ইতালির সমৃদ্ধ শহর ভেনিসে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী, অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব লরেন সানচেজের বহুল আলোচিত বিলাসবহুল বিবাহোৎসব। তিন দিনের এই আয়োজনে বিলিয়নিয়ার অতিথি, প্রাইভেট ওয়াটার ট্যাক্সি, বিমান, থ্রি-মিশেলিন-স্টার ক্যাটারিং, বিলাসবহুল হোটেল এবং অতিথিদের জন্য ইতালির বিখ্যাত মুরানো কাচের উপহারসামগ্রী—সব মিলিয়ে রাজকীয় এক আয়োজন। তবে সব ছাপিয়ে মানুষের আগ্রহ—কত খরচ হয়েছে শতাব্দীর সবচেয়ে সেরা বিয়ের তকমা জেতা এই বিয়েতে। আদৌ কি এটা ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে আম্বানিদের আয়োজনকে?
৬ মাস আগে গুঞ্জন ছিল যে বেজোস-সানচেজের বিয়েতে ৬০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে। টাকার হিসাবে এর পরিমাণ ৭ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। তবে কিছুদিন পর সেটাকে গুজব বলেই উড়িয়ে দেন জেফ বেজোস। বিয়ের দিন যত কাছে আসতে থাকে, মানুষের আগ্রহ ততই বাড়তে থাকে। হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিয়ের আয়োজনগুলো সব গোপনীয়তার সঙ্গেই করা হয়েছে। তাই আসল খরচ জানার সুযোগও হচ্ছিল না।
তিন দিনের প্রাচুর্যপূর্ণ আয়োজন শেষে এখন জানা যাচ্ছে যে জাঁকজমকপূর্ণ হলেও আগের আনুমানিক খরচের তুলনায় কম খরচেই বিয়ের আয়োজন শেষ করেছেন বেজোস-সানচেজ যুগল। জনপ্রিয় বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের তথ্যমতে, বেজোস-সানচেজ দম্পতির এই রাজকীয় বিয়েতে খরচ হয়েছে অন্তত ২০ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা। তবে আয়োজনের চমক আর বাড়তি পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে এ খরচ ২৫ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি হতে পারে। তবে তাঁদের প্রি-ওয়েডিং ফোম পার্টির খরচ এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত নয়। বেজোস–সানচেজের এক ছেলেকে উৎসর্গ করে এই পার্টির আয়োজন হয়েছে তাঁর প্রমোদতরি কোরুতে।
যদিও এ সপ্তাহে কিছু গণমাধ্যম ভেনেতো অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট লুকা জায়াকে উদ্ধৃত করে জানায়, বেজোস-সানচেজের বিবাহ আয়োজনের খরচ প্রায় ৪৬ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৬৩ কোটি টাকা। তবে এ সংখ্যা অনেকটাই অনুমাননির্ভর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জায়ার প্রেস অফিসের এক সদস্য জানিয়েছেন, বেজোস বা তাঁর প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাননি প্রেসিডেন্ট; বরং তিনি অনলাইন উৎস থেকে এ তথ্য নিয়েছেন।
ফোর্বসের এই প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, আমেরিকার সাধারণ যেকোনো বিয়ের চেয়ে এই বিয়েতে ৬০০ গুণ বেশি খরচ হয়েছে। এই বিপুল খরচও বেজোসের ২৩৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের তুলনায় কিছুই নয়। বলা যায়, সম্পদের সামান্য অংশ খরচ করেই বেজোস সারা বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছেন এই রাজকীয় আয়োজনে। চলুন দেখে নেওয়া যাক, কোন খাতে কত খরচ হলো এই ভেনিস ওয়েডিংয়ে।
বেজোস ও সানচেজের তিন দিনের এলাহি এই বিয়ের সূচনা হয় গত বৃহস্পতিবার রাতে, ভেনিসের মধ্যযুগীয় গির্জা মাদোনা দেল অর্তোর কাছাকাছি আয়োজিত এক ওয়েলকাম পার্টি দিয়ে। তবে হঠাৎ ঝড়বৃষ্টির কারণে অনুষ্ঠানটি অল্প সময়েই স্থগিত করতে হয়। সেখানে খরচ হয় এক মিলিয়ন ডলার।
শুক্রবার রাতে ভেনিসের একটি দ্বীপে ষোড়শ শতকে নির্মিত সান জর্জিও মাগিওরে ব্যাসিলিকায় মূল অনুষ্ঠানটি হয়। এখানে আনুমানিক খরচ ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। তবে এই রাজকীয় আয়োজনের মধ্যেও একটি বিষয় চোখে পড়েছে। এই দম্পতিকে কোথাও সরাসরি বিয়ে করতে দেখা যায়নি। আবার ভেনিস শহর থেকে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি অনুমতিও নেননি তাঁরা। তাই ধারণা করা হচ্ছে, সম্ভবত এই প্রকাশ্য অনুষ্ঠান আয়োজনের আগেই ব্যক্তিগতভাবে বিয়েটা সেরে নিয়েছেন এই যুগল।
অতিথিদের শহরের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছিল ৩০টি প্রাইভেট ওয়াটার ট্যাক্সি। এই পরিবহনে নবদম্পতির খরচ হয়েছে অন্তত ২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
বিয়েতে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে থ্রি-মিশেলিন-স্টার শেফ ফ্যাব্রিজিও মেলিনো পরিচালিত রেস্তোরাঁ কোয়াত্রো পাসসি থেকে। এ ধরনের হাইপ্রোফাইল বিয়েতে এই রেস্তোরাঁর খাবার দিয়ে একজন অতিথি আপ্যায়নে লাগে অন্তত ১ হিজির ৮০০ ডলার। অতএব ২০০ অতিথির জন্য এক রাতের খাবার ও পানীয়ের খরচই প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এই রেস্তোরাঁর সঙ্গে তিন দিনের খাবার সরবরাহের চুক্তি ছিল। সেই হিসাবে বলা যায়, তিন দিনে খরচ হয়েছে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার।
ভেনিসের ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রিতে ফুল দিয়ে সাজানোর জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান মুনারেতো ফ্লাওয়ারস। এরাই বেজোস-সানচেজের বিয়েতে ফ্লোরাল ডেকোরশন করেছেন। এর জন্য তিন লাখ ডলার খরচ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ননফ্লোরাল ডেকোরেশনে লেগেছে ৪ দশমিক ৫ লাখ ডলার। ওয়েডিং প্ল্যানিংয়ে খরচ ১ লাখ ডলার।
বিলিয়নিয়ার এই যুগল প্রত্যেক অতিথিকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন ইতালির স্থানীয় পণ্য ও মুরানো গ্লাসের বিশেষ উপহার। একটি মুরানো ওয়াইন গ্লাসের দাম ২২০ ডলার। ফোর্বস জানাচ্ছে, এই উপহারের পেছনে বেজোস-সানচেজ দম্পতীর ব্যয় হয়েছে ৪০ হাজার ডলার।
অতিথিদের থাকার জন্য ভেনিসের পাঁচ তারকা হোটেলগুলো ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর ভাড়া আসে ৯ লাখ ডলারের মতো। বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ও স্থানীয় পুলিশ এই আয়োজনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এ খাতে খরচ হয়েছে ২ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ভেনিস শহরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে শহরের ৩টি সংস্থায় প্রায় ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন বেজোস।
বেজোস-সানচেজের বিয়েকে আরও আকর্ষণীয় করতে গান গেয়েছেন বিখ্যাত সংগীতশিল্পী মাতেও বোচেলি, লেডি গাগা ও এলটন জন। তাঁদের পেছনে খরচ হয়েছে ৫ মিলিয়ন ডলার। বিয়ের পোশাক ও অন্যান্য আউটফিট, অনুষঙ্গ, হেয়ার ও মেকআপে ব্যয় হয়েছে ১ মিলিয়ন ডলার। ফোর্বসের ধারণা, সবকিছু মিলিয়ে নবদম্পতির খরচ হয়েছে মোট ২০ মিলিয়ন ডলার।
গণমাধ্যমের উন্মাদনা ও রাজকীয় আয়োজন সত্ত্বেও, ভেনিসে জেফ বেজোস ও লরেন সানচেজের এই ডেস্টিনেশন ওয়েডিং সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রমাণিত হতে পারেনি বা বলা যেতে পারে আগের রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। বরং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত অনন্ত আম্বানির বিয়ের তুলনায় এই আয়োজনকে ছোটই মনে হয়। তাই ভারতের সবচেয়ে ধনী মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়ে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিয়ে হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ছবি: এএফপি