স্মৃতিতে মেশানো তিব্বত পমেড কি এখনো শোভা পায় আপনার ড্রেসিং টেবিলে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

হালকা কমলা রঙের ছোট্ট একটা কাচের বোতল। গায়ে লাল রঙের একটা গোলাপের স্টিকার। স্টিলের ঢাকনার ওপর লেখা ইংরেজিতে ‘Tibet’। ঢাকনা খুললেই নাকে এসে লাগে খুব পরিচিত একটা ঘ্রাণ। বেশ কিছুটা সময় ঘ্রাণ নিলে বোঝা যায় আমাদের শৈশবের কতটা অংশজুড়ে এ জিনিসটা জড়িয়ে ছিল। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আপনারা এরই মধ্যে বুঝে গিয়েছেন আমি তিব্বত পমেডের কথা বলছি।
বর্ণনা শুনে চোখ বুজে কল্পনা করলেও এই প্রসাধনীর নাম বলে দেওয়া যায়। তিব্বত পমেড কেবল একটি প্রসাধন পণ্য নয়, এটা একটা স্মৃতি। যে স্মৃতি আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি, মা–বাবা—সবাইকেই পরম যত্নে আগলে রেখেছে অনেক বছর। আর তাই তো এখনো ড্রেসিং টেবিলের এক কোনায় রাখা তিব্বত পমেড দেখলে স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে, চোখের কোণে অজান্তেই ভিজে ওঠে। নস্টালজিক করে দেওয়া ‘তিব্বত পমেড’কে কীভাবে ৬৮ বছর ধরে মানুষ ভালোবেসে যাচ্ছে, সেটা ভেবে কিছুটা অবাক হতে হয় বৈকি। কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি ( বাংলাদেশ) লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট-ব্র‍্যান্ড মো. গোলাম কিবরিয়া সরকারের সঙ্গে কথা বলে এই পণ্যটি সম্পর্কে সবিস্তারে জানা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তিব্বত পমেড কীভাবে ঘরে এল

বাংলাদেশ তখনো আমাদের হয়নি। পাকিস্তানই ছিল সবকিছুর হর্তাকর্তা। সেখানেই ১৯৫৬ সালে কোহিনূর কেমিক্যালের যাত্রা শুরু হয় বিদেশিদের মাধ্যমে। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৯১ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণের পর কোহিনূর কেমিক্যালের বর্তমান ম্যানেজমেন্ট ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ব্যবসাকে চলমান রাখে। সরকারি একটি ব্র্যান্ড হিসেবে ভালোভাবে টিকে থাকা কিছুটা কষ্টকর হলেও যখন থেকে এটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলতে শুরু করে, তখন থেকে নতুনভাবে মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ‘তিব্বত’ নামটি জুড়ে যায়।

প্রজন্মান্তের চলে আসছে এই পণ্যটি
প্রজন্মান্তের চলে আসছে এই পণ্যটি

কোম্পানির শুরু থেকেই তিব্বত ব্র্যান্ডের পমেড ছিল। পাকিস্তানের বেশ কিছু জায়গায় সারা বছরই ঠান্ডা থাকে বলে তখন এই পমেডের ব্যবহার অনেক বেশি ছিল। বিকল্প তেমন প্রসাধনী না থাকায় পেট্রোলিয়াম জেলিযুক্ত প্রসাধনীটি কমবেশি সবাই ব্যবহার করা শুরু করে। ধীরে ধীরে সবার ঘরেই তিব্বত পমেড জায়গা করে নেয়। নতুন দেশ গঠন, জায়গার পরিবর্তনের পরেও পমেডের ব্যবহার সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

কী কী উপাদান আছে এই পমেডে

তিব্বত পমেডের কৌটার গায়ে গোলাপ ফুলের ছবি দেখেই বোঝা যায় এর প্রধান উপাদান গোলাপ। পেট্রোলিয়াম জেলির সঙ্গে রোজ অয়েল ও গোপন কয়েকটি উপাদান দিয়ে বানানো হয়েছে এই পমেড। তিব্বত পমেড দাবি করে, তাদের এই প্রসাধনী ব্যবহারে ত্বক প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়, ত্বকের ফাটল রোধ হয়, আর্দ্রতা বজায় থাকে, ত্বক উজ্জ্বল হয়, কোমল ও মসৃণ অনুভূতি পাওয়া যায়, কালো দাগ দূর হয়, ধরে রাখে তারুণ্য। এই পমেডে কোনো ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান নেই। সব ঋতুতেই এটি ব্যবহার করা যায় নিশ্চিন্তে।

ক্ষতিকারক উপাদান না থাকায় সব ঋতুতেইব্যবহার করা যায় নিশ্চিন্তে
ক্ষতিকারক উপাদান না থাকায় সব ঋতুতেইব্যবহার করা যায় নিশ্চিন্তে

এত বছর ধরে একই ধরনের প্যাকেজিং কেন

শুরুতেই আমি বলেছিলাম, বর্ণনা শুনেই বলে দেওয়া যায় তিব্বত পমেডের নাম। ঠিক এখানেই পমেড স্মৃতিবিজড়িত করে রেখেছে মানুষকে। পাড়া, মহল্লা, গ্রাম—সবখানেই এই পমেড মানুষের পরিচিত। গ্রাহক দোকানিকে ‘পমেড চাই’ বললেই তারা অন্য কোনো ব্র্যান্ড নয়, এগিয়ে দেন তিব্বত পমেডকেই। তিব্বতের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা বুঝতে পেরেছেন প্যাকেজিং বদলে গেলে এই পরিচিত দৃশ্য হয়তো সেভাবে আর দেখা যাবে না। বহু বছরের নস্টালজিয়া এক নিমেষেই হারিয়ে যেতে পারে। তাই মানুষের ভালোবাসার এ জায়গাটাকে তাঁরা হারাতে চান না। আর এ জন্যই খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হয়নি এই পমেডে।

তবে একবারেই বদল আসেনি এ কথাও বলা যাবে না। পমেডের শুরুর দিকে এতে কাগজের স্টিকার থাকত। যেটা এখন বোতলের গায়ে প্লাস্টিকের লেবেল হিসেবে আসে। কিছু তথ্য যুক্ত হয়েছে। কেউ যেন নকল পমেড না আনতে পারে, সে জন্য সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেটা হয়তো খুব ভালোভাবে খেয়াল না করলে সহজে বোঝাও যাবে না। পণ্যের গুণগত মান আজও একই রকম আছে। এদিক থেকে পমেড এখনো তার সেরাটাই দিয়ে যাচ্ছে।

নতুন জেনারেশনের কাছে সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না কেন

যেকোনো পণ্যই এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে গেলে টিকে থাকার লড়াইয়ে বেশ বড় একটা হোঁচট খায়। তিব্বত পমেডও এর বাইরে নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে নতুন জেনারেশন এটি সম্পর্কে জানে না। এই প্রজন্মের অভিভাবকেরা বা তাঁদেরও অভিভাবকেরা প্রায় সবাই শীতকালে পমেড নিয়মিত ব্যবহার করেছেন। এখনো তাদের বাড়িতে এই পমেড দেখা যায়। নতুন প্রজন্ম এভাবেই এটির নাম জেনেছে। কখনো না কখনো ব্যবহার করেছে। নিয়মিত সার্ভে করেও তিব্বত পমেডের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা দেখেছেন যে ছাত্র থেকে করপোরেটের নারী কর্মকর্তা অনেকের ব্যাগেই পমেড সব সময় থাকে। কাজের ফাঁকে বা ক্লাসের বিরতিতে একটুখানি পমেড লাগিয়ে নিয়ে ত্বক সুরক্ষিত রাখা যায়।

যুগ বদল সত্ত্বেও তিব্বত পমেড আছে অবিকল
যুগ বদল সত্ত্বেও তিব্বত পমেড আছে অবিকল

যুগ বদলের সঙ্গে নতুন অনেক পণ্য এসেছে। বিদেশি পণ্যের প্রবেশও ঘটেছে। গবেষণায় জানা যাচ্ছে, নতুন নতুন অনেক উপাদানের নাম। এত কিছুর ভিড়ে তিব্বত পমেড সেভাবে তাদের উপাদানে বদল আনেনি। শীতকাল উপযোগী করেই এটি এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে আগের মতোই। তাই এ কথা একবারেই বলা যাবে না যে নতুন জেনারেশন পমেড ব্যবহার করছে না। অনেকেই করছে, কিন্তু সেভাবে নিজের সঙ্গে পণ্যটিকে আপডেটেড ভাবতে পারছে না। এর একটা কারণ হচ্ছে পুরোনো প্যাকেজিং। কিন্তু পমেড তো শুধু প্যাকেজিং নয়, এটা একটা নস্টালজিয়া। তাই এই নস্টালজিয়াকে ঘিরে তিব্বত পমেড চায় আরও অনেক দিন টিকে থাকতে।

কেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে?

এলাকার সাধারণ এক মুদিদোকানে পমেড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই এক গাল হেসে বললেন, তাঁদের পরিবারের সবাই এখনো এই পমেড ব্যবহার করেন। বাড়িতে তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই বাচ্চা আছে। শীত এলেই লোশন কেনা হোক বা না হোক, তিব্বত পমেড কিনতেই হবে। দামও হাতের নাগালে বলে একসঙ্গে ২–৩টাও কেনেন তিনি। কারণ, মা–বাবা তো আর এই যুগের লোশন চেনেন না। তাঁরা চেনেন পমেড। যে পমেডে ত্বক নরম থাকে, পা ফাটে না, হাতের চামড়া শুকায় না। এমন তথ্য জানা গেল আরও দুজন ব্যক্তির কাছ থেকে, যাঁদের পরিবারও আজ অনেক বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে এই প্রসাধনী।
এটাকে বাণিজ্যের ভাষায় বললে, স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ডের মধ্যে স্লো প্রোডাক্ট হিসেবে বলা যায়। কিন্তু এর যাত্রা এখনো অব্যাহত আছে এবং প্রতিবছর বিক্রি বাড়ছে। বিজ্ঞাপন তো আছেই, সেই সঙ্গে ওয়ার্ড অব মাউথের কারণে এর প্রচার হচ্ছে এখনো।

তিব্বত পমেড শুরু থেকেই ক্রয়ক্ষাধ্যের মধ্যে আছে
তিব্বত পমেড শুরু থেকেই ক্রয়ক্ষাধ্যের মধ্যে আছে

টার্গেট কাস্টমার কারা

তিব্বত পমেড একদম শুরু থেকেই সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা হয়েছিল এবং এখনো ঠিক সেভাবেই আছে। অথচ এটি থেকে লাভ রাখা হয় খুবই সামান্য। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সব ধরনের গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো। একদম গ্রাম থেকে শুরু করে মফস্‌সল, শহরের সবাই যেন এটি ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য তিব্বত কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের পর থেকে সব বয়সীই এটির টার্গেট কাস্টমার বলা যায়। এর নিচের কম বয়সীরাও এটি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারবেন। এটি যেহেতু কিছুটা অয়েলি, কম বয়সীদের ভালো না–ও লাগতে পারে। দিনের বেলা লাগাতে অস্বস্তি হলে রাতে ঘুমানোর আগে লাগিয়ে নিলেও ত্বকের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। তিব্বত চায়, উপকারের কথা ভালোভাবে জেনে ও বুঝে সব বয়সীই এটি ব্যবহার করুক।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী


তিব্বত ব্র্যান্ডের অনেক পণ্য রয়েছে। সাবান, তেল, পমেড, পাউডার থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানা পণ্য নিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু ব্র্যান্ডের টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের পণ্য প্রয়োজন, সে জন্য পমেডসহ বিভিন্ন পণ্যেই তারা মনোযোগ দিচ্ছে। পমেড নিয়ে তারা অনেক অনুরোধ পেয়েছে এটির বড় কৌটা আনার জন্য, রং বদলানোর জন্য। এগুলো নিয়ে তিব্বত ভাবছে, কাজ করছে। যদি গ্রাহকের সন্তুষ্টি ধরে রেখে করা যায়, তাহলে সামনে নতুন মোড়কে দেখাও যেতে পারে ছোটবেলার স্মৃতিতে মুড়িয়ে থাকা তিব্বত পমেডকে।

মডেল: জেসিফার;

ছবি: অনিক মজুমদার

শ্যুটিং লোকেশন কৃতজ্ঞতা: এন'স কিচেন

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮: ০০
বিজ্ঞাপন