
পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার ১৪ বছর পরেও স্টিভ জবসকে নিয়ে আলোচনা যেন শেষ হয় না। কে না জানে যে এই কিংবদন্তি টেক জিনিয়াস স্টিভ জবস অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান এবং সিইও ছিলেন। ব্যক্তিগত কম্পিউটার প্রযুক্তির জগতে বিপ্লবের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি ম্যাকিন্টশ, আইপড, আইফোন এবং আইপ্যাডের মতো আইকনিক পণ্য তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অ্যাপলের বাইরে তিনি নেক্সট-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পিক্সারের চেয়ারম্যানও ছিলেন। অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তিনি ৫ অক্টোবর ২০১১ সালে ৫৬ বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর পরেও তিনি সবসময় প্রাসঙ্গিক এতগুলো বছর ধরে। তাঁর প্রযুক্তিজ্ঞান, ব্যাবসায়িক বুদ্ধি আর সাফল্যের মূলমন্ত্র নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলতে থাকে।

তবে মাঝে মাঝে এমন হয় যে পেশাগত জীবনে দক্ষতার শিখরে চলে যাওয়া ব্যক্তিরও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দুর্বল দিক থাকে। সফলতার দিক থেকে সকল সঠিক পদক্ষেপ নিলেও জীবনের পথে অনেক ভুল তাঁরা করেন। স্টিভ জবসের জীবনেও আছে এমন এক ধূসর দিক। কালোই বলা যেত একে যদি তিনি নিজের কন্যাকে কখনোই স্বীকৃতি না দিতেন, উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতেন বা তাঁর সঙ্গে পরবর্তীতে সম্পর্কই না রাখতেন। লিসা ব্রেনান জবস নামের এই কন্যাকে স্টিভ প্রথমে স্বীকৃতিই দিতে চাননি না দেননি।
তরুণ বয়সে যখন মাত্র টেক দুনিয়ায় নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছিলেন স্টিভ, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে বাবা হওয়ার খবরে বেশ উলটোপাল্টা পদক্ষেপ নেন তিনি। নিজেকে পিতৃত্বে অক্ষম বা স্টেরাইল হিসেবে প্রচার করার মতো হাস্যকর কাজও করেন তিনি পিতৃত্বের দায় এড়াতে। পরে পেশাগত জীবনের এক অদ্ভুত ঘতনার মাধ্যমেই উঠে আসে মেয়ের প্রতি তাঁর অনুভূতির কথা। আস্তে আস্তে বেশ পরে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাবা-মেয়ের। খুব কাছাকাছি না এলেও লিসা হয়ে যান স্টিভের জীবনের অংশ। টানাপোড়েনের এই অদ্ভুত গল্প অনেকেরই অজানা। চলুন আমরা বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া এই গল্পের টুকরোগুলোকে একসঙ্গে গাঁথার চেষ্টা করে স্টিভ জবসকে চিনতে চেষ্টা করি অন্য আলোয়।

লিসা ব্রেনান-জবস ও স্টিভ জবসের গল্পটি আসলে খুব জটিল। এক বাবা যিনি বহু বছর ধরে প্রকাশ্যে নিজের মেয়েকে স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিলেন, পরে আবার অসম, অনিয়মিত একটি সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কিছুটা পুনর্মিলন ঘটে। এই ইতিহাসটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে লিসার ২০১৮ সালের স্মৃতিকথা স্মল ফ্রাই বইয়ে। বাবা মারা যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে লেখা এই বইটি তাঁকে নিয়ে আসে লাইমলাইটে। কারণ স্টিভ জবসের এই রূপটি আসলেই অদেখা সকলের কাছে।
লিসার শৈশব ও পিতার প্রকাশ্য অস্বীকার

অনাকাঙ্ক্ষিত জন্ম
লিসা ব্রেনান জবস জন্মান ১৭ মে, ১৯৭৮ সালে। শিল্পী ক্রিস্যান ব্রেনান ও স্টিভ জবসের কন্যা তিনি। এই চাইল্ডহুড সুইটহার্ট জুটি স্কুলজীবন থেকে অনিয়মিতভাবে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। আর তারই ফসল লিসা। জবস তাঁর এই কন্যা জন্মের সময় উপস্থিত ছিলেন না এবং প্রথমে স্বীকারও করেননি যে তিনি লিসার বাবা। অবশ্য জানা যায়, জন্মের খবর শুনে তিনি মা-মেয়েকে দেখতে যান। এমনকি নামও রাখেন লিসার। কিন্তু তারপর তিক্ত প্রতিক্রিয়ায় জানান যে তিনি বিশ্বাস করেন না যে তিনিই এই শিশুর বাবা।
সংগ্রামের জীবন
অ্যাপল যখন মাত্র জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল, তখন ক্রিস্যান ও লিসাকে আর্থিক কষ্টে থাকতে হতো। তাঁরা সরকারি সাহায্যও প্রার্থনা করেছেন এক পর্যায়ে।
পিতৃত্ব মামলা ও অ্যাপলের আইপিও
সান ম্যাটিও কাউন্টি জবসের বিরুদ্ধে ভরণপোষণ মামলা করে লিসার জন্মের পর। জবস আবার সাক্ষ্যে দাবি করেন যে তিনি পিতা হতে অক্ষম অর্থাৎ স্টেরাইল ও ইনফার্টাইল। এদিকে আদালতের নির্দেশে করা ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায় লিসা তার মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা ৯৪ শতাংশ। এরপর আদালত তাঁকে সামান্য হলেও লিসার ভরণপোষণ দিতে বলে। বাধ্য হয়ে রাজি হন স্টিভ। মামলার ঠিক কয়েক দিন পর অ্যাপল শেয়ারবাজারে আসে এবং জবস মুহূর্তের মধ্যে বহু-মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে যান। তবুও তিনি নাকি লিসার ভরণপোষণ সামান্যই বাড়ান এত টাকার মালিক হয়েও।

অ্যাপল লিসা প্রকল্প
এক ধরনের অদ্ভুত ঘটনাই বলা যায় একে। লিসার জন্মের সময় অ্যাপল এই লিসা নামেই একটি কম্পিউটার তৈরি করছিল। বহু বছর জবস অস্বীকার করেন এই নামটি মেয়ের নামে, বরং Local Integrated System Architecture নামের একটি টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা দিতেন তিনি যার প্রথম অক্ষরগুলো মিলিয়ে লিসা নাম হয়। এক দশক পরে তিনি স্বীকার করেন যে এই আরাধ্য কম্পিউটরের নাম তাঁর মেয়ের নামেই দিয়েছিলেন তিনি। প্রখ্যাত শিল্পী বোনোর সঙ্গে নিজের ভিলায় এক কথোপকথনে এই কথা প্রকাশ করার পর আলোচনার ঝড় ওঠে লিসাকে নিয়ে। স্টিভ জবসের মেয়ে বলে কথা! আবার বাবা নিজেই মেয়েকে স্বীকার করেন না। সবাই বলতে লাগল, এ কেমন কথা! এ যেন স্টিভের মানবীয় গুণাবলির সঙ্গে ঠিক মেলেনা।
কঠিন পুনর্মিলন
স্টিভ জবসের বোন মোনা সিম্পসনের সহায়তায় এই তিক্ততাপূর্ণ বাবা-মেয়ে ধীরে ধীরে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ হন। লিসা হাইস্কুলে থাকাকালে মায়ের সঙ্গে বিরোধ হয় তাঁর। এ সময় তিনি অনেকদিন বাবার কাছে থাকেন।

মানসিক দূরত্ব ও কঠোর আচরণ
একই ছাদের নিচে থাকলেও লিসা স্টিভের দূরে দূরেই থাকতেন। বাবার স্নেহ পাওয়ার জন্য সবসময় চেষ্টা করতেন তিনি। কিন্তু প্রায়ই মিলত শীতল আচরণ, কটূক্তি। মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুর আচরণের মুখোমুখি হতেন লিসা বাবার কাছে। কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা লিসা জানিয়েছেন তাঁর বইয়ে।
নয় বছর বয়সী লিসা একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি স্টিভের পুরনো পোরশে গাড়িটা পেতে পারেন কি না। জবস নাকি তখন পুরোনো গাড়ি প্রায়ই দিয়ে দিতেন একে তাকে। অথচ মেয়ের চাওয়ার উত্তরে জবস বলেন, তুমি কিছুই পাচ্ছ না। বুঝেছ? কিছুই না।
তিনি প্রথমে মেধাবী লিসার হার্ভার্ডের পুরো টিউশন দিতে অস্বীকার করেন, ফলে লিসাকে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়। পরে অবশ্য অনুতপ্ত জবস সেই টাকা ফেরত দেন।
মাঝে মাঝেই স্টিভ তাঁর এই মেয়ে লিসাকে উপেক্ষা করতেন বা তাঁর প্রতি কটু মন্তব্য করতেন, ফলে লিসার মনে হতো সে বাবার নতুন পরিবারের বাইরে একজন অতিথির মতো।
শেষ সময়ের পরিণতি: ক্ষমা ও অনুশোচনা
ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় লিসা নিয়মিত বাবার কাছে যেতেন ও সময় দিতেন। অন্য ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখন। এই অবহেলিত, অস্বীকৃত, অনাকাঙ্খিত লিসাই ছিলেন স্টিভের পাশে। যত্ন নিতেন তিনি বাবার। মৃত্যুর আগে স্টিভ জবস সারা জীবন মেয়ের প্রতি অন্যায় আচরণের জন্য খুব অনুশোচনা প্রকাশ করেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি তোমার কাছে ঋণী।


লিসার স্মৃতিকথা
লিসার স্মল ফ্রাই বইটি তার শৈশবের নিখাদ ও ব্যক্তিগত বর্ণনায় ভরা, যেখানে জবসের প্রতিভার পাশাপাশি তার গভীর মানবিক ত্রুটিগুলোও উঠে এসেছে। তবে জবস পরিবারের অন্য অনেক সদস্য এক বিবৃতিতে বলেন যে বইয়ের বর্ণনা তাঁদের স্মৃতির থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন।
উত্তরাধিকার
লিসার শৈশবে আর্থিক সাহায্যে টানাপোড়েন থাকলেও, জবস শেষ পর্যন্ত লিসাকে তার অন্য তিন সন্তানের মতোই বহু-মিলিয়ন ডলারের উত্তরাধিকার দিয়ে যান। আর এতেই প্রকাশ পায় যে শেষ পর্যন্ত বাবার হৃদয়ে পরীক্ষিত স্থানটুকু কপালে জুটেছে অবহেলিত লিসার।
সব মিলিয়ে, লিসা ব্রেনান-জবসের এই অদ্ভুত ও অজানা গল্প হলো আত্মপরিচয়ের খোঁজ, পিতার ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা, এবং এমন এক প্রতিভাবান মানুষের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠার বাস্তবতা, যিনি পৃথিবী বদলে দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু পিতৃত্বের সাধারণ দায়িত্বগুলো সামলাতেই ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সূত্র: ভ্যানিটি ফেয়ার
ছবি: ইন্সটাগ্রাম