দেওয়া কবে থেকে শুরু? বর্তমানে কয়টি বিড়াল এবং কুকুরকে আশ্রয় দিচ্ছেন?
২০১৪ সাল থেকেই আমি শেল্টার দেওয়া শুরু করি। আমিই বাংলাদেশে প্রথম ফস্টারিং বা এসব প্রাণীর লালনপালন শুরু করি। শেল্টার পরিচালনার জন্য ধারণা নিতে আমাকে বেশ পড়াশোনা করতে হয়। তা ছাড়া ছোটবেলা থেকেই আমার এই বিষয়ে আগ্রহ ছিল বলেই নিজের বাড়িতেই শেল্টার করে ফেলি। এই মুহূর্তে আমার শেল্টারে ১৬০টির মতো কুকুর–বিড়াল আছে। ৭৫টি বিড়াল আর ৮৫টি কুকুর—সবই দেশি, কোনো বিদেশি ব্রিড নেই, আর সবগুলোই উদ্ধার করা।
এই ব্যয়বহুল কাজ করতে আপনার ব্যক্তিগত জীবনে আর্থিকভাবে কি প্রভাব পড়ছে?
এই শেল্টার চালানো বেশ ব্যয়বহুল। আগে মা–বাবা ও স্বামীর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা মিলত। এখন সে সুযোগ নেই, উপরন্তু খরচও বেড়েছ। ২০১৮ সালে যেখানে ৫০ হাজার খরচ হতো, এখন সেখানে খরচ প্রতি মাসে অন্তত ১ লাখ টাকা। প্রাণীদের খাবার, ওষুধ ছাড়াও আছে কর্মীদের বেতন। তাই নানাভাবে খরচ সাশ্রয় করার চেষ্টা করি।
রেস্কিউ করতে গিয়ে কোনো মন খারাপের ঘটনা এবং রেস্কিউ করর পর ভালো লাগার অভিজ্ঞতা কি আছে?
মন খারাপ বলতে যখন উদ্ধার করতে গিয়ে দেখি, বিড়াল বা কুকুরটি মৃতপ্রায়, রেস্কিউ করেও বাঁচাতে পারব না, তখন মন খারাপ হয়। আর যখন খুব খারাপ অবস্থা থেকে উদ্ধার করার পর ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন খুব ভালো লাগে। কারণ, ওরাও কিন্তু বুঝতে পারে, ওদের পাশে কেউ আছে, তখন ওরা আরাম বোধ করে।
নতুন অনেক রোগ হচ্ছে যেখানে ভ্যাকসিন কাজ করছে না, মানুষের কোভিডের পর বিড়ালের কোভিড হচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে এফআইপি এবং এফআইভি, যার চিকিৎসা নেই।
অনেকেই শেল্টারে প্রাণী রাখতে চান। তাই এখানকার খরচ সম্পর্কে যদি ধারণা দেন।
আগের চেয়ে খরচ অনেক বেড়েছে। এখন দুর্ঘটনা বাড়ছে। মানুষ অনেক বেশি বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, যার ফলে রেস্কিউয়ের সংখ্যা বাড়ছে। করোনার সময় বিভিন্ন অ্যানিমেল ফুড শপ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে খাবারের দাম ওষুধের দামও বাড়ে। আমরা আগে প্রতিদিন ৫০ টাকা করে নিতাম, এখন প্রতি মাসে ২ হাজার ৫০০-৩০০০ টাকা করে নিই। বাংলাদেশে আমরাই ফস্টারিংয়ে সবচেয়ে কম টাকা চার্জ করে থাকি। অন্যরা যেখানে ৬০০০–৭০০০ টাকা এমনকি দিনে ২০০, ৩০০ বা ৫০০ টাকাও রেখে থাকেন। তাই আমি পারসোনাল পেট খুব একটা নিই না, কমিউনিটি–বেজড প্রাণী নিয়ে থাকি।
কীভাবে ব্যবস্থাপনা করছেন?
আমাদের শেল্টারে চারজন কর্মী আছেন, যাঁরা ক্লিনিং ও ফিডিং করে থাকেন। ভলান্টিয়ার আছেন, যাঁরা রেস্কিউ করে নিয়ে আসেন। এরপর এদের স্টেরিলাইজড করা হয় এবং ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। যেগুলো খুবই মুমূর্ষু অবস্থায় আছে, সেগুলোকে শেল্টারে রেখে দেওয়া হয়। কেউ যদি ফস্টারে রাখতে চান, তাহলে অবশ্যই ভেট চেকআপ করে স্টেরিলাইজড করে ভ্যাকসিন দিয়ে তারপর দিতে হবে। এ ছাড়া শেল্টারে নেওয়া হয় না। বিড়ালের ক্ষেত্রে এফআইপি টেস্ট এবং কুকুরের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরীক্ষা করে নিতে হয়।
যেগুলোকে খাবার খাইয়ে দেওয়া হতো বা মানুষের সঙ্গে একই বিছানায় থাকত, এমন ফস্টার আমরা নিই না। আমরা আসলে কেস বুঝে তারপর নিই। মূলত শেল্টারের জন্য প্রাণীদের নিই। অর্থাৎ, পথে যে কুকুর–বিড়াল থাকে, যেগুলোকে দেখার কেউ নেই কিংবা কোনো কমিউনিটিতে কয়েকজন মিলে একটা কুকুরকে দেখতেন, এখন আর পারছেন না, সেগুলোকে আমরা শেল্টার দিই।
আমাদের ১৬০টি প্রাণীর মধ্যে মাত্র ৩৩টি ফস্টার এবং একেবারেই যেগুলোকে দেখার কেউ নেই, সেগুলোর জন্য এই ফস্টারিংয়ের ব্যবস্থা। প্রতিদিন আমাদের পেজে অনেকেই নক করেন। সবাইকে তো আসলে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই গুরুত্ব বুঝে আমরা সেভাবেই শেল্টার ফাঁকা রাখি।
ভবিষ্যতে আর কী করার ইচ্ছা আছে?
আমার বয়স এখন ৩৭। আমার সমসাময়িক সময়ের পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা হোটেল বা ক্লিনিক করে ফেলেছেন। আমি করতে পারিনি। কারণ, আমার অর্থনৈতিক ব্যাকআপ নেই, তাই করা সম্ভব হয়নি। তবে ইচ্ছা আছে শেল্টারকে স্টাবলিশ করা, যাতে আমি না থাকলেও যেন এটা নিজ খরচে চলতে পারে। আমি আসলে মা–বাবা ছাড়া নিজের আত্মীয়দের কাছ থেকে যে সাহায্য পাইনি, সেটা অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে পেয়েছি। অনেকে আসলে আমার কাজ দেখে আমাকে ভালোবাসেন, আমাকে সহায়তা করেন। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। হয়তো অনেক বড় অঙ্ক নয়, কিন্তু এই সহযোগিতা না পেলে একার পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে যেত।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটা সচেতনতার জন্য বলতে চাই। এখন আসলে অনেকেই কুকুর বা বিড়াল পোষেন এবং তাঁদের অধিকাংশই আসলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিউ বা ফলোয়ার বাড়াতে এগুলোকে ব্যবহার করে থাকেন। দেখা যায়, অন্য কারও ভ্যাকসিন দেওয়া কুকুর বা বিড়াল নিজেদের বলে ভিডিও করেন। মানুষ শো অফ করার জন্য কুকুর–বিড়ালের ভিডিও দেন, কিন্তু এগুলোকে নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। এখন মানুষ প্রচুর ব্রিড পোষেন। জার্মান শেফার্ড, পারসিয়ান নিয়ে বাড়িতে নিজেরাই ব্রিড করেন। তাঁরা ডোনেশন পান, কিন্তু যাঁরা আসলেই প্রাণীদের ভালোর জন্য কাজ করছেন, সত্যিকার অর্থে তাঁরা এই আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছেন না। দেশি কুকুর বা বিড়াল দেখাই যায় না, সব ব্রিড দেখা যাচ্ছে এখন। এই বিষয়ে মানুষকে জানানো উচিত। তাহলে সঠিক ব্যক্তি আর্থিক অনুদান পাবেন। তাহলে সুবিধাভোগীরা সুযোগ পাবেন না।
প্রাণীদের প্রতি মানুষের সহনশীলতা গড়ে তুলতে কী করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আসলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন খুব দরকার। ক্যাম্পিং বা কাউন্সেলিং করলে কিছু সময়ের জন্য ভালো হয়। স্থানীয় মানুষের মধ্যে এসব অবোধ প্রাণীদের প্রতি নির্বিচার আচরণ কমে যায়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা খুবই দরকার। এলাকায় এলাকায় গিয়ে মানুষকে সচেতন করা জরুরি। মূলত দেখা যায়, মানুষ ভয় পান। এটা আসলে প্রাণীদের থেকে কোনো রোগে আক্রান্ত হবেন কি না, সে কারণেই এই ভয়। এ জন্য টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যেটা সরকারের পক্ষ থেকেই করা সম্ভব। পাঠ্যবইয়ে পেট প্যারেন্টিংয়ের বিষয় থাকলে বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের ভালোবাসবে, সহনশীল হবে। তাদের মমত্ববোধ গড়ে উঠবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও