মাসুমা নামের এক বাংলাদেশি নারীর গল্প পড়ছিলাম কিছুদিন আগে। তাঁর জন্মের আগে থেকেই পরিবারের সবাই মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করতেন। এটা সাধারণ একটি তথ্য। তবে গল্পের ভিন্ন ব্যাপারটি ছিল অন্য জায়গায়। তাঁর পরিবার যখন দেশের বাইরে চলে যায়, তখনো তাঁদের সঙ্গে মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি প্যাক ছিল। যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে বসে তাঁর বড় বোন মেরিলের কৌটাটা নিয়ে খেলছিলেন, যেটার সঙ্গে লাগানো ছিল চকচকে প্রজাপতি সংযুক্ত স্টিকার। আমেরিকায় তাঁর বাবা যখন সারা দিন পর তিনটা চাকরি করে রাত তিনটায় বাড়ি ফিরতেন, তখন বাবার পায়ে মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে দিতেন তাঁর মা। মেরিলকে বলা হতো ভালোবাসা ও যত্নের প্রতীক; বিয়ের দিন নতুন বউকে উপহার হিসেবেও দেওয়া হতো। ৯০–এর দশকে ড্রেসিং টেবিলে আর কোনো প্রসাধনী থাকুক বা না থাকুক, মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলির পরিচিত সেই সাদা প্যাকটি থাকতই।
মাসুমার এই গল্প ঠিক যেন আমার নিজের জীবনের বলেই মনে হয়েছে। কারণ, আমিও অবিকল দৃশ্য দেখেছি আমার পরিবারে। আমার বাবার পায়ের জ্বালা কমাতে, চামড়া ফেটে যাওয়ার সমস্যা কমাতে তিনি নিজের কাছে সব সময় একটি মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলির প্যাক রাখতেন।
ভালোবাসার এসব গল্প আসলে বলে শেষ করা যাবে না। আমরা তার চেয়ে বরং একটু পিছিয়ে যাই। কীভাবে মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি আমাদের জীবনের অনবদ্য একটি অংশ হয়ে উঠল, কীভাবে এত বছর পরেও এই পণ্যটি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠল, সেই গল্পই না হয় জানা যাক আজ; দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে। এই পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন স্কয়ার টয়লেট্রিজের হেড অব মার্কেটিং ড. জেসমিন জামান।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৮ সালে; স্যামসন এইচ চৌধুরীর হাত ধরে। আর স্কয়ার টয়লেট্রিজের সূচনা ১৯৮৮ সালে। মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলির যাত্রা শুরু হয় স্কয়ার টয়লেট্রিজের শুরুর দিকে। মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলির যাত্রা শুরুর পেছনে একটা গল্প আছে।
প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী লক্ষ করেছিলেন যে পরিচিতজনেরা বিদেশ থেকে শীতের সুরক্ষার জন্য প্রচুর পরিমাণে পেট্রোলিয়াম জেলি নিয়ে আসেন। তিনি দূরদর্শিতার সঙ্গে বুঝতে পারেন যে ভবিষ্যতে ত্বকের সুরক্ষায় এই পণ্যের চাহিদা বাড়বে। তবে তিনি এটিকে প্রচলিতভাবে বাজারজাত না করে, আরও কার্যকর ও পুষ্টিকর করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই পেট্রোলিয়াম জেলির সঙ্গে লেমন ফ্লেভারসহ ত্বকের জন্য উপকারী বিভিন্ন উপাদান সংযোজন করে মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি বাজারে আনা হয়। গুণগত মান বজায় রেখে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যাওয়ায় শুরু থেকেই এটি গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীরও এই প্রসাধনী নিয়ে আলাদা অভিজ্ঞতা আছে। ৯০–এর দশকে নৌকায় করে যমুনা নদী পার হতে হতো। ওই সময়ে এক মাঝির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সেখানে সেই মাঝি বলেছিলেন, আপনারা ছোট কোনো জেলির প্যাক কেন আনেন না, যেটা আমরা লুঙ্গির ভাঁজে রাখতে পারি আর অল্প টাকায় কিনতে পারি? তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন মেরিলের এত জনপ্রিয়তা দেখে। এরপর মেরিলের ছোট প্যাক নিয়ে আসেন, যেন সবার জন্য সুলভ করতে ও এর ব্যবহার উপযোগিতা বাড়াতে।
মেরিলের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা এর গুণাগুণ। স্কয়ার কখনোই মেরিলের মান নিয়ে আপস করেনি। সেই সঙ্গে গ্রাহকদের সাধ্যের মধ্যে রেখেছে এর দাম। এত অল্প মূল্যে এত ভালো মানের পণ্য সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আবহাওয়ার নিত্য বদলের কারণে মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি তৈরিতে কিছুটা পরিবর্তন এলেও মান এখনো ঠিক আগের মতোই। শীতের সময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মেরিলের যেকোনো সাইজের একটি প্যাক পাওয়া যাবেই। সেই সঙ্গে নস্টালজিয়ার বিষয় তো আছেই।
মিথিলার সেই বিজ্ঞাপনটার কথা আপনাদের মনে আছে? ওই যে স্কুলের বাইরে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করা ছেলেটাকে পরম যত্নে মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে দেওয়া। এখনো যে কেউ আবেগতাড়ি হয়ে যান সেটি দেখে? একইভাবে আজও মেরিল আমাদের পরম যত্নে আগলে রেখেছে।
ত্বকের যত্নে বিশ্বস্ত এই প্রসাধনীতে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো সবই ত্বকের জন্য উপকারী। এতে পেট্রোলিয়াম জেলির সঙ্গে ভিটামিন সি ও ই, গ্লিসারিনসহ আরও কিছু উপকরণ রয়েছে। মেরিল নির্দ্বিধায় বলতে পারে, তাদের প্রতিটি প্রোডাক্ট তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, তার সবই সংগ্রহ করা হয় সেরা উৎস থেকে। চাহিদা, আবহাওয়া সবকিছু মিলিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিটামিনের পরিমাণের তারতম্য ঘটেছে, তবে মান কমেনি একটুও।
মেরিল শুরু থেকেই চেয়েছে জনসাধারণের নিত্য ব্যবহার্য একটি প্রসাধন পণ্য হয়ে উঠতে। সেই কারণে মূল্য যেমন নাগালের মধ্যে রাখা হয়েছে, তেমনি প্যাকেজিং যেন উন্নততর হয়, সেটাও নিশ্চিত করা হয়েছে। শুরু থেকেই পেট্রোলিয়াম জেলি প্লাস্টিকের কৌটায় রাখা হতো। এখনো সেভাবেই আছে। নকল যাতে না হয়, সে জন্য কৌটার উপরিভাগে মাঝে কয়েকবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, মেরিলের পেট্রোলিয়াম জেলির এই কৌটাগুলো রিসাইকেবল। এগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। কোন পণ্য গ্রাহক কীভাবে গ্রহণ করছে, হাতে নিয়ে তাদের ভালো লাগছে কি না, প্যাকেজিং নান্দনিক হয়েছে কি না, এসবই থাকে প্রোডাক্ট তৈরির আগ থেকেই। মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলির উৎপাদনেও এর ব্যত্যয় ঘটে না; বরং দিনের পর দিন মানুষের কাছে আদৃত হওয়ার নেপথ্যেও আছে সেই ভাবনা।
আপনাদের মনে আছে, মেরিলের প্যাকটি হাতে নিলে একটা চকচকে ভাব পাওয়া যেত? এদিক–ওদিক নাড়ালে প্যাকটির গায়ে থাকা প্রজাপতির রংটাও যেন বদলে যেত। এই প্রজাপতিটা ছিল স্বাধীনভাবে উড়তে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষারই প্রতীক। আমাদের ত্বক কোমল আর সুন্দর থাকলে আমাদেরও যেন একই রকম অনুভূতি হয়। আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। নিজের পরিচয়কে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে সময়ের সঙ্গে গ্রাহকদের চাহিদাও বদলে যায়। এ জন্যই এখন আর সেই প্রজাপতি নেই। গ্রাহকদের টেস্ট অনুযায়ী বেশ কয়েকবার পরিবর্তনও করা হয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে এই পণ্য তৈরি ও মোড়কজাত করতে। বর্তমানে মেরিলের কৌটার চারপাশে গোলাপি রঙের একটা লেবেল লাগানো আছে।
মেরিল বছরে কয়েক কোটি মানুষের ঘরে পৌঁছায়। এত বিপুল উৎপাদন সঠিকভাবে ধরে রাখতে হলে সহজ এই পদ্ধতি ছাড়া আসলে এই মুহূর্তে আর কোনো উপায়ও নেই। কাচের বোতলে হয়তো দেওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, রোদের তাপে জেলির ভেতরের উপাদান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সানবার্ন হতে পারে। আবার ভেঙে যাওয়ারও আশঙ্কা বাড়ে। জেলির সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য এই প্যাকেজিং বেছে নেওয়া। সেই সঙ্গে বহন করার ব্যাপার তো আছেই। এটা এখন সর্বনিম্ন ১৫ টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে, যেটা অন্যান্য ব্র্যান্ড দিতে পারছে না। রিসাইকেবল বলে পরিবেশের ক্ষতিও হচ্ছে না।
মেরিল শুরু থেকেই পুরো বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছে। গ্রাম, মফস্সল, শহরের প্রত্যেক মানুষই এর গ্রাহক। গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করে সব সময় টিকে থাকাই মেরিলের মূল লক্ষ্য। বর্তমানে মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলির পাশাপাশি লিপ বাম, লিপ জেল সংযুক্ত হয়েছে। বাজারে এগুলোর চাহিদাও বেশ ভালো। একজন গ্রাহক হয়তো জেলি চাচ্ছেন না, তিনি বাম নিচ্ছেন। আবার যিনি বাম চাচ্ছেন না, তিনি জেলি নিচ্ছেন। এভাবেই সব ধরনের গ্রাহকদের জন্য প্রসাধনী আছে। শুধু বড়দের জন্য নয়, নবজাতক থেকে শুরু করে সব বয়সী শিশুর জন্যও মেরিলের পণ্য আছে। বাংলাদেশে তারাই প্রথম শিশুদের এই সেগমেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন। যেটার চাহিদা এখনো দিন দিন বাড়ছে। সব মিলিয়ে মেরিল আগেও ভরসার জায়গা ছিল, এখনো আস্থার জায়গায় অটুট।
মডেল: মাহবুবা সুজানা
ছবি: অনিক মজুমদার