চুল মানবদেহের অলঙ্কার সমতুল্য। যুগে যুগে মানুষের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে কবি-সাহিত্যিকেরা চুলকে করেছেন লেখার উপজীব্য। কালান্তরে চুল নিয়ে গবেষণারও শেষ নেই। সেই সপ্তম শতকে চীনের সুই রাজবংশের চিকিৎসকেরা (সুই ডাইনেস্টি-৫৮১-৬১৮ খ্রি.) চুল নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন, চুল আঁচড়ানোর মতো সহজ একটি কাজ করার কারণে চুল উজ্জ্বল সুন্দর হয়, চুল পড়া কমে, এমনকি মাথাব্যথা উপশম হয়। আরও জানা যায়, এটি মনকে প্রশান্ত করে এবং ভালো ঘুম হতে সহায়তা করে। তাই সুই চিকিৎসকেরা ঘুমানোর আগে চুল আঁচড়ানোর সুপারিশ করতেন। ত্বকবিশেষজ্ঞরা দিনে দুই থেকে তিনবার চুল আঁচড়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। চুল না আঁচড়ানোকে চুল পড়ে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে দেখেন কেশবিশেষজ্ঞরা।
নিয়মিত আঁচড়ানোর ফলে চুলের যে গুণগত মানোন্নয়ন হয়, সে সম্পর্কে অকাট্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। আমাদের মাথার ত্বকে সিবেশাস গ্রন্থি থেকে একধরনের তৈলাক্ত পদার্থ তথা সিবাম উৎপন্ন হয়, যা চুলের ফলিকলে পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। নিয়মিত আঁচড়ালে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন তেল চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া চিরুনির আঁচড় গ্রন্থিগুলোকে উদ্দীপিত করে মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং প্রচুর অক্সিজেন প্রবেশ করতে সাহায্য করে। তথাপি চুলে সঠিক পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত হয়। উপরন্তু তা মাথায় এক্সফোলিয়েটের কাজ করে বলে ত্বকের মৃতকোষগুলো অপসারিত হয়। রুটিনমাফিক আঁচড়ানোর ফলে এক দিকে চুল যেমন পরিষ্কার থাকে, অন্য দিকে চুল হয় ঝরঝরে ও শাইনি। বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহারের কারণে কিছু বাই-প্রোডাক্ট তথা উচ্ছিষ্ট বস্তু শুষ্ক অবস্থায় চুলে রয়ে যায়। এ ছাড়া ধুলাবালি ও তেল জমে চুলকানি, চুলে জট লাগাসহ নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য করবে চিরুনির আঁচড়।
চুলের যত্নআত্তি করতে গিয়ে মানুষ নানা রকম রাসায়নিক প্রসাধনী কিংবা হেয়ারপ্যাক ব্যবহারেই ব্যস্ত থাকেন, মাঝে চুল আঁচড়ানো ও যথাযথ চিরুনির ব্যবহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি অগোচরেই রয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে চুলের ধরন অনুযায়ী সঠিক চিরুনি অথবা হেয়ারব্রাশ নির্বাচন একান্ত জরুরি। পাতলা চুল আঁচড়াতে সরু দাঁতের চিরুনি ব্যবহার করা উচিত, আবার যাঁদের চুল ঘন তাঁরা এত সরু দাঁতের চিরুনি ব্যবহার না করাই ভালো। শুষ্ক-রুক্ষ চুলের জন্য বোর-ব্রিসল ব্রাশ হতে পারে একটি আদর্শ হাতিয়ার। এর মজবুত হাতল আর ফ্লাট বেজ আপনার চুলে প্রাকৃতিক তেল ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে।
আপনার চুল যখন অনেক লম্বা, তখন চুলে জট লেগে যাওয়ার প্রবণতা থাকে বেশি। এতে চুল ভঙ্গুর হয়ে যায় বলে সহজেই পড়ে যায়। লম্বা চুলের অধিকারীরা এ সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পেতে বেছে নিতে পারেন ডিট্যাংগল্ড ব্রাশ। এতে রয়েছে মজবুত হাতল আর তুলনামূলক ফাঁকা সারি সারি দাঁত। কোঁকড়া চুলের অধিকারীরা ব্যবহার করতে পারেন বড় চওড়া দাঁতের প্যাডেল ব্রাশ অথবা নমনীয় কুশন ব্রাশ। এ ছাড়া ছোট থেকে মাঝারি দৈর্ঘ্যের চুলে সিঁথি করতে কিংবা পছন্দমতো হেয়ারস্টাইল করতে ব্যবহার করতে পারেন পিনটেইল চিরুনি, যার দাঁতগুলো হয় ছোট আর হাতলটি বেশ সরু। চিরুনি যেমনই হোক না কেন মনে রাখতে হবে, নিম্নমানের প্লাস্টিকের চিরুনি অপেক্ষা কাঠের চিরুনি অধিকতর কেশবান্ধব।
বারবার চুল আঁচড়ানোর ফলে আপনার চিরুনি বা চুলের ব্রাশ খুব দ্রুত নোংরা হয় আর চিরুনিতে ভর করে তা চুলেও পরিবাহিত হতে পারে। তাই চিরুনি পরিষ্কার করছেন মানে আপনি আংশিকভাবে চুলও পরিষ্কার করছেন। একটি পাত্রে কুসুম গরম পানিতে লিকুইড সাবান বা শ্যাম্পু ফেনা করে ব্যবহৃত চিরুনি ভিজিয়ে রাখুন অন্তত ৩০ মিনিট। তারপর একটি পরিষ্কার ব্রাশ দিয়ে ঘষেঘষে পরিষ্কার করে নিন, যাতে লেগে থাকা চুল, তেল, ময়লা ও অন্যান্য জীবাণু সম্পূর্ণ অপসারিত হয়। চিরুনি পরিষ্কার করার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, তবে যত বেশি বার করা যায়, ততই মঙ্গল।
দৈনন্দিন রূপচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ চিরুনির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে খুব সহজেই পেতে পারেন স্বাস্থ্যোজ্জ্বল-দীপ্তিময় চুল, পাশাপাশি বাঁচাতে পারেন অর্থ ও সময় উভয়ই।
ছবি: পেকজেলসডটকম