বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা এখন কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের নয়, আত্মিক শক্তি, ব্যক্তিত্ব আর সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার অঙ্গীকারও। সে কথাই দ্ব্যর্থহীনভাবে জানান মিস ইউনিভার্স আমেরিকাজ ও মিস পেরু ২০২৪ তাতিয়ানা কালমেল।
তাতিয়ানা আন্দ্রেয়া কালমেল দেল সোলার ওর্তেগা পেরুর একজন অভিনয়শিল্পী, মডেল, সমাজকর্মী। ২০২৪ সালে মিস পেরু নির্বাচিত হন এবং একই বছরে মিস ইউনিভার্স ২০২৪-এ দেশের প্রতিনিধিত্ব করে মিস ইউনিভার্সের সেরা ১২তে স্থান করে নেন। তাঁর অসাধারণ উপস্থিতি ও প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রথমবারের মতো কোনো পেরুভিয়ান নারী হিসেবে মিস ইউনিভার্স আমেরিকাজ ২০২৪ উপাধি লাভ করেন। পেরুর ইউনিভার্সিটি সান মার্টিন দ্য পোরেসে কমিউনিকেশন সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন।
তাতিয়ানার ক্যারিয়ার শুধু র্যাম্পে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি সমাজসেবায়ও নিয়োজিত। নারী অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্য এবং তরুণদের সচেতনতার বিষয়ে কাজ করাকে তিনি নিজের দায়িত্ব হিসেবে মনে করেন। ১৯৯৪ সালের ২২ জুলাই জন্ম নেওয়া এই সুন্দরী তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। সেই উপলক্ষে ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের পদ্মা হলে ৭ মে আয়োজিত হয় বিশেষ সংবাদ সম্মেলন। সংবাদ সম্মেলনে তাতিয়ানা উপস্থিত হন কাউল নেকের জেট ব্ল্যাক মিডি ড্রেসে। কোমরে ছিল কালো স্টেটমেন্ট বেল্ট, কানে ছিল সোনালি ইয়াররিং। মিনিমাল সাজেও তাঁর উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছিল এক আলাদা আভা। সবচেয়ে নজর কাড়ে তাঁর ডান হাতে বাঁধা বেলি ফুলের মালা। সেটাই যেন হয়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক সৌজন্যের এক মোহনীয় প্রতীক।
সদা হাস্যোজ্জ্বল তাতিয়ানার বন্ধুসুলভ আচরণ বলে দিচ্ছিল কেন তিনি মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে সেরা ১২তে জায়গা করে নিতে পেরেছেন। সম্ভাষণের পর করমর্দন, তারপর আন্তরিক আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় হৃদয় উষ্ণ করা আলাপচারিতা।
আপনাকে বাংলাদেশে স্বাগত, কেমন লাগছে ঢাকায়—এমন প্রশ্নের জবাবে তাতিয়ানার জানান, ‘খুবই চমৎকার। এখানকার মানুষ খুবই বন্ধুসুলভ আর অতিথিপরায়ণ। সবাই হাসিমুখে আমার সঙ্গে ভাব বিনিময় করছে।’ বললেন, ‘দারুণ উপভোগ করছি আমি। আরও তিন দিন থাকব। এর মধ্যে আমি আরও জানতে চাই বাংলাদেশের মানুষ ও এখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে।’
(তাতিয়ানার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল ৭ মে। এরপর আরও তিন দিন ছিলেন তিনি ঢাকায়।)
তাতিয়ানার কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু বিষয় জানতে চেয়েছিলাম, যেটা অনেকেই জানে না। এই প্রশ্নে বেশ পুলকিত হলেন। বললেন, ‘পেরুভিয়ান হিসেবে আমরা খেতে এবং রাঁধতে ভালোবাসি। যদিও কাজের সূত্রে অনেক ভ্রমণ করতে হয়। বাসায় কম থাকা হয়, তবে যখনই সুযোগ পাই আমি রান্না করি। আমি লিখতে ভালোবাসি। তবে সেটা খুব ব্যক্তিগত পর্যায়ে। এই দুটো কাজকে আমার আত্মিক আনন্দের জায়গা বলতে পারেন।’
কিশোর বয়স থেকেই মিডিয়ায় কাজ করতে চেয়েছেন। তাই বললেন, ‘মডেলিং শুরু করি ১৬ বছর বয়সে। অনেক দূর যাওয়ার পর মনে হয় আমি আরেক ধাপ এগোতে চাই।’ তাহলে অভিনয়ের শুরু কীভাবে? এই প্রশ্নে সহজ উত্তর তাঁর, ‘২০১৯ সালে একটি টিভি সিরিজ দিয়ে আমার অভিনয়জীবনের শুরু। তবে আমার প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২০২৪ সালে। এভাবেই আমি ধীরে ধীরে এই অভিনয়ে আমার অবস্থান দৃঢ় করতে থাকি।’
সঙ্গে যোগ করলেন, ‘মিস পেরুর শিরোপা জিতেছি ২০২৪ সালে। মিস ইন্টারন্যাশনালে পেরুর প্রতিনিধিত্ব করে দ্বিতীয় রানারআপ হই। বড় কিছু করতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকেই পেরুর প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিই মিস ইউনিভার্স ২০২৪–এ। আর সেরা ১২তে উন্নীত হয়ে জিতে নিই “মিস ইউনিভার্স আমেরিকাজ” খেতাব। মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রথম পেরুভিয়ান নারী হিসেবে এই খেতাব আমার জন্য দারুণ গর্বের। কারণ, এর সঙ্গে আমার দেশের সম্মান জড়িয়ে আছে।’
হলিউডের মেরিল স্ট্রিপ তাঁর খুব পছন্দের অভিনয়শিল্পী, জানিয়ে বললেন, জনি ডেপের অভিনয় তাঁর খুব ভালো লাগে। সাবেক মিস ইউনিভার্স, অভিনয়শিল্পী গ্যাল গাদতকেও তাঁর ভীষণ ভালো লাগে। আরও অনেক অভিনয়শিল্পী আছেন, যাঁরা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন।
লাতিন অভিনয়শিল্পী, বিশেষ করে পেরুভিয়ানদের হলিউডে উপস্থিতি খুব কম। তবু আশাবাদী তাতিয়ানা। কারণ, ইন্ডাস্ট্রি বড় হচ্ছে, আরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
এমন চমৎকার ফিগারের অধিকারীর ফিটনেস রহস্য না জানাটাই হবে বোকামি। আর এ প্রশ্নের উত্তরে কোনো রাখঢাক না করেই তাতিয়ানা জানালেন, ভালো ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার সময় ব্যস্ততা ছিল তুঙ্গে, তখনো তিনি চেষ্টা করেছেন ঘুমাতে। কারণ, ভেতর থেকে সুন্দর থাকতে চাইলে পর্যাপ্ত ঘুম একান্ত প্রয়োজন। আরও জানালেন, তাঁর স্কিনকেয়ার রুটিনে কোনো জটিলতা নেই। সারা দিন নিজেকে হাইড্রেটেড রাখাটাই তাঁর মূলমন্ত্র।
‘আমি প্রচুর পানি পান করি, যা ত্বককে সতেজ রাখে, বয়সের ছাপ দূরে রাখে। আর সব সময় ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করি, যা মানসিক চাপমুক্ত রাখে’, সঙ্গে যোগ করলেন আত্মবিশ্বাসী তাতিয়ানা।
তাতিয়ানার মতে, শরীর ও মন দুটো সুস্থ থাকলে তবেই আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।
সংগীত তাতিয়ানার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই গান নিয়ে প্রশ্ন করতেই উচ্ছল হয়ে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘আমি রেগে মিউজিক খুব ভালোবাসি।’ তাঁর মতে, রেগে শুধুই সুর নয়, এটি ভালোবাসা ও মানবিকতার এক অনন্য বার্তা দেয়। রেগে গানের লিরিকে যে সম্মানবোধ থাকে, মানুষের প্রতি যে শ্রদ্ধা ছড়িয়ে পড়ে, সেটা ছুঁয়ে যায় তাতিয়ানাকে। তাই তো কিংবদন্তি বব মার্লেই তাঁর প্রিয় শিল্পী।
লাতিন নারীদের সৌন্দর্যের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, এর আসলে কোনো রহস্য আছে? এমন প্রশ্নে বেশ সপ্রতিভ তাতিয়ানা বললেন, ‘আত্মিক শক্তি আমাদের ভেতর থেকে সুন্দর করে। আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হই নানা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে। যেখানে মূল উপাদান নাচ, গান, আনন্দ, খেলাধুলা। লাতিনরা জাতিগতভাবে খুবই বহির্মুখী চটপটে প্রচুর হাসিখুশি থাকে; যা আমাদের সব সময় উজ্জীবিত রাখে। আমি খুবই গর্বিত যে আমি একজন স্প্যানিশভাষী ও পেরুভিয়ান। এই খেতাব জিতে সারা পৃথিবী ঘুরে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা আমার কাছে স্বপ্নের মতো।’
মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে তাতিয়ানার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিল ন্যাশনাল কস্টিউম পর্বে। ‘সেখানে আমি পেরুর কুস্কোর আইকনিক স্থান “লা পোর্তেকে” পোশাকের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এটা পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক পর্যটক আসেন পেরুতে আমাদের দারুণ সব প্রাচীন নগরী আর স্থাপত্য দেখতে। সেগুলো পেরুভিয়ান হিসেবে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরা ছিল অনেক বেশি আনন্দের।’
‘আমি কোথাও গিয়ে যখন বলি আমি পেরুভিয়ান। সবাই খুশি হয়ে বলে তোমাদের খাবার খুব মজার। দারুণ সব দেখার জায়গা আছে। এই প্রশংসা আমাকে খুব আনন্দ দেয়। পেরুর মানুষ খুবই বন্ধুসুলভ বলেই সবাই পেরু ভ্রমণ করতে ভালোবাসে’, বেশ আনন্দ নিয়ে বলছিলেন তাতিয়ানা। বলছিলেন, ‘যেখানেই যাই চেষ্টা করি নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে।’
তাতিয়ানার পছন্দের ভ্রমণ গন্তব্য হাওয়াই। দুবার গেছেন সেখানে। বারবার যেতে ইচ্ছা করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো এই দ্বীপ তাঁর মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। তাই বেশ জোর দিয়েই বললেন, ‘যাঁরা ঘুরতে ভালোবাসেন, তাঁদের জীবনে একবার হলেও হাওয়াই ঘুরে আসা উচিত।’
খেতে আর রাঁধতে ভালোবাসেন তিনি। আগেই সেটা বলছিলেন। তবু পছন্দের খাবারের প্রসঙ্গে বললেন, ‘তালিকার শীর্ষে থাকে পেরুভিয়ান খাবার। পাহাড়ঘেরা অঞ্চল বলে আমাদের দেশের প্রতিটি প্রদেশের মাটির বৈশিষ্ট্য আলাদা। একেকটি প্রদেশে মেলে একেক ধরনের স্বাদ। আলু, শাকসবজি কিংবা প্রাণিজ খাদ্য—সবকিছুই অর্গানিক, যা খাবারের স্বাদকে করে তোলে অনন্য।’
মিস ইউনিভার্সে অংশ নেওয়ায় আপনাকে এখন বিশ্বের সব নারীর প্রতিনিধি বলা চলে। নারীর ক্ষমতায়নে আর আত্মশক্তিতে বলীয়ান হবার জন্য কেবল একজন নারী নয়, মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে যাতে দাঁড়াতে পারে সে জন্য নারীদের প্রতি কী বার্তা দিতে চান?
‘আসলে অনেক কিছু বলার আছে। তবে এই মুহূর্তে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, বিনয় আপনাকে সবকিছু জয় করার শক্তি দেয়। আপনি একজন চিকিৎসক, একজন মা কিংবা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিজয়ী হতে পারেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কতটা নিজেকে জানেন, আত্মিকভাবে নিজের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন সেটা। এই সংযোগই আসল শক্তি এনে দেয়।
আমি যা সেটাই দেখিয়েছি, কোনে ভণিতা করিনি। আর সেটাই আমাকে দিয়েছে ভালোবাসা, দিয়েছে সম্মান। তাই আমি সব মেয়েদের বলতে চাই, নিজেকে হারাবেন না। নিজের সত্যিকারের রূপই সবচেয়ে বড় শক্তি। মেকিত্ব নয়, প্রকৃত আমিতেই লুকিয়ে আছে আপনাদের বিজয়; সেটা যেকোনো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা জয়ের চেয়ে বেশি আনন্দ দেবে আপনাকে।’
ছবি: ইন্সটাগ্রাম ও সংগ্রহ