সংগীত কেবল শোনার জন্য নয়, এটা আমাদের লাইফস্টাইলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময় সংগীত তারকারা প্রভাবিত করেছেন ফ্যাশন দুনিয়া, নিয়ে এসেছেন দুনিয়া কাঁপানো বা কালজয়ী ফ্যাশন ট্রেন্ড। তেমন কিছু সংগীতের মহা তারকাদের ফ্যাশন স্টেটমেন্টের আদ্যোপান্ত দেখে নিই চলুন।
এলভিস প্রিসলির রক এন রোল স্টাইল
রক এন রোলের রাজা এলভিস প্রিসলি। মার্কিন এই তারকা শুধু গান দিয়ে নন, বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন আইকন হিসেবে পরিচিত। তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু তরুণ এখন পর্যন্ত এই স্টাইল ধরে রেখেছেন। এলভিস প্রিসলি ছিলেন ট্রেন্ডসেটার। কটকটে রঙের বেস্পোক টেইলর করা স্যুট পরতেন তিনি। বিল স্ট্রিটের কৃষ্ণাঙ্গ ব্লুজ শিল্পীদের দেখে এলভিস এই পোশাক পরা শুরু করেন। সেই ৭০ বছর আগের এই ফ্যাশন যখন এখনকার ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়ায়, তখন বোঝাই যায়, ফ্যাশন দুনিয়ায় এলভিস প্রিসলির প্রভাব কতখানি।
এলভিস প্রিসলি ডোরাকাটা ব্লেজার দিয়ে স্ট্রাইপড শার্ট পরতেন। ২০২২ সালে এলভিসকে নিয়ে নির্মিত বায়োপিকে দেখা যায়, সে সময়ের এই ফ্যাশনের জন্য মানুষের বিদ্রূপের মুখে পড়লেও এখনকার সময়ে এসে সেই ফ্যাশন হয়ে গেছে সবচেয়ে আইকনিক। চোখে পড়ার মতো উজ্জ্বল রং ও পোশাকের কাটের যে ট্রেন্ড তিনি চালু করেছিলেন, তা পরে প্রিন্স ও ডেভিড বোওয়ি থেকে শুরু করে হালের ক্রেজ লিল ন্যাস এক্সকে পরতে দেখা যায়। এলভিস নিজের অভিনীত চলচ্চিত্র ছাড়া কখনোই অবশ্য ডেনিম পরেননি। টু টোনড বোলিং শার্ট, পেজড প্যান্টস, পেনি লোফারস, নিয়ন রঙের গয়নার শুরুটা করেছিলেন এলভিস প্রিসলি। তাঁকে বলাই যায় কিং অব ফ্যাশন। এলভিস প্রিসলি তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে থেকেই পোশাক পরতেন। আর সে কারণেই এখনকার সময়ের ফ্যাশন আইকনদের পোশাক তার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়।
বিটলসের রক ফ্যাশন
সর্বকালের সেরা রক ব্যান্ড বিটলস যে ফ্যাশন দুনিয়ার সব দশকের তরুণদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে আসছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এডি সুলেভান স্যুট, পুডিং বোল চুলের কাট, রঙিন সাইকাডেলিক পোশাক আর তার পরের পর্বের লম্বা চুলের রক ফ্যাশন যুগ যুগ ধরে মাতিয়ে যাচ্ছে সবাইকে। তাঁরা মঞ্চের পরিবেশনা শুরু করেন ব্রিটিশ চেস্টারফিল্ড স্যুট পরে।
কালো রঙের স্যুটে থাকত ভেলভেট উইং কলার, অগোছালো মপটপ চুলের স্টাইল তরুণদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। আজও করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন স্টাইল নিয়ে এসেছে বিটলস। সত্তরের হিপি সংস্কৃতির অনুপ্রেরণায় ফ্লোরাল প্রিন্টেড শার্ট, রংধনু পোশাক, হাতে ব্রেসলেট, গলায় চেন, লম্বা দাড়ি ও চুল তাঁদের আইকনিক লুক হয়ে যায়। আর এই হিপি ফ্যাশন সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের কল্যাণেই। জন লেননের চশমা কিংবা জর্জ হ্যারিসনের বেলবটম প্যান্ট, ফ্লেয়ার প্যান্ট, বুকখোলা শার্টের ভিনটেজ লুক ফ্যাশনপ্রেমীদের প্রভাবিত করে যাচ্ছে, যাবে।
মাইকেল জ্যাকসনের ফ্যাশনকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে উন্মাদনা
চিকমিকে আর ঝলমলে গ্ল্যামারের জাদু নিয়েই তিনি এসেছিলেন পুরো বিশ্বকে মাতাতে। কিং অব পপ মাইকেল জ্যাকসনের গ্লাভস, সাদা মোজা, মেটাল স্পাইক আর বোতাম দেওয়া জ্যাকেট, মেটালিক ও ফো লেদার ফিনিশের সুপার ফিটেড পোশাক, ভরপুর সিকুইন, বোল্ড স্ট্র্যাপ, জিপার, প্যাচ ওয়ার্ক আর হ্যাট এখনো দাপটের সঙ্গে বিচরণ করছে ফ্যাশন দুনিয়ায়। তাঁর চুলের স্টাইল আর মেকআপও আইকনিক। মাইকেলের মতো ফ্যাশনে উন্মাদনা আর কোনো সংগীতশিল্পী তৈরি করতে পারেননি। তিনি আজ নেই; কিন্তু তাঁর ভক্ত আর ফ্যাশনপ্রেমীদের মাধ্যমে তিনি ও তাঁর ব্যতিক্রমী স্টাইল টিকে থাকবে বহু যুগ।
উল্লেখ্য, তার এই চাকচিক্যময় পোশাক আশাকের পেছনের মানুষটার নাম বিল হুইটন। এমন বলা হয়ে থাকে, যখন থেকে বিল হুইটন মাইকেল জ্যাকসনের পোশাক ডিজাইন শুরু করেন, তখন থেকেই তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পারফরমার হয়ে ওঠেন। ১৯৭৯ সালে মাইকেল জ্যাকসন ট্যুরের জন্য অভিনব কিছু করতে চান। বিল তখন তাঁকে গ্লাভস এক হাতে পরার পরামর্শ দেন, যাতে হাত ও পায়ের নাচের অঙ্গভঙ্গি দর্শক আরও ভালো করে বুঝতে পারে; এবং তা দারুণ কাজ করে। মাইকেল জ্যাকসনের এক একটি গ্লাভস বানাতে ৪০ ঘণ্টা সময় লাগত। থ্রিলারের সাফল্যের সময় পুরো মিলিটারি থিমের পোশাকে তিনি কনসার্টে আসেন। এটি ১৯ শতকের এক ব্রিটিশ অ্যাডমিরালের পোশাক থেকে অনুপ্রাণিত। এতে পুঁতি ও পাথর বসিয়ে নতুন রূপ দেওয়া হয়। লাল পুঁতিতে ঢাকা লাল উলের ব্লেন্ড জ্যাকেট আর সেই সঙ্গে সোনালি বিডসের কাজের লুকটি মাইকেল জ্যাকসনের সব লুকের মধ্যে সবচেয়ে আইকনিক বলা হয়ে থাকে। তার মতো পোশাকে বিডসের আর লাইটের ব্যবহার এখন অনেক তারকা করেন।
ম্যাডোনা যেন একাই এক ফ্যাশন স্কুল
আশির দশকের গোড়ার দিকে আগমন তাঁর। পাঁচ দশক ধরে মাতিয়ে যাচ্ছেন সংগীত আর ফ্যাশন দুনিয়া। তাঁর স্টাইল, ব্যক্তিত্ব, অভিব্যক্তিসহ সবকিছুই আলাদা করেছে তাঁকে। ঠিক ধরেছেন। কুইন অব পপ ম্যাডোনার কথাই হচ্ছে এখানে। যখনই নতুন কোনো অ্যালবাম বা মিউজিক ভিডিও এসেছে কিংবা কোনো ট্যুরে গিয়েছেন, তাঁর সংগীতের সঙ্গে তুমুল আলোচনা হয়েছে তাঁর পোশাক নিয়ে। বিখ্যাত ফরাসি ডিজাইনার জাঁ পল গতিয়েরের ডিজাইন করা যে পোশাক পরে তিনি কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন, তা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
১৯৮৩ সালে লাকি স্টার মিউজিক ভিডিওতে ম্যাডোনার পোশাকে দেখা যায় কালোর আধিপত্য। কালো মেশের ক্রপ টপ, কালো আঙুলবিহীন লেসের গ্লাভস, মাথায় কালো ফিতা, কালো স্কাট আর নিচে কালো লেগিংস। তাঁর এই আপাদমস্তক কালো অল ব্ল্যাক লুক তুমুল আলোচিত হয়েছিল এবং সেই সময় থেকে শুরু করে এখন জেনজি প্রজন্মকেও তা প্রভাবিত করে আসছে।
১৯৮৪ সালে এমটিভি ভিডিও মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে তাঁর পরনে ছিল সাদা করসেট, সাদা টুইল স্কার্ট, কনুই পর্যন্ত আঙুলবিহীন সাদা গ্লাভস, তারকা আকৃতির কানের দুল। বেল্টের বাকলে লেখা ছিল বয় টয় আর গলায় ক্রুশ চিহ্নিত লকেট, এই লুকে লাইক আ ভার্জিন গানের পরিবেশনা এক অন্য মাত্রা তৈরি করেছিল সে রাতে। ম্যাডোনার আশির দশকের গয়নাগুলোকে এইটিস এরা জুয়েলারি বলা যায়, যা সারা বিশ্বের ফ্যাশনকে প্রভাবিত করেছিল। লেসের গ্লাভস, হেয়ার বো, লম্বা চেনের নেকলেস, অদ্ভুত সব ডিজাইনের কানের দুল এই সবই ম্যাডোনাপ্রাণিত ফ্যাশন অনুষঙ্গ।
১৯৫৩ সালে মেরিলিন মনরো অভিনীত চলচ্চিত্র ‘জেন্টলমেন প্রেফারস ব্লন্ডস’–এ তাঁর পরিবেশনায় ডায়মন্ডস আর গার্লস বেস্ট ফ্রেন্ড গানের অনুপ্রেরণায় ম্যাডোনা আনেন তাঁর আলোচিত গান ম্যাটেরিয়াল গার্ল। সেখানে মনরোর পরা উইলিয়াম ট্রাভিলা পোশাকটির অনুকরণে পোশাক পরেন তিনি। বাবলগাম পিংক শেডের ফিতাবিহীন সাটিনের বডিকন এক পোশাক সঙ্গে এখানে কোমরে ছিল বড় বো।
১৯৮৬ সালে এসে তাঁর নারীসুলভ ফ্যাশন থেকে বের হয়ে এসে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ইমেজ তৈরি করেন তিনি। পাপা ডোন্ট প্রিচ গানটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের মতো সংবেদনশীল বিষয়ের কারণে সে সময়ে তুমুল চর্চিত হয়েছিল। এখানে ম্যাডোনাকে দেখা যায় জিনস ও লেদার জ্যাকেটে আর কালো করসেট ও প্যান্টে। তাঁর কোমরে ছিল কালো বেল্ট।
১৯৮৭ সালের লা ইসলা বোনিতা গানের স্প্যানিশ ফ্লামেঙ্গো নাচের লাল পোশাক আর কানের পাশের ফুল, নব্বইয়ের ট্যুরে জাঁ পল গতিয়েরের কোণ ব্রা তাঁর আইকনিক লুকের মধ্যে রয়েছে। এ সময় এই কোণ ব্রা একটি ক্রেজে পরিণত হয়।
২০১৩ সালের মেট গালা ম্যাডোনার পোশাক বলে দেয় সময়ের বহু আগেই তিনি ফ্যাশন ট্রেন্ড তৈরি করেন। তাঁর পরনে ছিল ফিশনেট বডি স্যুটের ওপর বেল্ট ও স্টাড দেওয়া প্লেইড জ্যাকেট। মাথায় কালো পরচুলা, সঙ্গে কালো লেদারের গ্লাভস ও হট পিংক হিলস। ম্যাডোনার এই সাজপোশাককে মেট গালার সর্বকালের সেরা একটি লুক বলা হয়। সে বছরই আরও আলোচিত হয়েছে তার বুলফাইটার কস্টিউম আর লেপার্ড প্রিন্টের পোশাক।