অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনকে আমরা চিনি একজন আত্মনির্ভরশীল মা বলিষ্ঠচিত্ত ও আত্মপরিচয়ের যাত্রায় বাঁধনহারা এক নারীর রূপে। বাংলাদেশের সমসাময়িক অভিনয় জগতের এক দক্ষ অভিনেত্রী তিনি। তাঁকে শুধু পর্দায় নয়, বাস্তব জীবনেও দেখা যায় স্পষ্টভাষী, মানবিক ও চিন্তাশীল এক মানুষ হিসেবে। মা দিবস উপলক্ষে বাঁধনের সঙ্গে হাল ফ্যাশনের এই আলাপচারিতায় উঠে এলো মাতৃত্ব, সমাজ, মনস্তত্ত্ব আর ফ্যাশনের প্রেক্ষাপটে তার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির গল্প।
বাঁধনের বলিষ্ঠ ও সাহসী চরিত্র গঠনের পেছনে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি অকপটে বললেন, 'আমার ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার শক্তিটা এসেছে বাবার কাছ থেকে। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি, সৎ জীবন যাপন করতেন। সেই অনাড়ম্বর, নীতিনিষ্ঠ পরিবেশেই তিনি বড় হয়েছেন। বললেন, 'মা অনেক সময় দ্বিমত পোষণ করেছেন, সমাজের চাপে অনেক কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন, কিন্তু আমাকে কখনো বাবা বাধা দেননি। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি নিজস্ব চিন্তা নিয়ে বড় হয়েছি'।
ফ্যাশনের প্রসঙ্গে এলে শাড়িপ্রেমী বাঁধনের চোখে ফুটে উঠল আনন্দের ঝিলিক। জানালেন, দেশিয় পোশাকের প্রতি তাঁর ভালোবাসার অন্যতম কারণ তার মা। 'ছোটবেলায় দেখেছি মা সবসময় দেশি শাড়ি পরতেন। তাঁর শাড়িগুলো দারুণ সুন্দর। সেগুলোর প্রতি আমার একটা অন্যরকম ভালো লাগা আছে। এখনও আমি মাঝে মাঝে মায়ের শাড়ি পরি', বললেন এই অভিনেত্রী।
শাড়ির প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা ছুঁয়ে গেছে তাঁর মেয়েকেও। জানালেন, আমার মেয়েও শাড়ি পরতে ভালোবাসে। এবারে পহেলা বৈশাখে ও নিজেই শাড়ি পরেছে। আমরা মাঝে মাঝে টুইনিং করি একই ধরনের পোশাকে। কখনো বেছে নিই একই পোশাকের ভিন্ন রঙ। ওর নিজস্ব স্টাইল আছে, আমি তাতে কখনো হস্তক্ষেপ করি না।
স্টাইল আইকন এই অভিনেত্রী অকপটে বলেন, 'আমার মেয়েই এখন আমার স্টাইলিস্ট। সে বলে কোন অনুষ্ঠানে কী পরব। ওর ফ্যাশন সেন্স খুব ভালো। আর আমি সেটা উপভোগ করি। তিনি বলেন, এখনকার কিশোর-কিশোরীরা অনেক বেশি আআত্মবিশ্বাসী। তারা নিজেদের মতো করে স্টাইল করে, নিজেরা ট্রেন্ড তৈরি করে। এটা আমার দারুণ লাগে'।
মাতৃত্ব, অধিকার,দায়িত্ব ও আত্মপরিচয়ের ভাবনার প্রসঙ্গ আসতেই জানা গেল, একজন মা হিসেবে বাঁধনের অভিজ্ঞতা তার জীবনের গভীরতম অনুভবগুলোর একটি। তবে, তিনি এখানে থেমে যান না। মেয়ের পিতার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গেও বলেন স্পষ্টভাবে।দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমার সন্তানের পিতা তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না। অথচ সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবা মা উভয়েরই সমান অংশগ্রহণ জরুরি। তবে বাঁধন একাধারে মেয়ের বাবা ও মা দুজনের দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছেন। তাই মেয়ের সঙ্গে বোঝাপড়াটাও চমৎকার এই অভিনেত্রীর। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে জানান, “আমি আমার সন্তানকে কখনো আমার সম্পত্তি মনে করি না। সে একজন স্বাধীন মানুষ, যার চিন্তা, মতামত ও নিজস্ব জীবনবোধ আছে। তবে মেয়ের মায়েদের চেয়ে ছেলের মায়েদের দায়িত্ব বেশি বলে মনে করেন বাঁধন। বললেন, আজকের সমাজে ছেলেশিশুকে মানবিকভাবে মানুষ করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। কারণ সমাজ ছেলেদের প্রতি এক ধরনের অধিকারবাদী মনোভাব তৈরি করে, যা ভাঙতে হবে পরিবার থেকেই। তিনি বারবার জোর দেন একটি কথায়—শিশুর মানসিক বিকাশে, নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্যারেন্টিং সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।
মা দিবসের প্রেক্ষাপটে বাঁধন একটি সময়োপযোগী এবং সাহসী বার্তা সবাইকে দিতে চান। তাঁর ভাষ্যে, 'একজন নারী কখন মা হবেন, আদৌ হবেন কিনা, এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। সমাজ অনেক সময় এই সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে, চাপ প্রয়োগ করে। বাঁধন বলেন, আমি মনে করি, সেটি এক ধরনের মানসিক নিপীড়ন। আমি মা হয়েছি কারণ আমি নিজে তা চেয়েছি, এবং তাই এই মাতৃত্বকে আমি সম্পূর্ণভাবে ভালোবাসি'।
আজমেরী হক বাঁধনের কথায় ফুটে ওঠে একজন নারীর আত্মপরিচয় গড়ার সংগ্রাম, একজন মায়ের ভাবনা আর একজন মানুষের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী। মা দিবসে তাঁকে আর পৃথিবীর সকল মাকে হাল ফ্যাশনের পক্ষ থেকে নিরন্তর শুভেচ্ছা৷
ছবি: আজমেরী হক বাঁধন