আবেগ, ভালোবাসা, মনোযোগ, যত্ন আর স্পর্শের সমন্বয়ে লেখা হয় চিঠি। তাই তো আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও আবেদন প্রেমিকের, পত্র দিও আবদার, চিঠি দিও প্রতিদিন চাওয়া প্রেমিকার। শুধু কি তাই! প্রযুক্তির উৎকর্ষের আগে সবার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমই তো ছিলো চিঠি।
কী যে মাদকতা আছে চিঠিতে! অনুভূতিগুলো আমরা প্রিয়জনকে সামনাসামনি যতটা বলতে পারি, তার চেয়ে বেশি পারি লুকিয়ে বলতে। তাই তো চিঠির সমাদর কমে গেলেও, চিঠির প্রতি আকর্ষণ কমেনি কারো। মুঠোফোনের কুইক মেসেজ পাঠানোর এত শত অ্যাপ থাকার পরেও প্রিয়জনের হাতে লেখা চিঠির আবেদন অন্যরকম।
কাগজে, কলমে, হাতে না লেখা হলেও সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া চিঠি ডট মি অ্যাপটি কিন্তু জানান দেয় চিঠির প্রতি আকর্ষণের । এই পর্যন্ত প্লে স্টোর থেকে ১০লাখ বার ডাউনলোড করা হয়েছে অ্যাপটি। নাম না জানিয়ে মনের কথা বলা যায় তাই আরও বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে 'চিঠি ডট মি'।
এই অ্যাপের স্রষ্টা সাজিদ হাসান নিজে 'চিঠি ডট মি' থেকে কাউকে বেনামি চিঠি পাঠিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে হেসে বলেন, 'হ্যাঁ। বন্ধু-বান্ধবকে, সিনিয়রদের ও কাছের মানুষদের চিঠি পাঠিয়েছি। আমি অনেকটা ইন্ট্রোভার্ট। সামনাসামনি অনেককে অনেক কিছুই বলা হয়। বেনামে না বললে কোনো দিন বলাও হবে না। তাই অনেক পছন্দের মানুষকেই এমন চিঠি পাঠিয়েছি।'
চারটি ভিন্ন ফন্ট ও কাগজের স্টাইল সবাইকে মুগ্ধ করেছে। চিঠিগুলো দেখতে অনেকটাই পুরনো দিনের কাগজের আদলে ডিজাইন করা। ফন্টগুলো পুরনো টাইপরাইটার আর ফাউন্টেনপেনের লেখার মতো। এই পুরনো আমেজ অনেককে স্মৃতিকাতর করেছে। সেই সঙ্গে পুরো ব্যাপারটির সঙ্গে জুড়ে থাকা অ্যাস্থেটিক বিষয়টি তো আছেই। সাজিদ নিজেও খুব স্মৃতিবিলাসী ও অতীতচারী। ভালোবাসেন সাহিত্য। চিঠিতে যে আবেগ, মনোযোগ ও যত্ন থাকে সেই জিনিসগুলোই সাজিদকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই ব্যাপারগুলোই তুলে আনতে চেয়েছেন সাজিদ, তবে ডিজিটালি। আর চিঠির প্রতি এই তরুণের টান ছোটকাল থেকেই।
'আমার বড় ভাইয়া পড়তো ক্যাডেট কলেজে। আমি তখন খুব ছোটো। আমার আব্বু আম্মুকে দেখতাম ভাইয়াকে চিঠি লিখতে। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তখন আমিও ভাইয়াকে চিঠি লেখা শুরু করি। কাঁচা হাতের লেখা। আমি আর বোন দুজন মিলে ভালো চিঠি লেখার চেষ্টা করতাম। আমাদের যোগাযোগ হতো চিঠি দিয়েই। সেই থেকে আমার চিঠির ওপর একটা ফ্যাসিনেশন রয়ে গেছে। চিঠি পাঠানোর পর শুরু হতো তার উত্তরের অপেক্ষা। এই সময়টুকু কাটত চিঠির সম্ভাব্য উত্তরের জল্পনাকল্পনা করে। তাই এই কুইক মেসেজিংয়ের যুগে কি যেন একটা মিসিং মনে হতো আমার। একটা চিঠিতে যতটা ভাবনা-চিন্তা, যত্ন, ভালোবাসা থাকতো, তা আমাদের বর্তমান যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নেই। এই ভাবনা থেকে এই অ্যাপ তৈরির কথা মাথায় আসে' বললেন সাজিদ।
শুনতে অবাক লাগলে সাজিদ এই অ্যাপটি তৈরি করেছেন তাঁর টার্ম ফাইনাল চলাকালীন। পরীক্ষার গ্যাপে গ্যাপে অল্প অল্প করে ডিজাইন করেছেন অ্যাপটি। এ গল্প বলতে গিয়ে সাজিদ হেসে ফেলেন। তিনি বলেন, অ্যাপটি বানানো শুরু করেছি টার্ম ফাইনালে । প্রোগ্রামিং আর কোডিং করতে ভালো লাগে আমার। আসলে দুই পরীক্ষার মাঝে গ্যাপ থাকে তো। সেই সময়গুলোতে পড়াশোনা তেমন করা হয় না। যাই হোক, সেই ফাঁকে ফাঁকেই আমি এই অ্যাপটি ডিজাইন করি।
নভেম্বরের শুরুর দিকে কাজ শুরু করেন আর ১০ তারিখ প্লে স্টোরে লঞ্চ করেন অ্যাপটি। সাজিদ ভেবেছেন অ্যাপটি শুধু বন্ধু-বান্ধবরাই মজা করে ব্যবহার করবেন৷ কিন্তু এটি এত সাড়া ফেলবে তা কল্পনাই করেননি তিনি।
চিঠিগুলো বেনামি কেন রাখা হলো জানতে চাইলে সাজিদ বলেন, আসলে এমন অনেক কথাই থাকে যা সরাসরি বলা হয়ে ওঠে না। বা যাকে বলতে চাই তার কাছে পরিচয়টা জানাতে চাই না। এই দূরত্ব দূর করতেই আসলে বেনামে চিঠি লেখার সুযোগ রাখা।
নাম দেখা যাচ্ছে না এই সুযোগ নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করছেন, এই ব্যাপারে সাজিদের ভাবনা জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, 'তিনি চেষ্টা করছেন চিঠি ডট মি-তে আরও কিছু ফিচার যোগ করার। যার একটি হবে নেতিবাচক কোনো চিঠি হলে সেটি ব্লক করার অপশন রাখা। এছাড়াও লগ আউট ফিচার যোগ করা আর আই ফোনের জন্য অ্যাপটি প্রোগ্রামিং করার চেষ্টা করছেন সৃজনশীল সাজিদ।
তবে চিঠি ডট মি এর ফন্টগুলো নিয়ে সাজিদ জানান, এগুলো আসলে তাঁর ডিজাইন করা নয়। ফন্টগুলো লিপিঘর এর সৃষ্টিশীল ডিজাইনাদের কাছ থেকে নিয়েছেন সাজিদ। তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।
শুধু 'চিঠি ডট মি'ই নয়, এই তরুণ এর আগেও এমন ট্রেন্ড তৈরির মতো বেশ কিছু কাজ করেছেন। ২০২২সালে তাঁর সুপারহিরো ব্যাটম্যানকে নিয়ে একটি প্রজেক্ট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাড়া ফেলেছিল। অ্যাপটির নাম ছিল ব্যাটনেম জেনারেটর। এই ব্যাটনেম জেনারেটরে যেকোনো শব্দ দিলে তা ব্যাটম্যান থিমে টাইপোগ্রাফি করে দিতো। মাত্র দুই তিন ঘণ্টায় বানানো এই অ্যাপ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছিল। এমন আরো বেশ কিছু কাজ করেছেন যন্ত্রকৌশল নিয়ে পড়া এই মেধাবী হবু প্রকৌশলী। কলেজে থাকাকালীন ছবির উপর বাংলা লেখা যায় এমন একটি অ্যাপও তৈরি করেছিলেন। সেটিও ১০লাখের বেশি ডাউনলোড হয়েছিল।