প্রতিবছর জুনের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। এটি এমন একটি দিন, যা উৎসর্গ করা হয় সেই মানুষটিকে, যিনি আমাদের জীবনের নায়ক, বিশাল বটের ছায়া আর অফুরান ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। আমাদের জীবনের সত্যিকারের সুপারহিরো বাবা, যিনি ‘মার্ভেল’ কিংবা ‘ডিসি ইউনিভার্স’–এর কোনো চরিত্রের চেয়ে কম নন।
মায়ের কথা উঠলেই আমাদের অনেকেরই আবেগ ঝরে পড়ে অথচ বাবার কথা এলেই যেন সংকোচ বা কুণ্ঠা কাজ করে আবেগ প্রকাশে। ব্যতিক্রম থাকলেও বেশির ভাগ পরিবারের দৃশ্যপট এমন। তবে আমাদের সব আবদারের শেষ ঠিকানা কিন্তু সেই মানুষটিই—আমাদের বাবা।
‘বাবা’—এই ছোট্ট শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সস্নেহ প্রশ্রয় আর চিরস্থায়ী নিরাপত্তা। এক জোড়া পুরোনো জুতা বারবার সেলাই করে বাবা নিজের খরচ বাঁচিয়ে সন্তানের জন্য কিনে আনেন নতুন জুতা কিংবা জামা। এই নিঃশব্দ ত্যাগগুলোই তো একজন বাবার জীবনের বাস্তব চিত্র। পরীক্ষা বা প্রথম চাকরির ইন্টারভিউয়ের আগে বাবার আবেগপ্রবণ কণ্ঠে সাহস জোগানো, জীবনের প্রতিটি বাঁকে তাঁর নীরব উপস্থিতি, এসবই সন্তানদের জন্য তাঁর অবারিত ভালোবাসার প্রমাণ।
বাবারা অনেক সময় খুব কম কথা বলেন, কিন্তু অনেক কিছু বোঝাতে পারেন চোখের ভাষায়। বাবা দিবসকে আরও গভীর করে তোলে আমাদের স্মৃতিগুলো। এমনই আবেগপ্রবণ স্মৃতি শেয়ার করেছেন প্রথিতযশা নাট্যশিল্পী খালেদ খান ও সংগীতশিল্পী মিতা হকের কন্যা সংগীতশিল্পী ফারহিন খান জয়িতা, ‘আমি ছোটবেলায় বাবার গোঁফ দেখে ঘুমাতাম; যখন “অচলায়তন” নাটকের মঞ্চায়ন হতো, বাবা গোঁফ কেটে ফেলতেন রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ সকালে উঠে বাবার মুখ দেখে চমকে যেতাম—মনে হতো, যেন এক নতুন মানুষকে দেখছি! এরপর গড়িয়ে গিয়ে বাবার পেটে বসে তাকিয়ে থাকতাম হাঁ করে। এটা ছিল আমাদের রোজকার রুটিন।’
‘যখন বাবাকে পঞ্চকের চরিত্রে মঞ্চে দেখতাম, বুঝতাম না নাটকের গল্প, কিন্তু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কী সুন্দর কথা বলছেন, হাঁটছেন, গান করছেন—বাবা যেন তখন সত্যিই অন্য কেউ হয়ে যেতেন! ’ বাবাকে নিয়ে এমন সুন্দর গল্পগুলো জয়িতার কাছে অমূল্য স্মৃতি, অভিন্ন অনুভূতির প্রতিচ্ছবি।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ বাবাকে নিয়ে ভরপুর সব স্মৃতি ভাগ করে নিয়েছেন, ‘বাবাকে বলতে পারেন আমার প্রথম প্রেম। ওনার সবকিছু অনুকরণ আর অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম।’
নওশাবা জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই খুব অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। অনেক প্রশ্ন করতেন বাবাকে, আর বাবা ধৈর্য ধরে সব উত্তর দিতেন। বাবা শুধু উত্তর দেননি, জীবনের মূল্যবান পাঠও শিখিয়েছেন তাঁকে। বাবা আমাকে কাঁচাবাজারে নিয়ে যেতেন। সেখানেই আমি শিখেছি কোনটা কুমড়া, কোনটা শিম, কোন মাছ কীভাবে চেনা যায়। একটা মেয়েশিশুকে বাজারে নিয়ে যাওয়া তখন খুব সাধারণ ছিল না, কিন্তু বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন। বাজার থেকে ফেরার পথে গল্প করতে করতে ফিরতাম আমরা।’
এই ছোট ছোট অভিজ্ঞতাই একজন মেয়ের মনে বাবাকে করে তোলে নায়ক। নওশাবার বাবাও ছিলেন তেমনই একজন।
নওশাবার শৈশব কেটেছে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার অভ্যাসে। শহরে বড় হলেও খোলা ঘাসে হাঁটা, ফুল কুড়ানো, ঘাসের বিছানায় শুয়ে আকাশ দেখা—সবকিছুতে উৎসাহ দিয়েছেন তাঁর বাবা।
আরেকটি স্মৃতির কথা বলেছেন নওশাবা, একদিন বাবা স্কুল থেকে আমাকে নিয়ে ফিরছিলেন। পথে পেট্রলপাম্পে থামলেন। আমি গভীর মনোযোগে পেট্রল দিচ্ছেন যে লোকটি, তাঁকে দেখছিলাম। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী দেখছো মা?
বললাম, ওনাকে দেখি। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি মনে করো লোকটা সুখী? আমি বললাম, সেটা কীভাবে জানব? তখন বাবা বললেন, 'আমরা খুব সহজেই মানুষের বাইরেরটা দেখে একটা ধারণা করে ফেলি। কিন্তু তার ভেতরে কী চলছে, তা জানি না। জীবনে কাউকে বুঝতে হলে, ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করো। কারও সম্পর্কে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিও না'।
এ কথাটি আজও নওশাবার জীবনের পথচলায় পাথেয় হয়ে আছে। বাবার এই কথা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। জীবনের নানা পরিস্থিতিতে মানুষকে বুঝতে, ধৈর্য ধরতে, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন তিনি।
নওশাবার বাবা শুধু অভিভাবক নন, তিনি প্রেরণা, একজন সহযাত্রী, একজন শিক্ষকও।
বাবা মানে কেবল একটা সম্পর্ক নয়, বাবা মানে নির্ভরতার প্রতীক, আত্মবিশ্বাসের ছায়া। আজ এই দিনে একটু জড়িয়ে ধরা হোক সেই মানুষটিকে, বলা হোক—তুমি না থাকলে আমি আজকের আমি হতাম না। ধন্যবাদ, বাবা।
বাবা দিবস তাই শুধুই একটি দিন নয়, এটা গভীর উপলব্ধির সময়ও। একজন মানুষ কীভাবে নিজের স্বপ্ন, আরাম আর ব্যক্তিগত চাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে একটি পরিবারের ভরসা হয়ে দাঁড়ান, তারই প্রমাণ বাবা। তাই আজ বাবা দিবসে তাঁকে গিয়ে বলুন, তোমাকে খুব ভালোবাসি। যাঁদের বাবা আছেন আর যাঁদের বাবা চলে গেছেন, তাঁদের জন্য থাকল গভীর শ্রদ্ধা আর বিনম্র প্রার্থনা।
ছবি: জয়িতা ও নওশাবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম