‘দেশি ফল বেশি খাই, আসুন ফলের গাছ লাগাই’—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত এবারের মেলায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং দেশি ফলের পুষ্টিগুণ ও বাণিজ্যিক গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। মেলায় ৭৫টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। প্রদর্শিত হচ্ছে নানা জাতের আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, পেয়ারা, পেঁপে, ডাব, গোলাপজাম, আনারসসহ বহু স্বাদ ও গুণের দেশি ফল। এমনকি বিলুপ্তপ্রায় বা অপ্রচলিত ফল ও সম্ভাবনাময় নতুন জাতের ফলও স্থান পেয়েছে স্টলগুলোয়।
রাজধানীর বাইরেও দেশের ৬৪ জেলার ৪৩১টি উপজেলায় একযোগে আয়োজন করা হয়েছে এই মেলার, যা পরিণত হয়েছে দেশজ কৃষি ঐতিহ্যের এক প্রাণবন্ত প্রদর্শনীতে।
মেলায় বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। কাঁঠালের বৈচিত্র্যময় খাবার আছে এখানে; যেমন—কাঁঠালের বার, চিপস, জ্যাম, জেলি, বার্গার, কেক, কাঠি কাবাব, বিরিয়ানি, পিঠা, পাকোড়া, কাঁঠাল বিচির কোরমা, বরফি, হালুয়া, আচার ইত্যাদি; আর এসব দেখে দর্শনার্থীরা মুগ্ধ।
মানিকগঞ্জের খাঁটি কৃষি সংগঠনের উদ্যোক্তা সেলিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা কাঁঠাল দিয়ে ২৮ রকমের খাবার বানাই। এই মেলায় দেশের মানুষকে কাঁঠালের গুণ ও বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখাতেই এসেছি।’
উদ্বোধনের পর আয়োজিত সেমিনারে ‘স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও বাণিজ্যিকীকরণে দেশি ফল: বর্তমান প্রেক্ষিত, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, গবেষক ও শিক্ষাবিদেরা।
কৃষি উপদেষ্টা বলেন, ‘বর্তমানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ফলের প্রয়োজন ২০০ গ্রাম, কিন্তু আমরা খাচ্ছি মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ গ্রাম। এই চাহিদা পূরণ করতে হলে ফল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটাতে হবে, যেটা আমরা চাল উৎপাদনে করেছি।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘দেশীয় ফলকে পরিচিত করতেই এমন মেলার আয়োজন। এটি শুধু প্রদর্শনী নয়, বরং পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি করছে।’
সেমিনারের মূল প্রবন্ধে দেশীয় ফলের বহুমুখী সম্ভাবনা তুলে ধরেন বাউয়ের অধ্যাপক আজিজুর রহমান।
কৃষি উন্নয়ন বিভাগের সদস্য এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, ‘ফল খাওয়ার পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণও জরুরি। কাঁঠালের মতো পুষ্টিকর ফল আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
‘আমরা শুধু ফল উৎপাদন নয়, সেই ফল সংরক্ষণ, ভ্যালু অ্যাডিশন এবং বাজারজাতকরণেও কাজ করছি। কাঁঠাল থেকে তৈরি ২০টি বেশি পণ্য আজ প্রদর্শিত হয়েছে, যার মধ্যে কিছু কাঁঠাল কাঠের তৈরি সামগ্রীও ছিল,’ জানান কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পরিচালক মনসুর আলম খান।
মনসুর আলম খান আরও বলেন, ‘আমরা “ড্রাইওয়াল” ও “চিপস”-এর মতো নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করছি। ফল শুধু খাওয়ার জন্য নয়, এর বহুমাত্রিক রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরতে চাই।’
মেলার অন্যতম লক্ষ্য দেশীয় ফল উৎপাদনের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। আয়োজকেরা বলেন, দেশি ফল জনপ্রিয় করতে হলে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, উন্নত সংরক্ষণব্যবস্থা ও বাজার নিশ্চিত করতে হবে।
মনসুর আলম খান মনে করেন, ‘এ দেশে যেমন ফল আছে, এমন বৈচিত্র্যময় রঙিন ফল বিশ্বের খুব কম দেশেই আছে। এই মেলার মাধ্যমে মানুষ সেই সৌন্দর্যকে অনুভব করছে। যদি সাধারণ মানুষের সাড়া ভালো হয়, তবে এর ধারাবাহিকতা থাকবে। তবে গণমাধ্যমের সাড়া আরও ভালো হলে আমরা আরও সামনে এগিয়ে যেতে পারতাম।’ জাতীয় ফল মেলা শুধু পুষ্টি সচেতনতার বার্তা দেয়নি, বরং উদ্ভাবনী উদ্যোক্তাদেরও তুলে ধরেছে, যাঁরা দেশীয় সম্পদকে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিতে চান। দেশি ফলকে জনপ্রিয় করতে হলে গ্রামীণ নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে, উন্নত সংরক্ষণব্যবস্থা ও বাজারের ব্যবস্থা করতে হবে, জানান আয়োজকেরা।
জাতীয় ফল মেলা শুধু ফলের প্রদর্শনী নয়, এটি কৃষি অর্থনীতি, পুষ্টি ও নারীর ক্ষমতায়নের মেলবন্ধন। এমন উদ্যোগে দেশীয় ফলের ভবিষ্যৎ অনেক বেশি সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) সকালে এই মেলার উদ্বোধন করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। মেলা চলবে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, শেষ হবে ২১ জুন, শনিবার।
ছবি: হাল ফ্যাশন