বিজ্ঞাপন
গানের জুটি রঞ্জন ও সোহিনী

বাংলাদেশের জনপ্রিয় রক ব্যান্ড আরবোভাইরাসের গিটারিস্ট ও প্রাণপুরুষ রঞ্জন। আবার, বিলেত থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ফিউশন মিউজিক নিয়ে কাজ করে সাড়া জাগানো ‘ক্ষ’ ও ‘লক্ষ্মীট্যারা’ ব্যান্ডের সোহিনী আলম। সংগীত তাঁদেরকে জুড়ে দিয়েছে বিশ্বের দুই প্রান্ত থেকে। বন্ধুত্ব থেকে প্রণয় হয়ে পরিণয়। গান শুনিয়েই জিতেছেন একে–অপরের হৃদয়। একমাত্র সন্তান আরোহী আর গান নিয়েই আছেন এই সুখী দম্পতি। গানই তাঁদের ভালোবাসা, গানই জীবন। সম্প্রতি ছুটি কাটাতে এসেছিলেন ঢাকায়। সে সুযোগে তাঁদের মুখোমুখি হয়ে জেনে নেওয়া গেল কীভাবে তাঁদের সম্পর্কের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গান।

ব্যান্ড জগতে সবার প্রিয় রঞ্জন
ব্যান্ড জগতে সবার প্রিয় রঞ্জন
ছবি: সাইফুল ইসলাম

কথা বলতে বলতেই ব্যান্ড জগতে সবার প্রিয় রঞ্জন আনমনে গিটার বাজাচ্ছিলেন। জানালেন, তাঁর বেড়ে ওঠা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। বাবা ছিলেন বাংলাদেশের অগ্রগণ্য পদার্থবিদ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলী আসগর। মা ফরিদা বেগমও উদ্ভিদবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। তবু মিউজিকই ছিল তাঁর পরম আবেগের জায়গা। গিটারের প্রতি ছিল অদম্য আকর্ষণ।

বিজ্ঞাপন

হাসতে হাসতে স্মৃতিচারণা করেন, এসএসসি পরীক্ষার পর মায়ের কাছে কীভাবে বায়না ধরে রাজি করিয়ে গানের জগতের বড় ভাই, বিখ্যাত গিটারিস্ট ও মিউজিশিয়ান ইকবাল আসিফ জুয়েলের কাছ থেকে কিনেছিলেন তাঁর ব্যবহৃত ইবানেজ গিটারটি। সে সময় সেই গিটারটির দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা।

রঞ্জন তাই মা-বাবার এই উৎসাহ ও সহযোগিতার কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। জানান, সেই গিটারটির সঙ্গে গানের জগতে প্রথম পা রাখা। বাবাকে গিটারে টুংটাং সুর তুলতে দেখে কন্যা আরোহীও নিয়ে এল তার উকুলেলে। রঞ্জন বললেন, গতানুগতিক ধারার শ্রেডিং স্টাইলের বাইরে গিয়ে অলটারনেটিভ রক ও গ্রাঞ্জ স্টাইলের প্রতি ছিল তাঁর ভীষণ আগ্রহ। এই ঘরানার মিউজিশিয়ানদের সাহচর্যে বাজাতে বাজাতে ২০০১ সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গড়ে তোলেন রক ব্যান্ড আরবোভাইরাস।

বিজ্ঞাপন

আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে আরবোভাইরাস আর রঞ্জনকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। তবে সোহিনী এ পর্যায়ে জানান, বর্তমানে বিলেতপ্রবাসী রঞ্জন ইন্টারনেটের কল্যাণে দেশের তরুণ ব্যান্ড প্রজন্ম এবং নিজের ব্যান্ড পার্টনারদের সঙ্গে সব সময় যুক্ত আছেন। এবং সব সময় তরুণ মিউজিশিয়ানদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য সচেষ্ট থাকেন এবং রঞ্জনের এই ব্যাপারটি সোহিনীকে খুবই মুগ্ধ করে। বিলেতেও ‘অফেন্ড মাই ইগো’ নামে একটি ব্যান্ডের সঙ্গে আছেন রঞ্জন। ঘরে গিটারের বাক্সগুলো দেখে যখন গিটারের সংখ্যা জিজ্ঞেস করা হলো, জানালেন যেখানেই যান, তাঁর সব সময়ের সঙ্গী হয় তাঁর ১১টি গিটার।

সোহিনীর রক্তে রয়েছে সঙ্গীত
সোহিনীর রক্তে রয়েছে সঙ্গীত
ছবি: সাইফুল ইসলাম

আলাপচারিতার ধারাবাহিকতায় সোহিনী আলমের গল্পে চলে যাওয়া হলো। উল্লেখ্য, জন্মাবধি সংগীতের সাগরে ডুবে থাকলেও দেশের সংগীতপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত হয়ে ওঠেন ২০১২ সালের বিজয় দিবসে তার ব্যান্ড ক্ষ–এর ব্যতিক্রমী পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত গেয়ে। সোহিনী স্মৃতি হাতড়ে বলতে থাকেন শৈশবের সব গল্প। তাঁর নানা ছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ এইচ এম আবদুল হাই। অসম্ভব রকমের সংগীতানুরাগী এই মানুষটি যখন সোহিনীর জন্মসংবাদ পান, তখন নাকি তিনি রাগ সোহিনীই গাইছিলেন। এবং সে সূত্রেই সোহিনীর নামকরণ করেন তিনি। সোহিনী বলেন, নানা গানের মানুষ ছিলেন বলে খালা, মামাসহ তাঁর মা—সবাই গান গাইতেন। বসার ঘরে ছড়িয়ে থাকত তানপুরা, তবলা, হারমোনিয়াম, সেতার। মা হুর-ই-জান্নাত সংগীতের জগতে ডাকনাম হিরণ আলম নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। লন্ডনে বাংলা গান শেখাতেন। সেভাবেই বাংলা গানের হাতেখড়ি হয়েছে কিছু বুঝতে শেখার আগে৷ এরপর মাকে হারান ৯ বছর বয়সে। ফিরে আসেন বাংলাদেশে, নানাবাড়িতে।

কার কাছে গান শেখা জিজ্ঞেস করায় জানালেন, সেজো খালা জান্নাত আরা এবং ছোট খালা ফেরদৌস আরার কাছেই গানের পরবর্তী দীক্ষা নিয়েছেন। বললেন এক মজার তথ্য: অ্যালার্ম ক্লকের বদলে নাকি নানাবাড়িতে ঘুম ভাঙত টেপ রেকর্ডারে বেগম আখতারের গানের সুরে। মাকে বেশি দিন কাছে পাননি। তবে চাপা গৌরবমাখা হাসি বলে দিচ্ছিল, মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু আয়োজিত সংগীত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, খুব ভালো গান করতেন—এই গল্পগুলো যখন শুনতেন সবার কাছে, খুব ভালো লাগত তাঁর। আরও জানালেন, চাচি আভা আলমও ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের পরিচিত নাম। সোহিনী আলম বলেন, নিজের অজান্তেই তিনি সংগীতের সাগরে নিমজ্জিত ছিলেন জন্ম থেকেই। প্রখ্যাত শিল্পী ফেরদৌস আরার সঙ্গে যেতেন বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার, বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠান ও নজরুল একাডেমিতে। গলা মেলাতেন সুধীন দাস বা সোহরাব হোসেনের ক্লাসে সমবেত সংগীতে। সংগীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি আসলেই অবিচ্ছেদ্য।

রঞ্জন ও সোহিনী—দুজনেরই অসম্ভব রকমের প্রিয় লেড জ্যাপলিন
রঞ্জন ও সোহিনী—দুজনেরই অসম্ভব রকমের প্রিয় লেড জ্যাপলিন
ছবি: সাইফুল ইসলাম

নিজের বাড়ির সংগীতবান্ধব পরিবেশের ব্যাপারে রঞ্জনের ছোটবেলার এক মজার স্মৃতি হচ্ছে বাবা-মা লং প্লে রেকর্ডে গান শুনতেন আয়োজন করে। জানালেন, পাশ্চাত্য সংগীতই ছিল প্রথম পছন্দ। আবার এ প্রসঙ্গে সোহিনী বলেন, নানাবাড়িতে শুদ্ধ নজরুলসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীতই হতো সব সময়। তবে তিনি তাঁর মতো করে ইংরেজি গানও শুনতেন বড় হওয়ার পর। জানা গেল, রঞ্জন ও সোহিনী—দুজনেরই অসম্ভব রকমের প্রিয় লেড জ্যাপলিন। ব্যান্ডটির গিটারিস্ট জিমি পেইজের সম্মোহনী লাইভ পারফরম্যান্স দেখেছেন সোহিনী টেক্সাসে থাকতে। এই ব্যাপারে রঞ্জনের থেকে এগিয়ে থাকা নিয়ে সহাস্য খুনসুটি হচ্ছিল দুজনের।

দুজনই বললেন, রঞ্জন যেমন নিজের আগ্রহ থেকে অনেক পথ পেরিয়ে তবে মিউজিকের জগতে পা রেখেছেন, সোহিনীর ব্যাপারটি একেবারেই আলাদা। বললেন, তিনি তাঁর খালাদের দেখেই ভেবেছিলেন, এত সাধনা করে সংগীতচর্চা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়েছেন বিপণন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে৷ মজা করে বলেছিলেন, তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরীক্ষায় ফেল করলে গান করবেন পেশা হিসেবে। তাহলে আবার গানের জগতে কীভাবে ফিরে আসা—এ প্রশ্নের জবাবে সোহিনী বলেন, তাঁর জীবনে আবার সংগীত ফিরে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে। এরপর আবার লন্ডনে ফিরে গিয়ে তিনি নিজের মতো করে গান করা শুরু করলেন।

২০০৭ সালে যুক্ত হন আফ্রো-কিউবান জ্যাজ ব্যান্ড লক্ষ্মীট্যারার সঙ্গে
২০০৭ সালে যুক্ত হন আফ্রো-কিউবান জ্যাজ ব্যান্ড লক্ষ্মীট্যারার সঙ্গে
ছবি: সাইফুল ইসলাম

২০০৭ সালে যুক্ত হলেন কিষন খানের আফ্রো-কিউবান জ্যাজ ব্যান্ড লক্ষ্মীট্যারার সঙ্গে ভোকালিস্ট হিসেবে। একই সময় বাংলা গানের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী অলিভার উইকসের সঙ্গে গঠন করেন নিজের ব্যান্ড ক্ষ। আরও জানান, জিআরআরআরএল (GRRRL) নামে একটি ইলেকট্রনিক ব্যান্ডের সঙ্গেও যুক্ত তিনি। নিজেদের সংগীত ও সংস্কৃতিবিষয়ক কাজের জন্য কাছের বন্ধুদের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন নিজের কোম্পানি কমলা কালেক্টিভ। কাজ করছেন স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক নৃত্যশিল্পী আকরাম খানের সঙ্গেও। সামনেই আসছে ক্ষ–এর নতুন অ্যালবাম। এ নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত রঞ্জন ও সোহিনী দুজনই।

দুজন গল্পের ধারাবাহিকতায় জানান, কিউপিডের তির কবে কীভাবে লক্ষ্যভেদ করল দুজনের জীবনে। ২০০৯ সালে রঞ্জন একদিন রেডিওতে লক্ষ্মীট্যারা ব্যান্ডের ‘নদীর কূল’ গানটি শুনে একদম অভিভূত হয়ে পড়েন। তখনো জানতেন না কে গাইছেন এই গান। এ ব্যাপারটি শুনেই হেসে ফেললেন সোহিনী। এরপর নাকি আবার একদিন বন্ধু অনাবিলের গাড়িতে বৃষ্টির দিনে গানটি শুনে গায়িকার কণ্ঠের ব্যাপারে রঞ্জন মুগ্ধতা প্রকাশ করলে বন্ধু বলেন যে তিনি রোহিনীর বড় আপু সোহিনীকে খুব ভালো করে চেনেন এবং এটা তাঁরই গান। দেখা গেল রঞ্জনের প্রিয় বন্ধু, রিবর্ন ব্যান্ডের গিটারিস্ট চিশতীর ভাবি সোহিনীর ছোট বোন রোহিনী। সোহিনী এর সঙ্গে জানান, রঞ্জনের গানের জগতের আরেক বন্ধু, নেমেসিসের ভোকালিস্ট, জোহাদেরও বন্ধু রোহিনী। তবে গান শুনে মুগ্ধ হলেও এরও কয়েক বছর পর দেখা হয় রঞ্জন সোহিনীর। নিজেকে সে সময় সোহিনীর ফ্যানবয় বলে মজা করে পরিচয় দিলেন রঞ্জন। ফলশ্রুতিতে আবারও সোহিনীর হেসে গড়িয়ে পড়া।

সোহিনী অ্যান্ড লারে লাপ্পাজ যেন ছিল অনুঘটক
সোহিনী অ্যান্ড লারে লাপ্পাজ যেন ছিল অনুঘটক
ছবি: সাইফুল ইসলাম

আরোহীর উকুলেলে বাদন, লাফঝাঁপ চলছিল সঙ্গে সমান তালে। স্মৃতি ঘেঁটে সোহিনী জানালেন, পরে আবার দেখা হয়েছে কয়েকবার গানের সূত্রেই। রঞ্জন সোৎসাহে বললেন, ‘সোহিনী অ্যান্ড লারে লাপ্পাজ’ নামে সোহিনী গান গাইবেন এবং আরবোভাইরাসের সঙ্গে রঞ্জন বাজাবেন এমন একটি প্রজেক্ট নেওয়া হয় ২০১৩-১৪ সালে। সেই ধারাবাহিকতায় কথাবার্তা হওয়া, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা।

দুজনই স্বীকার করলেন, কাজ শেষে সোহিনী ফিরে যাওয়ার পরেই দুজন মনস্থির করেন একে–অপরের সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানোর। দুজনই বললেন, গানের প্রতি ভালোবাসা, গান নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা, একজন সংগীতশিল্পীর গানের প্রতি আবেগের জায়গা—এই বিষয়গুলোতে দুজন একধরনের হারমনি খুঁজে পান একে–পরের মধ্যে। সদা হাস্যময় এই জুটি জানালেন, ২০১৫–তে পরিণয়ে গড়ালেও এখনো রঞ্জন সোহিনীকে দোস্ত বলেই ডাকেন।

সোহিনী এখনও দোস্ত রঞ্জনের
সোহিনী এখনও দোস্ত রঞ্জনের
ছবি: সাইফুল ইসলাম

সংসার ও মিউজিকের ক্ষেত্রে দুজনেরই রয়েছে চমৎকার বোঝাপড়া। আরোহীর দেখভালও দুজন ভাগাভাগি করে করেন। সোহিনী খুব সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, রান্নায় রঞ্জন এখন ঈর্ষণীয় রকমের পারদর্শী। দুজনকে পাশাপাশি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, গানে, গল্পে, ভালোবাসায় এভাবেই কেটে যাচ্ছে রঞ্জন-সোহিনীর হাসিখুশি দিন। গানের বিনি সুতার মালায় তাঁরা গেঁথেছেন নিজেদের এক অটুট বন্ধনে।

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২২, ২১: ১৪
বিজ্ঞাপন
হাল ফ্যাশন