সময়টা বিংশ শতাব্দীর ৫০ ও ৬০-এর দশক। বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের নানা উন্মেষ ঘটছে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। মার্টিন লুথার কিং, রোজা পার্কারদের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তিকামী কালোদের লড়াই এ সময় একটা উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে। আর বরাবরের মতোই আন্দোলনে গণমানুষের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে গান। এ সময় প্রথম আমরা ক্যারিবীয় বংশোদ্ভূত হ্যারল্ড জর্জ বেলাফন্টে জুনিয়রকে দেখি লুথার কিংয়ের সহচর হিসেবে। এর আগে থেকেই বেলাফন্টে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যে ক্যারিবীয় ঘরানার গান জনপ্রিয় করতে শুরু করেন। মার্টিন লুথার কিংয়ের সাহচর্য তাঁকে আমৃত্যু মানবাধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে।
বেলাফন্টের জন্ম ১৯২৭ সালে নিউইয়র্কে। কিন্তু ১৯৩২ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তাঁর কেটেছে জ্যামাইকায়। ফলে জ্যামাইকার জন্য তাঁর বিশেষ দরদ দেখা যায়। ১৯৪০ সালে ফিরে আসার পর নিউইয়র্কে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জর্জ ওয়াশিংটন স্কুল থেকে ঝরে পড়ে অংশ নেন যুদ্ধে। ওই দশকের শেষের দিকে একটা অভিনয় স্কুলে ভর্তি হন অভিনয় শেখার জন্য। আর সেই খরচ জোগাতে একটি ক্লাবের ব্যান্ড দলের সঙ্গে গান গাইতে শুরু করেন। এই দলের নেতা ছিলেন বিখ্যাত চার্লি পার্কার। হ্যারি বেলাফন্টে ১৯৪৯ সালে পপ গায়ক হিসেবে প্রথম গান রেকর্ড করেন। এরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লোকসংগীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের লাইব্রেরি আর্কাইভ ঘাঁটাঘাঁটি করে তিনি হয়ে ওঠেন বোদ্ধা লোকসংগীতশিল্পী।
লোকসংগীত নিয়ে কাজ করার সময়ই তিনি ইগল গায়ক পল রবসনের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এরপর যোগ দেন মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে। হয়ে ওঠেন মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী। লোকসংগীতের পাশাপাশি তিনি অন্য ধরনের গানও গাইতে শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে হ্যারি বেলাফন্টে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘ক্যালিপসো’ প্রকাশ করেন। প্রথম অ্যালবাম হিসেবে এটি ১০ লাখ কপি বিক্রি হয় কেবল যুক্তরাষ্ট্রে। পরে যুক্তরাজ্যেও এটি বছরে ১০ লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়। এই অ্যালবামে তিনি ত্রিনিদাদ ও টোবাগো অঞ্চলের ক্যালিপসো সংগীতকে নিয়ে আসেন পাশ্চাত্যে। গানগুলো ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে। এই অ্যালবামের দুটো গান ‘বানানা বোট সং’ ও ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’ জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে আসে। যে জনপ্রিয়তা রয়েছে এখনো।
হ্যারি বেলাফন্টের কণ্ঠে জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল শুনতে পারেন এই লিংক থেকে
জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অনেক পুরস্কারও অর্জন করেন হ্যারি বেলাফন্টে। প্রথম আফ্রিকান–আমেরিকান তারকা হিসেবে ১৯৬০ সালে এমি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। এ ছাড়া তাঁর ঝুলিতে আছে তিনটি গ্র্যামি পুরস্কার।
১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়। সে সময় সেখানকার বেঁচে থাকা নাগরিকদের সহযোগিতা করতে একটি ফান্ড গঠন করেন হ্যারি বেলাফন্টে। ‘ইউনাইটেড সাপোর্ট অব আর্টিস্টস ফর আফ্রিকা’ নামের এই সংগঠনের সদস্য তারকারা মিলে একটি গান বের করেন। এখন পর্যন্ত দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় মানবিক গান এটি। এর শিরোনাম ‘উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড’। হ্যারির তত্ত্বাবধানে সেই বিখ্যাত গান লেখেন ‘কিং অব পপ’খ্যাত মাইকেল জ্যাকসন ও লিওনেল রিচি। আর গানটিতে গলা মেলান সে সময়ের বিখ্যাত সংগীত তারকারা। এখনো গানটিকে পপ কালচারের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত বলা হয়।
ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’ গানটি ভারত ও তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বের নানা ভাষায় এই গানের অনুবাদ বা ভাবানুবাদ হতে থাকে। এর মধ্যে স্থপতি প্রসাদ রঞ্জন দাসের (যিনি রঞ্জন প্রসাদ নামে পরিচিত) করা ‘পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়ে…’ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছাত্রসমাজের কাছ থেকে এই গান উঠে আসে পশ্চিম বাংলার নকশাল আন্দোলনের কর্মীদের গলায়।
রঞ্জন প্রসাদের স্বকণ্ঠের গানটি শোনা যাবে এই লিংক থেকে।
মূল গানের সঙ্গে মিল রেখে এটি প্রেমের গানই থাকে। কিন্তু এই গানই হয়ে ওঠে দেশের গান, কলকাতা ইয়ুথ কয়্যারের মাধ্যমে।
কলকাতা ইয়ুথ কয়্যারের অন্যতম উদ্যোক্তা রূমা গুহঠাকুরতা ষাটের দশকে আমেরিকায় যান, স্বামীর সঙ্গে। সেখানে সানফ্রান্সিসকোর একটি মিউজিক ফেস্টিভ্যালে। সেখান থেকে অন্য একটা শহরে গিয়ে হাজির হোন হ্যারি বেলাফন্টের একটা কনসার্টে। কনসার্টে হ্যারি রুমা গুহঠাকুরতাকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাঁকে কয়েক লাইন গাইতে বলেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে রুমা গুহঠাকুরতা জানান যে উনি সেদিন হ্যারির সামনে গাইতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠেছিলেন। ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’ তিনি আগেও শুনেছেন। আবার হ্যারির স্বকণ্ঠে সামনাসামনিও শুনেছেন। কিন্তু দেশে ফিরে যখন তাঁরা কলকাতা ইয়ুথ কয়্যারের জন্য করতে চাইলেন, তখন ব্যক্তিপ্রেমের চেয়ে স্বদেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিলেন। সুর ঠিক রেখে বাংলা কথা বসানোর কাজটা করলেন গীতিকবি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘সাগর নদী কত দেখেছি দেশ’ শিরোনামের এই গান রেকর্ড করা হয় ১৯৮১ সালে। কলকাতা ইয়ুথ কয়্যারের ‘আমরা তরী বেয়ে যাই’ এলপি রেকর্ডে।
গানের কথাগুলো শিবদাস সম্পূর্ণ দেশাত্মবোধে পরিণত করলেন এভাবে—
সাগর নদী কত দেখেছি দেশ
আর পাহাড়ে সোনালি কত সূর্যোদয়
আমি দেখেছি দ্বীপ, কত অন্তরীপ
আর নিশীথ রাত্রে বনে চন্দ্রোদয়।
তবু ভরে না মন, হায় ভরে না মন
কী করে বোঝাব যা দেখে নয়ন?
সব সেরা দেশ, আনে হৃদয়ে রেশ
আহা জন্মভূমি এই আমার দেশ।
দেখেছি মরুভূমি বালুকাময়
আর ঝর্ণার ঝরো-ঝরো জলপ্রপাত
পাহাড়ি পথ বেয়ে চলেছে গেয়ে
নীল সাগরে মিশে যেতে শুনে যে ডাক।
শুনেছি পথে যেতে পাখির গান
সেই পাখির ছিল যে হায় কী যেন নাম
বরফে ঢাকা কত ছোট্ট গ্রাম
স্মৃতিতে রাখা আছে, জুড়ায় প্রাণ
কলকাতা ইয়ুথ কয়্যারের পরিবেশনায় শুনতে পারেন—
সরস্বতী নদীতীরে, কল্পনায় ঘিরে ঘিরে : স্বদেশপ্রেম থেকে আবারও প্রেম
কলকাতা ইয়ুথ কয়্যারের আরেক দিকপাল সলিল চৌধুরীও এই গানটি নিয়ে ভেবেছেন। তবে সলিল চৌধুরী পুরো গানটিকে নিয়ে এসেছেন একেবারে বাংলায়। ফলে পাহাড় সেখানে হারিয়ে এসে পড়ে গ্রামের কুটিরে। যে দাওয়ায় বসে কবির প্রেমিকা তাকে সুধায়—আবার কবে আসবেন? সলিল চৌধুরীর লেখা ও সংগীতায়োজনে এটি রেকর্ড হয় ১৯৮২ সালে।
সেই গানের কিছু কথা এ রকম:
সরস্বতী নদীতীরে, কল্পনায় ঘিরে ঘিরে
আল্পনায় আঁকা উঠোন পেরিয়ে
যদি উঠতে দাওয়ায়
তাহলে দেখতে পেতে আমার প্রেয়সী
তুমি সে কুটিরে।
ভ্রমর কৃষ্ণ চোখ দুটি
ঠোঁট গোলাপ যেন খুঁটি খুঁটি
বসতে দিত শীতল পাটিতে কত যত্ন করে
শুধাতো মৃদু হেসে
আবার কবে আমি যাব ফিরে
হায় রে আর তো কখনো সে গাঁয়েতে ফিরে আর যাব না
যা কিছু হারাল আর তো ফিরে তাকে পাব না।
১৯৯৩ সালে সোলস তাদের পঞ্চম অ্যালবাম ‘এ এমন পরিচয়’-এ নিজেদের মতো করে বাংলায় এই গান রেকর্ড করে। ‘সাগরের এই প্রান্তরে’ গানটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সোলসের শিল্পী ও ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’ গানের বাংলা ভাবানুবাদের গীতিকার নাসিম আলী খান হাল ফ্যাশনকে জানান, আশির দশকে এই গানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সে সময় কোনো একদিন সন্ধ্যায় দল বেঁধে ঘুরতে যান পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে। যাওয়ার পথে গাড়িতে হঠাৎ বেজে ওঠে ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আকাশেও মস্ত চাঁদ। দূরে নোঙর করা অনেক জাহাজ। আর কর্ণফুলী নদীতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান।
তখনই নাসিম আলী খানের মনে হয়, এই গান তো বাংলায়ও হতে পারে। তখনই তিনি গানটির প্রথম চার লাইন লিখে ফেলেন। নাসিম আলী খান বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, গানের আক্ষরিক অনুবাদ যথার্থ হবে না। বরং এটির ভাবানুবাদ করাটাই হবে যথাযথ।’
গানের আঞ্চলিকতা ধরে রাখতে ‘জ্যামাইকা’ শব্দটিও বাদ দেন তিনি। আর যেহেতু সেই সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ ছিল আর চাঁদ আবহমানকাল ধরে বাঙালির রোমান্টিসিজমের অন্যতম উৎস, তাই মূল গানে সান অর্থাৎ সূর্য থাকলেও এর পরিবর্তে তিনি চাঁদকে বেছে নেন। এই সব পরিবর্তনের ফলে গানটির সরাসরি অনুবাদ না হয়ে এটি ভাবানুবাদ হয়ে ওঠে। অ্যালবামের গায়েও অনুবাদের বদলে ‘হ্যারি বেলাফন্টের “জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল” থেকে অনুপ্রাণিত’ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
সোলসের গানের শুরুটা দাঁড়ায় এমন
‘সাগরের ওই প্রান্তরে শুনি পর্বতচূড়ায় চাঁদ জাগে
জলপথে আমি দিই পাড়ি ফিরি চাঁদজাগা ওই বন্দরে।
তবু চলেছি ব্যথার ওই মন নিয়ে ফিরব না অনেক দিনই, আমি
হায় হৃদয় নিয়ে পিছু দেখি ফেলে আসা সেই মনটাকে।
৫০ বছর পূর্তিতে সোলস এই গানটি পুনরায় রেকর্ড করে। সেটি শুনতে পারেন এখান থেকে
জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েলের জনপ্রিয়তার সুর ভেসে চলে বর্তমান সময়েও। এ সময়ের তরুণদের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হাতিরপুল সেশনসও গানটি গেয়েছে নিজেদের মতো করে। তবে তা চাকমা ভাষায়। যদিও সঙ্গে থেকেছে রঞ্জন প্রসাদের অনুবাদ করা অংশটুকুও। গানটির বিষয়ে হাতিরপুল সেশনসের অনিরুদ্ধ অনু বলেন, ‘হ্যারি বেলাফন্টের “জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল”–এর বাংলা অনুবাদ অর্থাৎ রঞ্জন প্রসাদের অনুবাদটা আমাদের বেশ পছন্দ। আমরা নানা সময় গানটা গেয়েছি। কিন্তু হাতিরপুল সেশনসের দ্বিতীয় সিজন করার সময় আমাদের সঙ্গে যখন জয়ী (জয়ী চাকমা) যোগ দেয়, তখন ভাবলাম, সে যেহেতু চাকমা ভাষায় লেখালেখি করে, তাহলে “জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল” গানটা আমরা চাকমা ভাষায় করি। বাংলায় যেহেতু আগেই অনুবাদ করা হয়েছে, তাই চাকমা ভাষায় গানটা করতে পারলে নতুন একটা সংযোজন হবে।
যেকোনো গানই অনুবাদ করতে গিয়ে প্রথমেই যে চ্যালেঞ্জ আসে, তা হলো প্রতিটি ভাষার অভিজ্ঞতা আলাদা।
এমনকি স্থান ও সময়ভেদেও মানুষের অভিজ্ঞতাগুলো আলাদা। তাই নিজেদের মতো অনুলিখন করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আর প্রসাদ রঞ্জন দাসের অনুবাদটাও যেহেতু খুবই ভালো, তাই চাকমা ভাষায়ও তেমনই একটি অনুবাদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের অনুবাদও মূলত ভাবানুবাদ। এ ক্ষেত্রে চাকমা ভাষার কবি জয়ীর বন্ধু ম্যাকলিন চাকমা আমাদের সাহায্য করেছেন।’
হাতিরপুল সেশনসের গানটি শুনতে পারেন এখান থেকে:
আর এভাবে কালোত্তীর্ণ গানের মর্যাদা পেয়েছে হ্যারি বেলাফন্টের ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’। আগামী দিনেও নানাভাবে প্রেমিকদের পাশাপাশি দেশপ্রেমকেও উজ্জীবিত করবে এই গান।
ছবি: ইন্সটাগ্রাম ও উইকিপিডিয়া