অবাক ভালোবাসায় চার দশকে পেরিয়ে স্টাইলিশ ব্যান্ড ওয়ারফেজ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

সেটা আশির দশক। সারা বিশ্ব রক আর মেটাল মিউজিকের জোয়ারে ভাসছে। কুইন, ভ্যান হেলেন, দ্য রোলিং স্টোন, জার্নি, ডেফ লেপার্ড, ডায়ার স্ট্রেইটসের মতো সব ব্যান্ড মাতাচ্ছে বিশ্বব্যাপী তরুণদের। কেবল সংগীত নয়, তাদের ফ্যাশন, স্টাইল সবকিছুই আলোড়িত করছে সবাইকে।

সেসব হারানো দিন
সেসব হারানো দিন

সে সময় বাংলাদেশে আবির্ভাব হয় এক কালজয়ী ব্যান্ডের। শুরু ৬ জুন ১৯৮৪। এর পর থেকে চার দশকজুড়ে তারা মাতিয়ে যাচ্ছে চার প্রজন্মের সংগীতপ্রেমীদের। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত তরুণদের মধ্যে বাংলা ভাষার রক ও মেটাল গানকে জনপ্রিয় করা, সর্বজনীনভাবে বাংলা রক গানকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অবদান অপরিসীম।

বিজ্ঞাপন

নব্বই দশকের যে কিশোর কানে ওয়াকম্যান দিয়ে তাদের গান শুনে বড় হয়েছে, ২০২৪ সালে এসে তাঁর ছেলে বা মেয়ে সেই একই গানে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। অবাক ভালোবাসার আবেশে তারা সুরের মায়ায় দোলাচ্ছে ৪০ বছর ধরে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন, ওয়ারফেজের কথাই বলছি। শুধু গান নয়, ওয়ারফেজের স্টেজ পারফরম্যান্স থেকে শুরু করে জনসম্মুখে যখনই এসেছে তাদের নিজস্ব স্টাইল, সেটা ছিল অনন্য।

কনসার্টে ওয়ারফেজ
কনসার্টে ওয়ারফেজ

রক মিউজিকের সঙ্গে কী ধরনের স্টাইল করছি বা কোন পোশাক পরা হচ্ছে, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন শেখ মনিরুল আলম টিপু। তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা সেটা মাথায় রাখতাম। আমাদের সব পোশাকই ছিল কালো; একদম শুরু থেকেই। সেই সঙ্গে সব সদ্যস লম্বা চুল রাখতেন। যদিও এখন আমি, কমল আর রজার ছাড়া বাকিরা চুল ছোট করে ফেলেছেন। আসলে লম্বা চুলের যত্ন নেওয়া ঝক্কির। চুল পড়ে যায়। তাই অনেকেই রাখতে পারেননি। আমি রেখেছি অনেক কিছু ত্যাগ করেই। আমি ধরে রাখার চেষ্টা করছি সেই ঐতিহ্য।’

বিজ্ঞাপন

ওই সময়ে কোন ব্যান্ড বা কোন শিল্পীর ফ্যাশন, স্টাইল আর গান ভালো লাগত, প্রভাবিত করত? এই প্রশ্নে শেখ মনিরুল আলম টিপু বলেন, ব্ল্যাক সাবাথ, মেটালিকা, স্করপিয়নস, আয়রন মেইডেন, লেড জেপেলিন, হোয়াইট স্নেক, ডেভিড ক্যাপাডেল ইত্যাদি ব্যান্ড ও তাদের মিউজিশিয়ানদের গান, স্টাইল আর স্টেজ পারফরম্যান্স ভালো লাগত।

কালো জিনস সিগনেচার এই ব্যান্ডের
কালো জিনস সিগনেচার এই ব্যান্ডের

আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের গোড়ার দিকে ‘ব্ল্যাক জিনস’ খুব একটা পাওয়া যেত না। সে কারণে লন্ড্রিতে গিয়ে নীল বা গাঢ় নীল জিনসকে কালো রং করিয়ে তাঁরা পরতেন। তখন লন্ড্রিগুলো প্যান্ট রং করে দিত। মূলত লিভাইস, র‍্যাংগলার, লি ইত্যাদি ব্র্যান্ডের জিনস পরা হতো। শার্ট ও টি-শার্ট তাঁরা পরতেন র‍্যালফ লরেন, পোলো, লাকস্তে, নো ফিয়ার, নরসপোর্ট ইত্যাদি ব্র্যান্ডের।

তখন তাঁরা ননব্র্যান্ড কিছু পরতেন না বলে জানান শেখ মনিরুল আলম টিপু। বরং বলেন, ‘দেখা যেত যে কমল, বাবনা, রাসেল, আলোরা দেশের বাইরে গেলে ব্যান্ডমেটদের জন্য কালো জিনস আর শার্ট নিয়ে আসতেন। এ ছাড়া অ্যাডিডাস, পিউমা আর নাইকি পরতাম আমরা। আমি এখনো পরি।’

প্রথম ও দ্বিতীয় অ্যালবাম
প্রথম ও দ্বিতীয় অ্যালবাম

নিজেদের অ্যালবামের ফটোশুট প্রসঙ্গে টিপু বলেন, ‘প্রথম অ্যালবামের কোনো কভার ফটো ছিল না। দ্বিতীয় অ্যালবামের জন্য ফটোশুট করা হয়। সে সময় যাঁর বাসায় যা পোশাক ছিল, নিয়ে আসা হলো। কমল দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসতেন। এ ছাড়া শুটের জন্য পোশাক কেনাও হতো। মূলত কালো রংকে মাথায় রেখেই সবাই পোশাক পরতাম। এ ছাড়া ফটোগ্রাফারও নির্দেশনা দিতেন। সেভাবেই ফটোশুট করা হতো। মূলত খালিদ আসিফ বেশীর ভাগ ছবি তুলেছিলেন তবে ডেভিড বারিকদার ছিলেন অবাক ভালোবাসা অ্যালবামের ফটোগ্রাফার।

নিজের স্টাইল প্রসঙ্গে টিপু বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে কানে মেটালের দুল পরছি। পিয়ারসিং করিয়েছি ২৪ বছর হয়ে গেল। আইরিশ ক্যাপ আর সানগ্লাস পরছি এবং ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি রেখেছি বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন লুক আনতে।’

অন্যান্য অনুষঙ্গ বলতে ওয়ারফেজের সদস্যরা হাতে রিস্ট ব্যান্ড ও ব্রেসলেট এবং গলায় চেইন পরেন। প্যান্টেও লাগিয়ে নেন চেইনের মতো বিভিন্ন শৌখিন উপকরণ। কারণ, এসব অনুষঙ্গ রক গান আর স্টেজ পারফরম্যান্সে গুরুত্বপূর্ণ বলেই অভিমত টিপুর।

২০০০ সালের গোড়ার দিকে ওয়ারফেজের নিজেদের মারচেন্ডাইজার প্রডাক্ট চলে আসে। তখন থেকে সেগুলো পরেই পারফর্ম করা হয়। ‘কালো টি-শার্ট, ব্লু জিনস, হাতাকাটা বা হাফহাতা জ্যাকেট পরি এখন,’ যোগ করলেন তিনি।

কোক স্টুডিওতে ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটি ভিডিও করার সময়কার অভিজ্ঞতাও জানান টিপু, মেকআপ এমনিতে টিভি অনুষ্ঠান বা মিউজিক ভিডিও শুটের সময় করতে হয়। কারণ, পর্দায় সুন্দরভাবে উপস্থাপনার একটি বিষয় আছে। কিন্তু লাইভ পারফরম্যান্স অর্থাৎ কনসার্টে কখনোই মেকআপ করা হয় না। তিনি বলেন, মেকআপ করাটা বেশ ঝক্কির; তার ওপর মেকআপ ওঠাতেও কষ্ট হয়। সার্বিকভাবে কোক স্টুডিওর অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। মজা করেই বলেন, ‘৪০ বছরে সব সময় কালো পোশাক পরে পারফর্ম করেছি। এই প্রথম সাদা পোশাকে পারফর্ম করা হলো। কোক স্টুডিও সেটা করিয়েছে।’

কোক স্টুডিও সাদা পোশাকে
কোক স্টুডিও সাদা পোশাকে

অনেক ব্যান্ডই এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকে না; কিন্তু ওয়ারফেজ চার দশক ধরে আছে। এই টিকে থাকার পেছনের গল্পটাও তো জানা দরকার। এ প্রসঙ্গে টিপু বলেন, ‘মূল হচ্ছে ধৈর্য আর হাল না ছাড়া। কমল, বাবনা ও রাসেল উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে চলে যান। নব্বইয়ের সময় আমি বলেছিলাম, যা কিছু হোক, এই ব্যান্ড আমি চালিয়ে যাব। অনেক সদস্যই বিভিন্ন কারণে ব্যান্ড ছেড়ে গেছেন; কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছি। এই ধরে রাখার ইচ্ছাটাই মূল চালিকাশক্তি। স্বপ্ন দেখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ; সেটা ছিল বলেই পরিবার, বন্ধু আর প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়ে এখনো টিকে আছে ওয়ারফেজ।’

নতুন অনেকেই ওয়ারফেজের গান কাভার করছেন। এটাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে টিপু বলেন, ‘নতুনেরা আমাদের গান করছেন, এটা খুব আনন্দের। তাঁরা ভালোবেসেই করছেন; এতে দোষের কিছু নেই। সবার গলা এক রকম নয়। সবার সক্ষমতাও এক রকম নয়। একেকজন একেকভাবে গাইবেন। তবে মূল গানটা ঠিক রেখে গাইলেই হলো।’

বাংলা রক গানের সোনালি সময়ে ওয়ারফেজ যে ধারা শুরু করেছিল, গানের ও স্টাইলের, সে ধারা টিকে আছে, বহমান আছে। থাকবে আরও অনেক অনেক দিন। জন্মদিনে অনিঃশেষ শুভকামনা তাদের জন্য।

ছবি: ওয়ারফেজ

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৪, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন