রেনেসন্স ঢাকা গুলশান হোটেলের এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেব সম্প্রতি যোগ দিয়েছে থাইল্যান্ডের শেফ আফিথাক উইথোজিত। শেফ ম্যাক নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। শেফ হিসেবে তাঁর রয়েছে ৪০ বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। নিজের দেশ ছাড়াও কাজ করেছেন নানা দেশে। এই তালিকাও বেশ সমৃদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকা, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, সৌদি আরব ছাড়াও ভারতের একাধিক শহরে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর রন্ধনজাদু।
দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় পা রেখেই তিনি মুগ্ধ করেছেন আমের স্বাদে। আমের এই মৌসুমকে উদ্যাপন করতে নানা স্বাদের পদ তৈরি করেছেন আম দিয়েছে। ‘সিজনাল ম্যাংগো ক্রিয়েশনস’ শিরোনামের এই আয়োজনের সূচনা হয়েছে দিন কয়েক আগে। সেখানেই আলাপ হয় শেফ ম্যাকের সঙ্গে। স্রেফ আলাপ বললে ভুল হবে। বরং সময় নিয়ে কথাও হয় তাঁর সঙ্গে।
রেনেসন্স ঢাকা গুলশান হোটেলের এক্সিকিউটিভ শেফের দায়িত্ব পেয়ে শেফ ম্যাক যে যথেষ্ট, রোমাঞ্চিত তা বলতে দ্বিধা করেননি। বললেন, এখানকার মানুষ দারুণ প্রাণবন্ত। উদ্ভাবনী বিষয়কে সম্মান করেন।
বললেন, এখানে যোগ দেওয়ার আগে কথাবার্তা চূড়ান্ত করতে এর আগে তিন দিনের জন্য ঢাকা ঘুরে যান। তখনই এই শহরকে তাঁর ভালো লেগে যায। তাই যোগদানের জন্য দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।
শেফ ম্যাকের নেতৃত্বে রেনেসন্স ঢাকার দস্তরখান সাজতে যাচ্ছে নতুন করে। যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সব পদ। ঋতুপ্রধান উপাদানের সঙ্গে সংস্কৃতিভিত্তিক রান্নার সংমিশ্রণ থাকবে সেখানে। প্রতিটি ডিশে গ্লোবাল ফিউশন ও লোকাল ফ্লেভারের নিখুঁত সমন্বয় করার প্রয়াস থাকবে বলেও জানান তিনি।
এই প্রসঙ্গ ধরেই জানা হয়ে গেল তাঁর জন্ম থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কনকেন গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে। বললেন, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম মুয়াই থাই (থাইল্যান্ডের জাতীয় খেলা-থাই বক্সিং) চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। প্রতিদিনের কঠোর অনুশীলনের ফলস্বরূপ মাত্র ১৩ বছর বয়সেই প্রাদেশিক চ্যাম্পিয়ন হই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝতে পারলাম, এই কষ্টসাধ্য খেলায় শরীরিকভাবে নিজেকে দীর্ঘদিন ধরে রাখা আমার পক্ষে কঠিন হবে।
এই দোলাচলের মধ্যেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় ম্যাকের। আর সে ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেন তাঁর মামা। বললেন, ‘আমার মামা ছিলেন একজন শেফ। রান্নাঘরের খাবারের গন্ধ, ধোঁয়া, আর ব্যস্ততার মধ্যে আমি এক আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করতাম। মামাকে সাহায্য করতে করতেই শুরু হয় আমার শেফ হওয়ার যাত্রা। শুরুটা ছিল গরম পানি এনে দেওয়া, থালাবাসন ধোয়া।’
এক বছর পরেই পা রাখেন রন্ধনের মূল সড়কে। শুরু করেন রান্নার মূল পাঠ নিতে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে থাইল্যান্ডের গণ্ডি পেরিয়ে সিঙ্গাপুরে যান। সেখানে চলে নিজেকে গড়ে নেওয়ার পালা। দুই বছর কাটিয়ে উনিশে পা দিয়েই পাড়ি দেন ভিয়েতনামে। সেখানে কিছুদিন থেকে দেশে ফিরে যোগ দেন নৌবাহিনীতে। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। সেখান থেকে ফিরে আবারও রান্নায় মেতে ওঠেন। ১৯৯৫ সালে থাইল্যান্ড ছাড়েন। পাড়ি জমান দূর পরবাসে। গন্তব্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
পরের বছরে পরিচয় হয় দক্ষিণ আফ্রিকার এক নারীর সঙ্গে—যিনি পরে হয়ে ওঠেন তাঁর জীবনসঙ্গিনী। শেফ ম্যাক বলেন, ‘আমরা ১৯৯৮ সালে বিয়ে করি। আমার একমাত্র মেয়ে এখন কেপটাউনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। বেশ লম্বা একটা সময় আমি কেপটাউনে ছিলাম। এরপর ২০০৮ সালে যোগ দিই চেইন রেস্তোরাঁ ‘বুদ্ধা বার’ দুবাইয়ে। এরপর একের পর এক দেশ ঘুরে কাজ করেছি—সাইপ্রাস, বাহরাইন, কম্বোডিয়া, ভারত, সৌদি আরবসহ নানা দেশে। সৌদিতে আমি চার বছর ছিলাম রাজপরিবারের শেফ হিসেবে। প্রতিটি অভিজ্ঞতা আমাকে আরও পরিণত করেছে, শিখিয়েছে নানা সংস্কৃতি ও নানা অঞ্চলের স্বাদ ও রন্ধনসংস্কৃতি।’
ডাবলিউ দোহা হোটেলস অ্যান্ড রেসিডেন্সেসে ছিলেন ঢাকায় আসার আগে। ফলে রেনেসন্স ঢাকা গুলশান হোটেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে পারছিলেন না তাঁর যোগদানের বিষয়ে। তাই তিন দিনের জন্য তাঁকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি আসেন, দেখেন এবং রাজি হয়ে যান।
শেফ ম্যাক বলেন, ‘মাত্র তিন দিনের জন্য ঢাকায় আসি। আমি ঢাকার বিভিন্ন হোটেলের কিচেন ঘুরে দেখি। আমার কাছে মনে হয়, এই দেশের খাদ্য সংস্কৃতিতে দারুণ সব উপদান আছে। কিচেন ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ এবং গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে এখানে অনেক কিছু করা সম্ভব।’
ম্যাকের ভাষ্য, শেফ হওয়ার এই দীর্ঘ যাত্রা আমার জন্য শুধু একটি পেশা নয়, আজন্ম ভালোবাসা। আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তা হাজারো অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, মানুষ আর সংস্কৃতির নানা উপাদানে গঠিত এক জীবনের গল্প।’
আমার ইচ্ছা অন্তত তিন বছর এখানে থাকার, বেশ জোর দিয়েই বললেন শেফ ম্যাক, এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই আমার অভিজ্ঞতা। গতানুগতিক রান্নার বাইরে নতুন কিছু উদ্ভাবনের চিন্তা অন্যদের থেকে আলাদা করে। মানুষ জানতে চায় আপনি কী ভাবছেন, আপনি কীভাবে রন্ধনশিল্পকে দেখছেন। কারণ, এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।
তবে তিনি এটাও স্বীকার করলেন যে স্থানীয় বাজারের সীমাবদ্ধতা, আমাদের ভোক্তাদের চাহিদা উপকরণ অনেক সময় না পাওয়ার বিষয়কে মাথায় রেখেই নিজেকে তৈরি রাখতে হয়।
বিদেশ থেকে ভালো মানের মাংস আমদানি করতে না পারলে সেই সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় কৌশলী হলে। দেশি মাংস দিয়েও চমৎকার কাজ করা যায। কিছু বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়, বলছিলেন তিনি।
সঙ্গে যাগ করলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় কারণে ওয়াইন দিয়ে রান্না করা হয় না। এ ক্ষেত্রে রান্নার প্রক্রিয়ায় বদল আনার প্রয়োজন হয়। আবার যেমন ধরুন, ফ্রেঞ্চ কুইজিনকে স্থানীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি করতে হলে অবশ্যই একটু ভাবতে হবে। এখন মূলত জাপানি, থাই, ভিয়েতনামিজ বা সিঙ্গাপুরি কুজিনই বেশি প্রচলিত।
আমি মনে করি এখানে সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো জানার। মানুষকে জানতে হবে—খাবারটা কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে বানানো হয়, উপকরণগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়, বললেন, এটা শুধু স্বাদের কথা নয়, এটা হচ্ছে স্বাদের সঙ্গে মেলবন্ধনের ব্যাপার। ধরুন আপনি মাছ রান্না করছেন, তাহলে সেই মাছের উৎস, প্রক্রিয়া এবং উপাদান ব্যবহারে সচেতনতা থাকা জরুরি। যেমন সুশির কথা বলি—এখানে স্পেন থেকে টাটকা টুনা বা জাপান থেকে কামাচি আসে না। তাই আমাদের দেখতে হবে স্থানীয়ভাবে কী করা যায়। তারপরও আমাদের চেষ্টা করতে হবে—আমাদের স্থানীয় মাছ দিয়ে উদ্ভাবনী কিছু করার।
গল্পের ছলে বলেন, ‘আমার এক বন্ধু এখানকার সমুদ্রের কাছাকাছি মাছ ফার্মিং করছিল। সে গবেষণা করছিল, কোন মাছ শুকিয়ে রেখে ‘ড্রাই এজ’ করলে কেমন স্বাদ আসে। কারণ, সুশিতে আপনি বেশি নিরীক্ষা করতে পারবেন না—ভালো মানের স্টিকি রাইস, ভালো ভিনিগার, ভালো মাছ—এগুলো মিলেই আসে সুশির আসল স্বাদ।
মাছ ও মাংসের মধ্যে কোনটা রান্নায় বেশি সচ্ছন্দ্য? জানালেন- ‘আমি মাছ রান্না করতে ভালোবাসি। সমুদ্রের মাছ রান্না করতে ভালো লাগে, কিন্তু খাওয়ার ক্ষেত্রে মিঠা পানির মাছই আমার বেশি পছন্দ। যদিও অনেক সময় কাদার স্বাদ চলে আসে, তবে বিশেষ কৌশলে রান্না করলে সেটা এড়ানো সম্ভব। চিকেন হলে বারবিকিউ বা রোস্ট করা আমি পছন্দ করি। আর ফিশ বারবিকিউ আমার সবচেয়ে পছন্দ। আমি প্রতিদিন ল্যাম্ব স্যুপ খাই। আমার সবচেয়ে পছন্দের খাবার বলতে পারেন।
মাংসের ক্ষেত্রে আমি বলব, এখানে খুব ভালো মানের ল্যাম্ব নেই—বেশির ভাগ সময় আমরা মাটন ব্যবহার করি, যেগুলো অনেক বেশি পরিপক্ব ও অপেক্ষাকৃত শক্ত হয়ে থাকে। অপেক্ষাকৃত কচি ছাগলের মাংস অনেক নরম ও সুস্বাদু হয়ে থাকে। বাংলাদেশে রান্নার পদ্ধতিতে অনেক সময় ধরে সিদ্ধ করা হয়, কিন্তু বারবিকিউ বা স্টেকের জন্য আলাদা কৌশল আর সঠিক মাংস দরকার।
‘সিজনাল ম্যাংগো ক্রিয়েশনস’ প্রসঙ্গে বললেন শেফ ম্যাক বলেন, ‘আমরা এবার “ম্যাঙ্গো ফেস্ট” শুরু করেছি, যেখানে আমাদের থাই স্টাইল কোকোনাট স্টিকি রাইস ও ম্যাঙ্গো রাখছি। স্টিকি রাইস নিয়ে আমার পরবর্তী উদ্ভাবনী চিন্তা হচ্ছে—প্রথমে থাকবে ম্যাঙ্গো চিজকেক, তার ওপরে স্টিকি রাইস, তাঁর ওপর পাকা আম ও নারকেলের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে পরিবেশন করা হবে—যেন প্রতি কামড়ে ভিন্ন ভিন্ন টেক্সচার ও স্বাদ পাওয়া যায়।’
বাংলাদেশেও অনেক ধরনের রসালো আম আছে। থাইল্যান্ডে স্টিকি রাইসে ব্যবহার করা আম হচ্ছে ‘নম দামাই’ যেটা কখনো কখনো মধুর মতো মিষ্টি।
কথা প্রসঙ্গে থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় স্টিকি রাইস তৈরির টিপসও দিলেন শেফ ম্যাক, স্টিকি রাইস বানাতে হলে ভাত যখন গরম থাকে, তখনই নারকেল দুধ, লবণ দিয়ে সিজন করতে হয়। ভাত ঠান্ডা হতে হতে সেই স্বাদগুলো দানায় ঢুকে যায়। রান্নার সময় শুরুতে হাই ফ্লেমে ফোটাতে হবে, পরে লো ফ্লেমে ২০ মিনিট ঢেকে রাখুন। তারপর ১০ মিনিট চুলা বন্ধ করে রেখে দিন।
থাই খাবারের মধ্যে ব্যক্তিগত পছন্দের খাবার জানালেন ‘পাপায়া সালাদ’। হেসে বললেন আমাকে পাপায়া সালাদ রোজ দিলে আমি রোজই সেটা খেতে পারব। এ ছাড়া থাই নুডুলস আমার খুব পছন্দ—ডিম, সয়া সস, চিলি ফ্লেক্স আর একটু লেবুর রস দিলেই একদম অথেনটিক স্বাদ পাওয়া যায়।
রান্নার দর্শন নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘আমার মতে, রান্না পেশা নয়, এটি ভালোবাসা থেকে করতে হয়। আপনি নিজে পছন্দ না করলে সেটা অন্য কারো জন্যও উপযুক্ত হবে না।’
আমার লক্ষ্য হচ্ছে—সহজ, উপভোগ্য ও অর্থবহ খাবার তৈরি করা। যেমন এই আয়োজনে আছে, ম্যাংগো মার্গারিটা পিৎজা, ম্যাংগো সালসা রোল, স্পাইসি ম্যাংগো মুজসহ জাপানি স্টাইলের ফ্রাইড চিকেন—যেখানে একটু ঝাল, একটু মিষ্টি, আর টেক্সচারে বৈচিত্র্য থাকবে।
ভালো শেফ হওয়ার মন্ত্র সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় বললেন, খাবার যেন অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল না হয়—এটা খাওয়ার জন্য, বোঝার জন্য সহজ হওয়া উচিত।
রন্ধনের রসায়ন নিয়ে থাই শেফ আফিথাক উইথোজিতের চিন্তা বলে দেয় খাবার কেবল উদরপূর্তির জন্য নয়, এতে মিশে থাকে স্বাদের গল্প আর রন্ধনশিল্পীর ভালোবাসা।
ছবি: হাল ফ্যাশন ও শেফ ম্যাকের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল