ত্বকে একেবারেই কোনো ধরনের সমস্যা নেই। শুনতে ভালো লাগলেও, বিষয়টি অসম্ভব। বিভিন্ন সময় আপনাকে ব্রণের দাগ, খসখসে রুক্ষ ত্বক, বড় লোমকূপ এমন সব ত্বকের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আপনার বয়সের বিভিন্ন পর্যায় থেকে শুরু করে সূর্যের আলো, ধুলাবালির মতো পরিবেশগত কারণগুলো আপনার ত্বকের গঠনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, একেবারে মসৃণ ত্বক পাওয়া কিছুটা কঠিন হলেও, কীভাবে ত্বকের গঠন উন্নত করা যায়, তা জেনে রাখা ভালো।
স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক পেতে চাইলে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে, ত্বক যেন সব সময় হাইড্রেটেড থাকে। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির চাহিদা পূরণ হলে, তা ত্বকেও ফুটে উঠবে। এছাড়াও ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করতে চাইলে, খাবারের প্রতিও যত্নবান হতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার, ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলতে হবে; এর পরিবর্তে প্রতিদিনের তালিকায় স্বাস্থ্যকর খাবার যোগ করতে হবে। সবশেষে, ত্বকের ধরন বুঝে সে অনুযায়ী ত্বকের যত্ন নেওয়া এবং স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে।
মসৃণ ও উজ্জ্বল ত্বক পেতে চাইলে টেক্সচার্ড ত্বক এবং ত্বকের গঠন সম্পর্কে জানতে হবে।
সবাই চায় দাগমুক্ত স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক। তবে হাজারো চেষ্টার পরেও কিন্তু কোনো না কোনো সমস্যা থেকেই যায়। কিন্তু আপনার ত্বকে কিছু অসমতা থাকবেই। ত্বকে ব্রণ, একজিমা বা যেকোনো চুলকানির দাগ; বড় লোমকূপ বা যেকোনো সূক্ষ্ম রেখা বা দাগ ত্বকে থাকতেই পারে। এটিকে ত্বকের অসমতাও বলা যায়। আর এর জন্যই ত্বক সবসময় শতভাগ মসৃণ থেকে না। মুখ, ঘাড়, হাত, পা ও পিঠ সহ শরীরের যেকোনো জায়গায় ত্বকের টেক্সচার লক্ষ্য করলেই সহজে বোঝা যাবে। তবে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে, ত্বক গঠন যেন পুরো মুখমণ্ডলে একই রকম থাকে।
ত্বকের গঠন বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো বাহ্যিক পরিবেশ, জীবনযাত্রা এবং ত্বকের স্বাস্থ্যের প্রভাব। এছাড়াও অন্যতম বড় একটি কারণ হল এপিডার্মিস বা ত্বকের একদম ওপরের স্তরে মৃত কোষ জমা হওয়া, লোমকূপ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ত্বকের রং নিস্তেজ হয়ে যাওয়া। অতিরিক্ত সিবাম ত্বকের লোমকূপগুলোকে বড় করে দেয়। আর তাই ত্বক তৈলাক্ত ও অসম হয়ে যায়। যা মূলত তৈলাক্ত বা সংমিশ্রিত ত্বকে বেশি প্রভাব ফেলে।
সূর্যের সংস্পর্শে ত্বকের কোলাজেন এবং ইলাস্টিন ফাইবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস করতে পারে। যার ফলে ত্বক হয় রুক্ষ। এমনকি ত্বক কুঁচকেও যেতে পারে।
প্রাকৃতিকভাবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোলাজেন এবং ইলাস্টিনের পরিমাণ হ্রাস পায়। তাই ত্বকের টানটান ভাব কমে আসে এবং ত্বকে অনিয়মিত গঠন তৈরি হয়। ২০২৩ সালে ভিশন রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, বার্ধক্যের ফলে ত্বকের গঠনে পরিবর্তন আসে যা পানিশূন্যতা এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাসের কারণে হতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী পানিশূন্যতা ত্বককে খসখসে এবং রুক্ষ করে তুলতে পারে। তাই, ত্বকের গঠন ঠিকঠাক রাখতে অবশ্যই নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত। এছাড়াও ভিটামিন সি এবং ই সমৃদ্ধ খাবার ও ফলমূল খেতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা ভালো। কারণ এই খাবারগুলো ত্বকের গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। মনে রাখতে হবে, ব্রণের দাগ এবং ত্বকের যেকোনো প্রদাহ পরবর্তী অন্যান্য পরিবর্তন মসৃণ ত্বক পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
মসৃণ ত্বক পেতে যে বিষয়গুলো নিয়মিত মেনে চলতে হবে।
যখন ত্বকের মৃত কোষগুলো এপিডার্মিস বা ত্বকের উপরিভাগে জমাতে শুরু করলে। ত্বক নিস্তেজ এবং রুক্ষ হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘রাসায়নিক এক্সফোলিয়েন্ট, যেমন আলফা-হাইড্রক্সি অ্যাসিড (AHAs) বা বিটা-হাইড্রক্সি অ্যাসিড (BHAs), ত্বকের মৃত কোষ দ্রবীভূত করতে পারে এবং কোষগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।’ আলফা-হাইড্রক্সি অ্যাসিড শুষ্ক বা বার্ধক্যের করণে ত্বকের যে সমস্যাগুলো হয় তা সমাধান করে। আর অন্যদিকে বিটা-হাইড্রক্সি অ্যাসিড তৈলাক্ত এবং ব্রণ প্রবণ ত্বকের জন্য বেশ কার্যকরী।
ডিহাইড্রেশন ত্বকের সুরক্ষা বেষ্টনিকে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে ত্বকে শুষ্কতা, ত্বক ফেটে যাওয়া এবং রুক্ষতা দেখা দেয়। তাই স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বকের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খাওয়া খুব জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘হায়ালুরোনিক অ্যাসিড বা গ্লিসারিনের মতো হিউমেক্ট্যান্ট সহ ময়েশ্চারাইজার বেছে নেওয়া উচিত। কারণ এই উপাদানগুলো ত্বকের পানি শোষণ করে ভালোভাবে’। সিরামাইড বা শিয়া বাটারের মতো অক্লুসিভ এজেন্টযুক্ত স্কিনকেয়ার প্রডাক্টস ত্বকে আর্দ্রতা আটকে রাখতে সাহায্য করে।
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের কোলাজেন, ইলাস্টিন ভেঙে দেয় এবং ত্বকে রুক্ষতা, বলিরেখা এবং দাগছোপ সৃষ্টি করে। ত্বকের টেক্সচার পরিবর্তন হওয়া থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন ব্রড-স্পেকট্রাম সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল ডার্মাটোলজিতে প্রকাশিত ২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা ৫২ সপ্তাহ ধরে ব্রড-স্পেকট্রাম সানস্ক্রিন (SPF 30) ব্যবহার করেছিলেন, তাদের ত্বকের গঠনে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি হয়েছে।
রেটিনয়েড, ভিটামিন এ সমৃদ্ধ স্কিনকেয়ার প্রডাক্টগুলো কোলাজেন উৎপাদন বৃদ্ধি করে। এগুলো ত্বকের কোষ পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে এবং বলিরেখার পাশাপাশি ব্রণের দাগ কমাতেও সাহায্য করে।
প্রোটিন ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্যের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনগগুলোর মধ্যে একটি হলো কোলাজেন যা ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা এবং মসৃণতা বজায় রাখে। আপনি যদি ত্বকের গঠন উন্নত করতে চান, তাহলে আপনার ত্বকের যত্নে অ্যান্টি-কোলাজেন-ক্ষয়কারী উপাদান আছে এমন স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে হবে।
স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বকের জন্য পুষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মসৃণ ত্বকের জন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এবং স্বাস্থ্যসম্মত চর্বি সমৃদ্ধ খাবার খান। ভিটামিন সি কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে এবং মাছ ও তিসির বীজে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে। প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে চলুন। এগুলো কোলাজেন এবং ইলাস্টিনের ক্ষতি করে। ২০২৪ সালে নিউট্রিশনে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার এবং পরিশোধিত চিনি ত্বকের জন্য ক্ষতিকর।
ব্রণ হলে ত্বকে ব্রণের দাগ থেকে যে হাইপারপিগমেন্টেশন বা দাগ হয়, তা ত্বকের গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। এই সমস্যাটি এড়িয়ে যেতে নন-কমেডোজেনিক স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করা উচিত। যা আপনার লোমকূপগুলোকে আটকে রাখবে না। এছাড়াও ব্রণ কমাতে নিয়াসিনামাইড বা বেনজয়াইল পারক্সাইড ব্যবহার করলে কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায়।
ত্বক অতিরিক্ত মাত্রায় পরিষ্কার করা বা ত্বকে ক্ষারীয় ক্লিনজার ব্যবহার করলে ত্বকে থাকা ন্যাচারাল ওয়েল বা প্রাকৃতিক তেল বের হয়ে যেতে পারে। এর ফলে ত্বকের লিপিড ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। তাই এমন ক্লিনজার ব্যবহার করতে হবে যাতে হাইড্রোজেনের মাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকে। এতে ত্বকের গভীর থেকে ময়লাও পরিষ্কার হবে, সঙ্গে ত্বকে হাইড্রেশনের মাত্রাও ঠিক থাকবে।
ত্বকের ভালো টেক্সচার এর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, মসৃণ ত্বক পেতে চাইলে অবশ্যই প্রতিদিন কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। গভীর ঘুমের সময়ই আপনার ত্বক পুনরুজ্জীবিত হয় এবং ক্ষতগুলো সারে।
স্ট্রেসের সঙ্গে কিন্তু ত্বকের ভালো খারাপ জড়িত। দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস শুধু মানসিক শান্তিই নষ্ট করে না, বরং এতে করে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং কোলাজেন উৎপাদনেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এছাড়াও স্ট্রেসের কারণে ত্বক রুক্ষ, শুষ্ক হতে পারে এবং ব্রণও হতে পারে। তাই সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক পেতে চাইলে অবশ্যই স্ট্রেস কন্ট্রোল এবং ম্যানেজ করতে হবে।
ছবি: পেকজেলসডটকম ও ইনস্টাগ্রাম