
সমুদ্রের নীল জলরেখা আর সোনালি বালুর বুক চিরে তিন দিন ধরে ছুটবে ‘কোস্টাল আলট্রা ২০২৫’-এর দৌড়। এ আয়োজন শুধু আলট্রা ম্যারাথন নয়, এ এক অনন্য যাত্রা, যেখানে কাব্যের মতো বুনে যাবে সাহস, অঙ্গীকার এবং নারীর নিজস্ব শক্তির গল্প। কারণ, এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন ১৫ জন অসাধারণ নারী, যাঁরা নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এক নতুন ইতিহাসের পথে পা বাড়িয়েছেন। এ যেন নারীর আত্মশক্তির জাগরণ, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ একেকটি ছন্দ। তাঁরা কেউ মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, কেউ বা হয়েছেন পর্বতের মতো অটল সংকল্পের প্রতীক।

দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ ধরে এই দৌড় কেবল প্রতিযোগিতাই নয়, এটি প্রতীক—নারীর অদম্য স্পৃহার। জীবনের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা এই নারীরা প্রমাণ করছেন, সাহসিকতার কোনো লিঙ্গ নেই। তাঁরা গৃহিণী, পেশাজীবী, আবার কেউ কেউ প্রথমবারের মতো আলট্রা দৌড়ের মাঠে নেমেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই একটি গল্প আছে, যেখানে সংগ্রাম আছে, আছে বিজয়ের গান। আর শারীরিক সক্ষমতা এবং মানসিক দৃঢ়তার এমন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে সিদ্ধান্ত নিতে পারাই তো এক বিজয়।
কোস্টাল আলট্রার এই ১৫ নারীর মধ্যে কেউ ৫০ বা ১০০ কিলোমিটারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আবার কেউ চ্যালেঞ্জ করেছেন ২০০ কিলোমিটারের মতো দীর্ঘ পথ। দৌড়ের প্রতিটি মাইল যেন তাঁদের আত্মবিশ্বাসের মাইলফলক। সমুদ্রের ঢেউ যেমন অবিরাম ছুটে চলে, তেমনই তাঁদের দৃঢ় সংকল্প কোনো বাধাকে থামতে দেয় না।

ম্যারাথন দূরত্ব বা ৪২.২ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের দৌড়কে বলা হয় আলট্রা ম্যারাথন। কিন্তু ২০-২২ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য কোস্টাল আলট্রা আরও কয়েক কাঠি সরেস। এতে আছে মোট চারটি ক্যাটাগরি—৫০ কিমি, ১০০ কিমি, ১৬১ কিমি এবং ২০০ কিমি, যা অতিক্রম করতে হবে যথাক্রমে ৮, ১৮, ৩২ এবং ৪২ ঘণ্টার মধ্যে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্বাচিত চার শতাধিক প্রতিযোগী ছাড়াও এতে আছে দাতব্য অংশগ্রহণের সুযোগ, যা খেলার সঙ্গে মানবিকতার সংযোগের এক অনন্য উদাহরণ।
‘কে হতে চান দেশের পরবর্তী ইতি!’ নিবন্ধনের শুরুতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আয়োজকদের এই আহ্বানকে আপাতদৃষ্টিতে এক প্রশ্ন মনে হলেও, আসলে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। ইতি সম্পর্কে জানলেই এই চ্যালেঞ্জ পরিষ্কার হবে।
এ যাবৎ একই ইভেন্টে ১০০ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব দূরত্ব মাত্র তিনবার অতিক্রম করতে পেরেছেন এই লাল-সবুজের দেশের নারী! আর এই তিনটি অর্জনই এসেছে একই নারীর পা ধরে। তিনি সিফাত ফাহমিদা ইতি—দেশের প্রথম নারী আলট্রা রানার। নারীরা নিরাশ করেননি। কোস্টাল আলট্রা ইভেন্টের গণ্ডি পেরিয়ে হতে চলেছে নারীশক্তির জয়গান। নারীর অদম্য শক্তি, স্বপ্ন দেখার সাহস এবং অতিক্রম করার সাহসিকতা যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে, তা এই ১৫ নারীর পদচারণে স্পষ্ট।

দেশের ইতিহাসে এই প্রথম অনুষ্ঠিতব্য ২০০ কিলোমিটার ক্যাটাগরিতে দৌড়াবেন ইতি, যা তাঁর জন্যও নতুন চ্যালেঞ্জ। ১০০ মাইল ক্যাটাগরিতে কোনো নারী না থাকলেও ১০০ কিলোমিটার ক্যাটাগরিতে আছেন চারজন! সফল না হলেও ইতিপূর্বে আরও ২ নারী ১০০ কিলোমিটার অতিক্রমের চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। তাঁদের একজন ডা. নাদিয়া ইসলাম নিতুল আবারও নামছেন নিজের অসমাপ্ত অধ্যায় সমাপ্ত করতে। আরও আছেন দেশের প্রথম নারী হিসেবে আয়রনম্যান ৭০.৩ কিলোমিটার ফিনিশার ফেরদৌসী আক্তার মারিয়া, পর্বতারোহী নুরুন্নাহার বেগম নিম্নি এবং অল্পদিনেই দৌড়ের জগতে নিজের সরব উপস্থিতি জানান দেওয়া নাসরিন আক্তার। ৫০ কিলোমিটারে আছেন মোট ১০ জন নারী, যাতে আছে অভিজ্ঞতার সঙ্গে নতুন উদ্দীপনার মিশেল।
অভিজ্ঞদের মধ্যে আছেন লাদাখ ম্যারাথন এবং বুদ্ধা ট্রেইল জয়ী নোশিন শারমিলি শুচি, একাধিকবার ৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করা ডা. মুনমুন চৌধুরী, কাজী হাবিবা জান্নাত। আছেন দৌড়ের জগতে পুরোনো নারীমুখ সাদিয়া আহমেদ খেয়া, জান্নাতুল ফেরদৌস টুম্পা। এ ছাড়া আছেন হালে নিয়মিত প্রশিক্ষণে থাকা তামান্না চৌধুরী, শামীমা ইয়াসমিন, রুহি আক্তার, রেহনুমা প্রসূন ও ইসফাত নাসরিন তিমি।
কোস্টাল আলট্রা কর্তৃপক্ষ মনে করে, এই নারীরা কেবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন না; তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠছেন। তাঁদের গল্প ভবিষ্যতের নারীদের আরও সাহসী করে তুলবে, জীবনের পথে নতুন দৌড় শুরুর অনুপ্রেরণা জোগাবে।
সমুদ্র যেমন থেমে থাকে না, নারীর এই পদচিহ্নও থামবে না। ওরা চলবে সম্মুখে, অতিক্রম করবে সীমা, আর তৈরি করবে এক নতুন ইতিহাস। কোস্টাল আলট্রাতে ওদের ছুটে চলার পদধ্বনি শুধু প্রতিযোগিতার নয়, বরং নারীর সাহস, দৃঢ়তা এবং ক্ষমতায়নের মাইলফলক হয়ে থাকবে।
ইমেইল: [email protected]
ছবি: কোস্টাল আলট্রা ২০২৫–এর ফেসবুক পেজ ও সংগ্রহ