নাদিয়া ইসলাম: ফ্যাশন ডিজাইনে আগ্রহী হলেন কেন?
আমেশ বিজয়শেখর: আমার বাবা আইনজীবী। রোজ সকালে একই রকম সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট ও কোর্ট গায়ে চাপিয়ে তাঁকে চেম্বারে যেতে দেখেছি। একটা নির্দিষ্ট সময় কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করতেন। আমি ভাবতাম, এ রকম একঘেয়ে জীবন কী করে কারও ভালো লাগে! তাই আমি প্রথাগত কাজের এই আবর্তে ঢুকতে চাইনি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমার পরিবারের সবাই কোনো না কোনো শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত। কেউ স্থাপত্য পড়ছে, কেউ শিল্পী। আমার নানি আবার ফ্লাওয়ার আর্টিস্ট, আমার খালা হর্টিকালচারিস্ট, আমার মা ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। আমার আশপাশের সব সৃষ্টিশীল মানুষের কাজের কারণে বিভিন্ন রকম উপকরণ দেখে দেখে বড় হয়েছি। ফলে গাড়ি ছেলেদের খেলনা আর পুতুল মেয়েদের, এ বিষয়ে আমার আগ্রহ কম ছিল। তার চেয়ে বরং বাগান করা বা এ ধরনের সৃজনশীল কাজ আমাকে আকর্ষণ করত। প্রথমে আমি আমার মায়ের মতো ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হতে চেয়েছি। কিন্তু পরে মনে হয়েছে যে স্টাইলিং, পোশাক ইত্যাদি বিষয় আমার খুব ভালো লাগে। আর ফ্যাশন ডিজাইনার হলে আমি আরও অনেক কিছুই শিখতে ও করতে পারব। বলতে গেলে, সে কারণেই ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়া শুরু করি। আমি ফ্যাশন ডিজাইনে পড়েছি একাডেমি অব ডিজাইন শ্রীলঙ্কায়। এটা যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ এম্ব্রিয়া ইন নিউ ক্যাসলের অধিভুক্ত। সেখান থেকে আমি ফ্যাশন ও টেক্সটাইল ডিজাইনে স্নাতক করি।
নাদিয়া ইসলাম: শ্রীলঙ্কান কারুপণ্য কেমন? কোন বিষয়টি আপনাকে আগ্রহী করেছে শ্রীলঙ্কার হেরিটেজ নিয়ে কাজ করতে?
আমেশ বিজয়শেখর: আমাদের বৈচিত্র্যময় কারুশিল্প রয়েছে। এগুলো শ্রীলঙ্কার হেরিটেজ। আমাদের বিভিন্ন গ্রামে কাপড় হাতে বোনা হয়। অন্যান্য বয়নশিল্পও আছে। এসবের প্রতিটির আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে যেমন ‘দুম্বারা উইভিং ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্টের অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিটওয়্যার ও কুরুশের কাজ পছন্দ করি। আমরা ট্রপিক্যাল আইল্যান্ডের বাসিন্দা। আমাদের ওখানে শীতকাল নেই। তাই উল বোনা হয় না। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা থেকে আমাদের এখানে উল পাঠানো হয়। শ্রীলঙ্কার গ্রামগুলোয় নিটিং সেন্টার আছে; সেখানে নারীরা হাত দিয়ে উল বুনে নানা কিছু তৈরি করেন। উল ও কুরুশের কাজ আমাদের এখানে নতুন বিষয়। আমি ফ্যাশন স্কুলে থাকার সময় তাদের সঙ্গে কাজ করেছি। এখনো করছি। আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাটিক আছে, হ্যান্ডলুম আছে। ঔপনিবেশিক কারণে ডাচ, পর্তুগিজ ও ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কায় এসেছে। তাদের প্রভাব আমাদের বয়নে পড়েছে। সে কারণে বিরল লেইস তৈরি হয়। এটা আমাদের খুব দুর্লভ একটি ক্র্যাফট ফর্ম, যা হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এর দামও অনেক বেশি।
নাদিয়া ইসলাম: আপনার ডিজাইনে কোন ধরনের উপকরণ, রং ও মাধ্যম ব্যবহার করেন?
আমেশ বিজয়শেখর: উপকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্রান্ডের লেফটওভার সুতা ব্যবহার করা হয়, যেগুলো দিয়ে উল তৈরি করে পরে কুরুশ দিয়ে বুনি। কারণ, আমাদের এখানে ভেড়া নেই যে লোম সংগ্রহ করব। তাই এই লেফটওভার থেকেই উল বানানো হয়। আমি কোনো একটা রঙের উল দিয়ে কিছু করতে চাইলে যে পরিমাণ উল লাগবে, সেটা দিয়ে একটি বা দুটি পোশাক বানানো সম্ভব। অনেক বেশি পরিমাণে বানানো সম্ভব নয়। এটা দারুণ ব্যাপার, কারণ একটি ডিজাইনের একটি বা দুটি পোশাক হবে, যা অন্য কারও সঙ্গে মিলবে না। দ্বিতীয়বার আর তৈরিও হবে না। এভাবেই ব্র্যান্ডের পোশাক আলাদা করে চেনে যায়। এ ছাড়া ফ্যাক্টরি বর্জ্য থেকে উপকরণ বানানো হয়। অনেক ধরনের বর্জ্য শ্রীলঙ্কার স্ট্রিট মার্কেটে পাওয়া যায়। আমি সেখানে গিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক কাঁচামাল সংগ্রহ করে থাকি। এভাবেই মূল্যহীন একটি কাপড় মূল্যবান হয়ে ওঠে। এরপর সংগৃহীত সেই বর্জ্য আর কাপড় আমি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পোশাক তৈরির পর্যায়ে নিয়ে যাই। ফেব্রিকে হ্যান্ডপেইন্ট করি, অ্যাপ্লিকে করি। নানা ধরনের সুচিকর্মও করা হয়। রং নির্বাচনে বিভিন্ন বিচিত্র প্রাণী, সমুদ্রের রং আমার পোশাকের প্রেরণা হয়। শ্রীলঙ্কা খুব প্রাণবন্ত রঙের দেশ। বিভিন্ন সংস্কৃতি আছে আমাদের দেশে। আমার স্নাতকের পর আমি লন্ডনে য়েছিলাম। সেখানে গিয়ে সবাইকে কালো রঙের পোশাক পর দেখে একঘেয়ে লেগেছে। কারণ, একেক রঙের একেক অর্থ। এসব রং মনকে প্রফুল্ল রাখতে এবং ইতিবাচক থাকতে সাহায্য করে। সে কারণে আমি রং খুব পছন্দ করি এবং আমার পোশাকের সংগ্রহেও খুব উজ্জ্বল রং রাখার চেষ্টা করি।
নাদিয়া ইসলাম: আপনার সংগ্রহে ছেলে–মেয়ে উভয় মডেলের সজ্জায় প্রচুর অলংকার দেখা যায় যা খুবই সুন্দর।
নাদিয়া ইসলাম: শ্রীলঙ্কার সংস্কৃতিতে গয়নার প্রচলন বহু শতাব্দী আগে থেকে। আপনি আপনার ডিজাইনে কীভাবে সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করেন?
আমেশ বিজয়শেখর: ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে অনেক গয়না এখানে এসেছে, যার প্রভাব রয়েছে। আমাদের এখানে অনেক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অবস্থান আছে। সনাতন হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের তীর্থস্থান এখানে। আবার পৌরাণিক কাহিনি রামায়ণের স্থানও এখানে। ফলে শ্রীলঙ্কার সংস্কৃতিতে গয়নার প্রচলন আদি থেকে। ক্যান্ডিয়ান রাজ্যে তাদের নিজস্ব অলংকার আছে। তাদের বিয়ের পোশাকেও রাজকীয় ব্যাপার আছে। তারা আট স্তরে সোনার গয়না পরে থাকে। চাঁদ, সূর্যসহ নানা প্রাকৃতিক মোটিফ ব্যবহার করা হয় গয়নায়। সে কারণে আমার ডিজাইনের সঙ্গে অনুষঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি চেষ্টা করেছি, শ্রীলঙ্কার প্রথাগত গয়নার সঙ্গে সমকালীন গয়নার সমন্বয় করতে। আমার পোশাক ঐতিহ্যবাহী বা এথনিক নয়, বরং সমসাময়িক। সে কারণে গয়না আর পোশাকে কনটেম্পোরারি ছোঁয়া রাখাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমি স্থানীয় বয়নশিল্পকে আন্তর্জাতিক পরিসরে দেখাতে চেয়েছি। একইভাবে শ্রীলঙ্কার গয়নাও রেখেছি যাতে অন্যতর মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়।
নাদিয়া ইসলাম: বাংলাদেশের ক্র্যাফট থেকে যদি কোনো কিছু আপনার ভালো লেগে থাকে, সেটা কি আপনি আপনার পোশাকে ব্যবহার করবেন?
এখানে এসে আমি খুবই অবাক হয়েছি জেন–জি ও তরুণ ফ্যাশনিস্তাদের পোশাক ও স্টাইল সেন্স দেখে। এটা দারুণ ব্যাপার, খুবই ভালো লেগেছে আমার। আমি চাই এর পরিধি বাড়ুক, আন্তর্জাতিকভাবে আরও ছড়িয়ে পড়ুক।
আমেশ বিজয়শেখর: আমি এবারই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি; তাই সেভাবে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে যতটুকু দেখেছি, এমব্রয়ডারি খুবই ভালো লেগেছে। শ্রীলঙ্কার ক্র্যাফট এখানকার থেকে বেশ আলাদা। এমনকি ভারতের হ্যান্ডলুমও আলাদা। শ্রীলঙ্কার হ্যান্ডলুম হারিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত তা অনেকাংশে ধরে রেখেছে। সুযোগ পেলে এসব নিয়ে অবশ্যই কাজ করার ইচ্ছা আছে।
নাদিয়া ইসলাম: আর্কা ফ্যাশন উইকে এসে কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
আমেশ বিজয়শেখর: আমি আসলে এই আয়োজন সম্পর্কে জানতাম না। আমি ভেবেছিলাম, বাংলাদেশে মূলত এথনিক ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সবাই। যেহেতু মুসলিমপ্রধান দেশ, রক্ষণশীলতা থাকাটাই স্বাভাবিক। ফলে ফ্যাশন উইকও তেমন হবে বলেই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে আমি খুবই অবাক হয়েছি জেন–জি ও তরুণ ফ্যাশনিস্তাদের পোশাক ও স্টাইল সেন্স দেখে। এটা দারুণ ব্যাপার, খুবই ভালো লেগেছে আমার। আমি চাই এর পরিধি বাড়ুক, আন্তর্জাতিকভাবে আরও ছড়িয়ে পড়ুক। শুধু তা–ই নয়,এখানে এসে মডেলদের অভিব্যক্তি ও পারফরম্যান্সে আমি মুগ্ধ। প্লাস সাইজ, ট্রান্সজেন্ডার সব ধরনের মডেল ছিল এই রানওয়েতে।
নাদিয়া ইসলাম: আর্কায় আপনার সংগ্রহ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানাবেন?
আমেশ বিজয়শেখর: আমি শেড ওয়ারড্রোব কনসেপ্ট বা জেন্ডার নিউট্রাল কনসেপ্টে পোশাক সংগ্রহ প্রদর্শন করেছি। এই পুরো সংগ্রহ ট্রান্সসিজনাল, যা যেকোনো ঋতুর সঙ্গে যায়। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম সব ঋতুতে এখান থেকে যেকোনো পোশাক আপনি পরতে পারবেন। আমার লক্ষ্য ছিল, এই পোশাক যেন সবাই সব ঋতুতে পরতে পারে। ফাস্ট ফ্যাশনের মতো একবার পরে ওয়ারড্রোবে রেখে যেন না দেয়। আমার একটি পোশাক একবারই বানানো হয়। হাতে বোনা, এটা একেবারেই আলাদা। তাই ক্রেতা সেই ভিন্নতার স্বাদ পান; সেরা অনুভূতি পান।
ফাস্ট ফ্যাশন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এমন পোশাক নিজের সংগ্রহ রাখা ভালো যা অদ্বিতীয় হবে। অল্প পোশাক থাকুক, কিন্তু সেটা হোক টেকসই সুন্দর পোশাক। বহু আগে থেকেই আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত। একটা কাপড় পুরোনো হয়ে গেলে আমাদের দাদি–নানিরা তা ফেলে না দিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করতেন। বিপন্ন পরিবেশের বর্তমান পৃথিবীতে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের কোনো বিকল্প নেই। করোনার সময় বয়নশিল্পীদের কাছে যাওয়ার সুযোগ আমার ছিল না। শ্রীলঙ্কান অর্থনীতিতে ধস নামে। সে সময় আমি আমার মা ও নানির শাড়ি দিয়ে একটি সংগ্রহ করেছিলাম। এই সাসটেইনেবল বিষয়টা উত্তরাধিকার সূত্রেই কিন্তু আমাদের মধ্যে আছে। আমাদের আশপাশের উপাদান থেকেই আমরা অনেক কিছু করতে পারি। আমার স্টুডিওর লেফটওভার থেকে আমি অনেক কিছু তৈরি করি। আমি মনে করি, আমার কাছে যত কম সম্পদ থাকবে, তত প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দারুণ কিছু তৈরি করা সম্ভব। আপনার নতুন কিছু কেনার দরকার নেই, আপনার ক্লজেট থেকে পোশাক নিন, খানিকটা পরিবর্তন আনুন, ফেব্রিক শপ থেকে উপকরণ কিনে এই পুরোনো পোশাকে সংযুক্ত করুন, দেখবেন পুরোনো পোশাকে নতুনত্ব চলে আসবে। এখানে আসা জেন–জিদের দেখে এ জন্যই মুগ্ধ হয়েছি; কারণ, তাঁরা তাঁদের বাসায় বড়দের পোশাক, নিজেদের সংগ্রহ দিয়েই নিজেদের দারুণভাবে উপস্থাপন করেছে।
নাদিয়া ইসলাম: ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন?
আমেশ বিজয়শেখর: আমি শ্রীলঙ্কা থেকে ফ্যাশনে স্নাতক করার পর লন্ডনে চলে যাই। যেখান থেকে জার্মানিতে। ওখানে চার বছর থাকার পর শ্রীলঙ্কায় ফিরে আসি। এখানে এসে টেক্সটাইল আর্ট প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করি। আমি ফ্যাশন উইক অব শ্রীলঙ্কার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করি। এরপর আমি যাচ্ছি ভারতের তামিলনাড়ুতে, সেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কার টেক্সটাইল আর্ট নিয়ে জাদুঘরে একটি প্রদর্শনী হবে। সেখানে আমি অতিথি বক্তা। এ ছাড়া খুব শিগগির আমার ওয়েব শপ খুলতে যাচ্ছি।
নাদিয়া ইসলাম: নতুন ডিজাইনারদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
আমেশ বিজয়শেখর: আপনার চারপাশে কী আছে, সেটা ভালো করে লক্ষ করুন দেখুন। নিজের একটি স্বাতন্ত্র্য গড়ে তুলুন; যেখানে আপনার নিজস্বতা থাকবে। অন্য কারও অনুকরণ করার দরকার নেই। দিন শেষে নিজের আলাদা সৃষ্টির জয় হয়। প্রশংসিত হয় সবার কাছে। আপনার ডিজাইনের পোশাক আপনার সংস্কৃতি ও আপনার রুচির পরিচায়ক। এটা সব সময় মাথায় রাখতে হবে। আমরা কোন সংস্কৃতি থেকে এসেছি, আমার গায়ের রঙ কী, আমরা এশিয়ান। অথচ আমরা কেবল ইউরোপিয়ানদের জন্য পোশাক বানাই। এ জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মানুষ আমাদের চিনবে আমাদের কাজের দক্ষতার জন্য। নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কখনো ভুলে যাওয়া যাবে না।
নাদিয়া ইসলাম: আপনাকে ধন্যবাদ।
আমেশ বিজয়শেখর: ধন্যবাদ আপনাকেও।