গুলশান তেজগাঁও লিংক রোডের আলোকি কনভেনশন হলে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী ঢাকা মেকার্সের তৃতীয় আসর। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা উদ্যোক্তা আর চারু ও কারুশিল্পীদের নিয়ে হচ্ছে এই আয়োজন। আলোকির গ্রিনহাউজ দারুণভাবে সাজানো হয় প্রতি ইভেন্টে। ঢাকা মেকার্সে এখানে এবার রাখা হয়েছে ক্র্যাফট মার্কেট। এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন প্রান্তিক কারুশিল্পীরা।
পুরো হলটিকে সাজানো হয়েছে জামদানি দিয়ে তৈরি লন্ঠনে। আছে রংপুরের শতরঞ্জি, সিলেট থেকে আসা কারিগরের তৈরি শীতলপাটি, কিশোরগঞ্জের কারুশিল্পীর তৈরি টেরাকোটা, ঝিনাইদহ থেকে আসা গোপেন্দ্র নাথের শোলা দিয়ে তৈরি কারুকার্য, সোনারগাঁওয়ের আশুতোষ সূত্রধরের কাঠের তৈরি খেলনা, নকশিকাঁথা, কাঠ দিয়ে তৈরি হস্তশিল্প, নারকেলের খোল দিয়ে তৈরি অনুষঙ্গ, জামদানি, বাঁশের প্রাকৃতিক কারুশিল্প, হোগলা পাতা ও পাট দিয়ে তৈরি তৈজসপত্র, পটচিত্র থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু।
মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই পাশাপাশি চোখে পড়ে শতরঞ্জি ও শীতল পাটি। রংপুরের স্থানীয় কারিগরদের নিয়ে শতরঞ্জির কাজ করছেন সেখানকার নয়নমনি সরকার। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ২০১১ সাল থেকে রংপুর ক্র্যাফটসের যাত্রা শুরু। ঢাকা মেকার্সে প্রথম এলেও ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় প্রতিবছরই স্টল দেন তাঁরা।
শতরঞ্জির ঠিক পাশেই রয়েছে শীতলপাটি। চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে শীতলপাটি বানানোর সঙ্গে যুক্ত হরেন্দ্র কুমার দাস। এসেছেন সিলেট থেকে। জানালেন এটি তাঁর পৈতৃক পেশা। মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে এ কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর তৈরি শীতলপাটিগুলো সাধারণ পাটি নয়। নকশা করা বলে, এর নাম নকশি শীতল পাটি। রঙিন ও সাদা দুই ধরনের পাটি তৈরি করে থাকেন তিনি। তাঁর সংগ্রহের সবচাইতে বড় শীতলপাটি তৈরি করতে সময় লেগেছে দেড় বছর। তিনি বলেন, বর্তমানে নকশি শীতলপাটি প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। দেশীয় শিল্পে তরুণ প্রজন্মের অনাগ্রহেই এমন হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
শীতলপাটির সামনে আছে শোলা, টেরাকোটা ও কাঠ দিয়ে তৈরি খেলনার স্টল। শোলায় তৈরি ফুলের মালা ও কদম বেশ বিক্রি হচ্ছে। হাতি ও পুতুলের মিনিয়েচার টেরাকোটাও সকলে বেশ পছন্দ করছেন। তবে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি নজর কাড়ছে তা হলো কাঠের তৈরি স্মৃতিমাখা খেলনা টমটম।
চট্টগ্রাম থেকে বাঁশের তৈরি ন্যাচারাল ব্যাম্বু ক্র্যাফটস নিয়ে এসেছেন প্রবীর কুমার দাস পূজন। তিনি জানালেন, এখানে এসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে তাঁর বাঁশের ওপর করা পেইন্টিংগুলি। এছাড়াও বাঁশে তৈরি কফি কাপ, কাপ, মোমবাতির স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে অনেককিছুর দেখা মিলবে এখানে।
সামনেই নারকেলের মালায় তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে আছেন জিয়া ও নাভেদ। তাঁদের দুজনের এই অভিনব শিল্পোদ্যোগের নাম আইচা। জিয়া জানালেন, বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলা থেকে তাঁরা নারকেলের মালা সংগ্রহ করেন। বরিশালের খ্রিস্টান পাড়ার কারিগরেরা এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত। অধিকাংশ পণ্য এসব কারিগরেরই তৈরি। স্থানীয় ভাষায় নারকেলের মালাকে বলে আইচা। তাই নিজেদের উদ্যোগের এমন নামকরণ করেছেন তাঁরা।
আইচার ঠিক সামনেই মোহাম্মদ মানিকের কাঠের তৈজসপত্র নিয়ে আছে শেকড-এর উদ্যোগ। মোহাম্মদ মানিক জানান, এটি তাঁর পৈতৃক ব্যবসা৷ বাবার কাছ থেকে কাঠের কাজ শিখেছেন। পুবাইলে নিজের বাড়িতে বসে এসব তৈরি করেন। তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেন বেশ কয়েকজন কর্মচারী।
গ্লাসহাউজের এককোণে নকশিকাঁথা নিয়ে আছে সুরাইয়া রহমানের আরশি। সুরাইয়া রহমান হলেন একজন সুপরিচিত বাংলাদেশি কারুশিল্পী যিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান আরশির মাধ্যমে নকশিকাঁথাকে তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে। একই সঙ্গে আছে মাতারবাড়ি টেলস। ইউল্যাব ও ব্রোক এর তত্ত্বাবধানে মাতারবাড়ির নারী কারুশিল্পীদের নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা। তাঁদের মূল আকর্ষণও নকশিকাঁথা ও হাতের কাজ।
এছাড়াও আছে বান্দরবানের থানচি থেকে আগত কুমারী ত্রিপুরার বিডেড গয়না। এটি তাঁর মায়ের কাছ থেকে বংশানুক্রমিকভাবে পাওয়া একটি শিল্প, যা তিনি এখনও চর্চা করে চলেছেন। সুন্দর সব গয়না পাওয়া যাচ্ছে এখানে। এর পাশে আছে টাঙ্গাইলের নিতেশ নকরেকের ঐতিহ্যবাহী পণ্য ও ফুলদানি।
এছাড়াও দেশিয় শিল্পের উদ্যোগ যাত্রার জন্য বরাদ্দ আছে আলাদা জায়গা। তৈরি হয়েছে মঞ্চ। আলপনা আঁকা এই মঞ্চে করা হচ্ছে ডেমো উপস্থাপনা।
লাইভ বডি পেইন্টিং ও রিকশা আর্ট দেখতে ভীড় জমাচ্ছেন এখানে দর্শনার্থীরা। বাকি দিনগুলোতেও থাকছে ফোক পেইন্টিং, লাঠি খেলা, বাঁশির সুরের মতো সুন্দর সব ডেমো পরিবেশনার ব্যবস্থা। ঢাকা মেকার্সের এই আয়োজন চলবে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সঙ্গে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে আছে ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ওয়েবপোর্টাল হাল ফ্যাশন।
ছবি: অনিক মজুমদার