ভাষার মাসে সব ভাষার প্রতি সমান মর্যাদা ও শ্রদ্ধা জানাতে প্রজেক্ট ‘ভাসা ভাষা ভালোবাসা’ শিরোনামে মিরপুর ১৪ নম্বরে ২১টি দেয়াল রাঙিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের সুপরিচিত কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশু ও তাঁর দল। তাঁদের সহযোগিতা করেছে নিপ্পন পেইন্ট বাংলাদেশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মোরশেদ মিশু, ইউএনডিপি বাংলাদেশ আর এশিয়ান পেইন্টসের সঙ্গে মিলে মিরপুর ১৪-এর পুলিশ ফাঁড়ির উল্টো দিকের পথচারী-সড়কটি পরিষ্কার করে নানা রঙে রাঙিয়েছিলেন। ফ্ল্যাশমপ নামের ওই উদ্যোগ সাড়া জাগিয়েছিল বেশ। দু-তিন মাস না যেতেই ময়লার স্তূপ ও মূত্রের দুর্গন্ধে বেহাল দশা হয় জায়গাটির। হাল না ছেড়ে আবার সড়কটিকে রাঙানোর কথা ভাবেন উদ্যমী এই শিল্পী। এবারের প্রজেক্ট ‘ভাসা ভাষা ভালোবাসা’। প্রজেক্টের নাম ও দেয়ালের সংখ্যা থেকেই কাজের থিম ও অনুপ্রেরণা আন্দাজ করা যায়।
ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা ও ভাষার মাস। এই মাসে তাই ভাষা ও ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে দেয়ালগুলো রঙিন করে তুলেছেন মিশু ও তাঁর দল সৃজনশীল কর্মে। এই পথচারী-সড়কের ২১টি দেয়াল রাঙাতে বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার কিছু শব্দ বেছে নেওয়া হয়েছে। সিলেট অঞ্চলের নিজস্ব যে বর্ণমালা, তা-ও ফুটে উঠেছে মিশুর গ্রাফিতিতে। লিখেছেন সাঁওতাল ভাষায় ‘সিনে’, যার মানে ‘পাখি’, ‘দুলোডু’ মানে ভালোবাসা’; ম্রো ভাষায় ‘পাওমুম’, বাংলা অর্থ ফুলের কলি; গারোদের আচিক ভাষায় ‘নাম্মি’, বাংলা অর্থ ‘ভালো’।
জায়গা পেয়েছে ত্রিপুরা ভাষায় ‘দাওফ্রিওফাইদি’, যার অর্থ ‘তাড়াতাড়ি এসো’; মারমা ভাষার প্রচলিত শব্দ ‘শিকুবায়া’ অর্থ সালাম, চাকমা ভাষায় ‘ফাত্তো’, বাংলায় যাকে বলে ‘ভবঘুরে’; এসব শব্দের সঙ্গে জোট বেঁধেছে বিভিন্ন বাংলা শব্দও। লেখা হয়েছে ‘মা’, ‘উল্লাস’, ‘শহরের দুটি গান’, ‘শেষ পর্যন্ত’, ‘হ য ব র ল’, ‘বাঘের বাচ্চা’, ‘মাঝামাঝি’, ‘প্রিয় পৃথিবী’, ‘হোক কলরব’, ‘উন্মাদ’, ‘জাদুর শহর’ ইত্যাদি। ফুটে উঠেছে কাজ করা শিল্পীদের কিংবা পথচারীদের প্রতিক্রিয়া—‘সুখী’, ‘আনন্দিত’, ‘তাই আলহামদুলিল্লাহ’ ও ‘জি ধন্যবাদ’ গ্রাফিতিতে। কিন্তু এবারও দেয়ালগুলো নোংরা হবে না, তার তো নিশ্চয়তা নেই। সেগুলোকে পরিষ্কার রাখতেই পরিকল্পনা করেন মিশু ‘আয়নাবাজি’ নামে এক অভিনব উদ্যোগের।
দেয়ালসংলগ্ন স্থানে ময়লা ফেলা ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ঠেকাতে আয়না বসানোর উদ্যোগ নেন এই কার্টুনিস্ট। আয়না নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মিশু। কাচ ভঙ্গুর। দুর্ঘটনা এড়াতে স্টেইনলেস স্টিলের মিরর শিট ব্যবহার করা হয়েছে। এখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এখানে বসে পড়া খানিকটা বিপজ্জনকই বটে। নিজের প্রতিবিম্ব যেমন দেখা যাবে, পেছন থেকেও লোকজন দেখতে পাবে সব। তাই মিশু আশা করছেন, এখন থেকে জায়গাটি সুন্দর কাজে ব্যবহার হবে। শার্টের ইন ঠিক আছে কি না, চুল বাঁধা হয়েছে কি না কিংবা কপালের টিপটা ঠিক জায়গায় বসেছে কি না, তা দেখে নিতে পারবেন পথচারীরা।
শুধু আয়নাবাজি নয়, এই রাস্তায় যে যাত্রীছাউনিটি আছে, সেটিকেও ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছেন মিশু ও তাঁর দল। ছাউনিতে বসার জায়গার পাশাপাশি করেছেন তাকের ব্যবস্থা। তাকগুলোর ব্যবহার জানাতে রঙিন কালিতে লিখে রেখেছেন নির্দেশনাও। মোরশেদ মিশুর ভাষায়, ‘আমরা পথচারী-সড়কটার পাশাপাশি এখানে যাত্রীছাউনিটা ব্যবহারে উপযোগী করার চেষ্টা করেছি। দুটি তাক লাগানো হয়েছে এখানে। তাকের ওপর বসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ চাইলে তার বাসায় প্রয়োজন নেই—এমন জিনিস, যেমন বাচ্চাদের খেলনা, বই, খাতা, কলম, পেনসিল এখানে রেখে যেতে পারবে। পরে যার প্রয়োজন, সে নিয়ে যেতে পারবে।’
চারপাশের পরিবেশের প্রভাব পড়ে আমাদের মনে। নোংরা পরিবেশ আমাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ করে। আর সুন্দর ও রঙিন পরিবেশ মানুষের মনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। এসব ভেবে মোরশেদ মিশু এই জায়গায় দুটি দোলনার ব্যবস্থাও করেছেন, যাতে পথচারী শিশুশিক্ষার্থীরা মন চাইলে একটু বসে দোল খেতে পারে।
রাস্তায় এভাবে ময়লা ফেলা ও মলমূত্র ত্যাগের ব্যাপারে মিশু কাউকে দোষারোপ করতে চান না। তাঁর ভাষ্যে, ‘একটা বদভ্যাস পরিবর্তন হতেও সময় লাগে! আর রাস্তাঘাটেও পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই, যা মানুষ ব্যবহার করবে। তা ছাড়া পাবলিক টয়লেট বাদেও মসজিদ-মাদ্রাসা অথবা শপিং মলে গিয়ে কাজটা করবে, সেই সচেতনতাও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সে কারণেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এই রাস্তাগুলো ব্যবহার করে লোকজন।’
মাতৃভাষা মানে তো মায়ের ভাষা। মা কাউকে ছোট করতে, অসম্মান করতে শেখায় না। বাংলাকে অতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য ভাষাকে অসম্মান করা কখনোই উচিত নয় বলে মনে করেন আশাবাদী এই তরুণ। তাই সব ভাষার প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। সবাইকে পাশে পেলে ও যথোপযুক্ত সাহায্য পেলে ভবিষ্যতে পুরো শহরকে রাঙাতে চান মোরশেদ মিশু।
ছবি: রাইয়ান জামান