যুগে যুগে বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা, দেশের নাম সমুজ্জ্বল করে আমাদের গর্বিত করে থাকেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই। তাঁদের অর্জন ও সাফল্য আমাদের সবাইকে উচ্ছ্বসিত করে আর সেই সঙ্গে দেয় গৌরবের অনুভূতি। সম্প্রতি তেমনই এক সাফল্য পেয়েছেন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বসবাসকারী বাংলাদেশের মীর সাইদ। তিনি সম্প্রতি পেয়েছেন বেলজিয়ামের রাজপরিবারের পোশাকআশাক সামলানোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ আনুষ্ঠানিক সনদ। সাধারণত পাঁচ বছর কাজ করার পরই যাচাই-বাছাই করে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকেই এই সম্মাননা দেওয়া হয়।
২০২০ সালেই মীর এই স্বীকৃতি পেলেও অতিমারির কারণে অনুষ্ঠানটি কিছুদিন পর আয়োজিত হলো। সে দেশের ব্রাসেলসে অবস্থিত তাঁর বুটিক মীর কতুর এই সম্মননা পাওয়ার পর সে দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে একমাত্র হাল ফ্যাশনের কাছেই তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এই সুযোগে মীরের কাছ থেকে জেনে নেওয়া গেছে তাঁর জীবন ও সাফল্যের গল্প।
কর্মজীবনের একেবারে প্রথম দিকে স্বভাবজাতভাবেই মুক্তবিহঙ্গ প্রকৃতির মীর সাইদ প্রথমে একজন সুচিশিল্পী হিসেবে গিয়েছিলেন কুয়েতে। সেখান থেকে কাতার। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিধিনিষেধ আর একপ্রকার বন্দীজীবনের বেড়াজালে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। পরে আসেন ইউরোপ। প্রথমে ইতালি। সেখান থেকে ফ্রান্সে। তবুও যেন থিতু হতে পারছিলেন না। বিলেত যাওয়ার চিন্তা থেকে বেলজিয়ামে চলে এলেন মধ্যবর্তী গন্তব্য হিসেবে।
তবে বেলজিয়ামের নিরিবিলি জীবনের প্রতি ভালো লাগা থেকে এখানেই রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে গেলেন সেই ১৯৯৬ সাল থেকে। আগের কাজের অভিজ্ঞতা ধরে, ভাষাগত বাধা এবং তখন বেলজিয়ামে বাঙালি তেমন কেউ না থাকা ইত্যাদি বাধা পেরিয়ে পোশাক প্রস্তুতকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শুরু করেন কাজ। এখানে একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মচারী হিসাবে কাজ করতেন। সেখানে তৈরি হতো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক। একপর্যায়ে ২০০০ সালে লুই ভিতোর একটি অত্যন্ত এক্সক্লুসিভ ও ব্যয়বহুল পোশাকের কাজ করে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেন মীর সাইদ।
অন্য অনেকেই এই কাজটি করতে দ্বিধায় ভুগলেও তাঁর ভাষায়, বাঙালিদের অনেক সাহস; তা ছাড়া এত কঠিন সব পথ পেরিয়ে এসে তার মধ্যে আসলে ভয়ডর বলতে আর কিছুই বাকি ছিল না। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি করছেন জর্জিও আরমানি, হারমেস, দিওর, শ্যানেল, প্রাদা, গুচিসহ আরও সব বিখ্যাত ফ্যাশন হাউসের কাজ। আর সেই ১৯৯৮ সাল থেকে বিভিন্ন বুটিকের হয়ে বেলজিয়ামের রাজপরিবারের সদস্যদের পোশাকের ফিটিংয়ের কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি।
পরবর্তী সময়ে নিজের মেধা, দক্ষতা ও প্রচণ্ড পরিশ্রমের বদৌলতে যখন কাজের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের একটি জায়গা তৈরি হলো, তখনই বুটিকের মালিকের সঙ্গে কিছু নীতিগত বিরোধ ও আর্থিক বঞ্চনার শিকার হওয়া ইত্যাদি কারণে ব্রাসেলসের একটি ছোট দোকান ভাড়া নিয়ে নিজের বুটিকের কাজ শুরু করলেন মীর।
পূর্ববর্তী অর্জন ও সুনামের ফলে অল্প দিনের মধ্যেই বেশ কিছু কাজ পেয়ে যান। বিশ্ববিখ্যাত সব বুটিকের পোশাক তৈরি বা অলটারেশনের কাজ করার মধ্যে তাঁর ডাক পড়ে রাজপরিবার থেকে। রাজপরিবারের পোশাকের পরিকল্পনা, ডিজাইন এবং ফিটিং ঠিক করার গুরুদায়িত্ব পালন করা শুরু করেন তিনি। একপর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বা বিদেশ ভ্রমণকালে বেলজিয়ামের রাজপরিবার মীরের পরিকল্পায় তৈরি করা পোশাক পরতে লাগলেন।
২০১৪ সালে ভারত ভ্রমণে বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপের পরা ব্লেজারটি দিয়েই রাজপরিবারের পোশাকের সার্বিক দায়িত্ব সামলানোর সূচনা ঘটে। মেধাবী ও অত্যন্ত দ্রুত শেখার ক্ষমতাসম্পন্ন মীর ছেলেবেলায় পড়াশোনায় বেশি মন না দিলেও অত্যন্ত অল্প বয়সেই বিভিন্ন কারিগরি বিদ্যা এমনকি টেইলরিংয়ের কাজও শিখে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে কুয়েতে গিয়ে কিছুদিন এমব্রয়ডারি ও সেলাইয়ের কাজে আরও দক্ষতা বাড়িয়ে দেশে ফিরে আসেন কাজের পরিবেশ পছন্দ না হওয়ায়। অস্থির স্বভাবের মীর আবারও মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান। কাতারে। তারপরে শুরু হয় তাঁর ইউরোপযাত্রা।
তবে ব্রাসেলসে নিজের বুটিক শুরু করার পর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজস্ব সুনামের বদৌলতে কাজ করেছেন জর্জিও আরমানি, শ্যানেল, প্রাদা, লুই ভিতো, গুচি, হারমেসসহ সব নামী ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সঙ্গে। ডিজাইন, তৈরি এবং অল্টারেশনের কাজ করেছেন তাদের এক্সক্লুসিভ সব পোশাকের। বেলজিয়ামের রাজপরিবার ছাড়াও লুক্সেমবার্গ ও নেদারল্যান্ডসের রাজপরিবারের পোশাক ফিটিংয়ের কাজ করেছেন মীর।
ব্রাসেলসের মনোরম পরিবেশে স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা ও তিন কন্যাকে নিয়ে বসবাসরত মীরের জীবন নিয়ে কোনো রকম আফসোস নেই, বরং প্রাপ্তির পাল্লাটাই ভারী। প্রিয় ডিজাইনারদের তালিকায় আছেন জর্জিও আরমানি ও টম ফোর্ড। সাক্ষাৎও হয়েছে তাঁদের সঙ্গে।
তবে বললেন, বাংলাদেশে তাঁর কাজের খুব সুযোগ নেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে। তবু বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নামকে নিজের কাজের মাধ্যমে সমুন্নত করে তিনি আমাদের সবার শ্রদ্ধা ও শুভকামনার দাবিদার। মীর কতুরের হাত ধরে ইউরোপীয় ফ্যাশন দুনিয়ায় বারবার ধ্বনিত হোক বাংলাদেশের নাম।
ছবি: মীর সাইদের সৌজন্যে