দেশীয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড যাত্রার আয়োজনগুলো বরাবরই বেশ রমরমা। দেশীয় হস্তশিল্প থেকে শুরু করে ফ্যাশন ও লাইফস্টাইলের যাবতীয় পণ্য এক ছাদের নিচে পাওয়া যায় এখানে। আনন্দের বিষয় হলো, যাত্রায় এখন চলছে শারদ মেলা। তিন দিন ধরে চলা এই মেলার শেষ দিন ৫ অক্টোবর।
১৫টি উদ্যোগ যাত্রার নিচতলায় বসেছে তাদের স্টল নিয়ে। ফটক দিয়ে ঢুকে নাক বরাবর তাকালেই দেখা যাবে বেশ উৎসবের আমেজে চলছে মেলা সারাবেলা। যাত্রার জেনারেল ম্যানেজার রাজিবুল হক পিয়াস বলেন, ‘প্রতিটি ঋতুতেই আমরা মেলার আয়োজন করার চেষ্টা করছি। সামার ফেয়ার ও ঈদ মেলার পর সেই ধারাবাহিকতায় এবার শারদ মেলার আয়োজন করেছি। আরও পরিকল্পনা আছে সামনে।’
যাত্রায় তাদের আয়োজিত মেলাগুলো যেন হয় একদম গ্রামবাংলার মেলার মতোই। তাই গ্রামীণ আমেজ রাখতে আর ক্রেতাদের আনন্দ দিতে এই আয়োজনে রাখা হয়েছে গানের আসরও।
হারমোনিয়াম, খোল আর গানের তালে বেশ সুন্দর সময় কাটছে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের। মেলায় ঢোকার শুরুতেই বসেছে ‘বক্স অব অরনামেন্টস’ নামের একটি গয়নার ব্র্যান্ড। তাদের গয়নাগুলো কিছুটা ভিন্ন। হাতে তৈরি মেটাল ও ব্রাশ মেটালের গয়না নিয়ে তাদের কাজ। পার্বত্য অঞ্চলের গয়নাগুলোকে তুলে ধরাই ব্র্যান্ডটির মূল লক্ষ্য। আদিবাসীদের নিজস্ব গয়নাগুলোর ডিজাইন ও মোটিফ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মেটালে তৈরি করা হয়েছে ফিউশনধর্মী দুল ও নেকপিস।
যেমন চাকমাদের পিনন হাদির প্যাটার্ন ফুটে উঠেছে কিছু গয়নায়। ডিজাইনেও আছে পার্বত্য অঞ্চলের ছোঁয়া।
ভেতরে ঢুকলেই দেখা গেল এক পাশে বসেছে ‘নো টিপিক্যাল’ নামের একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড। দুই বছর হলো এই ব্র্যান্ডের। মেলায় তারা নানা ধরনের টি–শার্ট, ডেনিম ও ব্যাগি প্যান্টের মতো ট্রেন্ডি বটম কালেকশন নিয়ে এসেছে।
ওয়েস্টার্ন ও ট্র্যাডিশনাল কালচারকে একসঙ্গে মিলিয়ে ডিজাইনে এনেছে ফিউশন। যেমন টি–শার্টের মধ্যে দেশীয় হাতের কাজ নকশা করা আছে, আবার কিছু টি–শার্টে রাবার প্রিন্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রিকশা আর্ট। সে ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডটি রিকশাশিল্পীর সঙ্গে কোলাব করে এই টি–শার্টগুলো তৈরি করে। এ ছাড়া লালন, মায়ের দোয়া, সাধারণ জনগণ-বিপজ্জনক -সাবধান লেখা কিছু ভিন্নধর্মী টি–শার্টও আছে তাদের কাছে।
অন্যদিকে দুর্গোৎসব উপলক্ষে থিমভিত্তিক পোশাকের সম্ভার সাজিয়েছে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘সরলা’। মহালয়া, মোগল আর্ট, দেবী, ময়ূর, প্রজাপতি, লিলি, টিউলিপ ও গোলাপ ফুটে উঠেছে তাদের শারদ সংগ্রহে।
এর পাশেই আরেক ফ্যাশন ব্র্যান্ড বিনোদিনী বসেছে তাদের সিগনেচার শাড়িগুলোর পসরা সাজিয়ে। বাংলাদেশের হ্যান্ডলুম শাড়িতে বিভিন্ন প্যাটার্ন নিয়ে কাজ করছেন তারা। আর সবচেয়ে বেশি মন কাড়বে শাড়িগুলোর রং। ব্র্যান্ডটির স্বত্বাধিকারী নাইমা জামান জানিয়েছেন, প্যাস্টেল শেড নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন তিনি। তবে পূজার জন্য তাঁরা মেলায় কিছু ভাইব্রেন্ট রঙের শাড়িও রেখেছে। ব্লাউজও আছে মিলিয়ে পরার জন্য। শাড়িগুলো দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া তাঁতের কিছু কুর্তি, টপস, ফতুয়াও আছে।
ব্লাউজ নিয়ে কাজ করছে ‘কিরোকি’। এই স্টলে ঢুঁ মারলে হাতের কাজ থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রিন্টের ট্রেন্ডি কাটিং-এর সব সাইজের ব্লাউজ পেয়ে যাবেন ক্রেতারা।
ব্র্যান্ডটির স্বত্বাধিকারী ফাহমিদা জানান, লিমিটেড এডিশনে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। তাই ক্রেতাদের জন্য ব্লাউজের দুই থেকে তিনটি কপি তৈরি করা হয়। বেশির ভাগ ফেব্রিকই দেশীয় আর মিনিমাল ডিজাইন তাঁর ব্র্যান্ডের মূলমন্ত্র। ১ হাজার ৩৫০ থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে এই ব্লাউজ। কাস্টমাইজ ব্লাউজের অর্ডারও নেয় ব্র্যান্ডটি।
‘কাউন্ট’ নামের একটি স্টল আছে মেলায়। এখানে লুঙ্গি ছাড়াও জামদানি শাড়ির বড় একটি কালেকশন পেয়ে যাবেন শাড়িপ্রেমীরা। এর পাশেই শার্ট, কিমোনো, কুর্তির মতো রঙিন সব পোশাক নিয়ে বসেছে ফ্যাশন ব্র্যান্ড গোড়া।
অন্যদিকে ‘বিমূর্ত’ ব্র্যান্ডে আছে হ্যান্ডলুম, পাওয়ারলুম শাড়ি ও ব্লাউজ। এই মেলায় বিমূর্ত থেকে দুই হাজার টাকার পোশাক কিনলেই পাওয়া যাবে বিশেষ মূল্য ছাড়। তবে ব্র্যান্ডটির মূল আকর্ষণ তাদের গয়না। সব ধরনের গয়নাই আছে তাদের উদ্যোগে। কাঠ পুঁতি, মেটাল ছাড়াও ব্রাশ মেটালের গয়নাগুলো কারিগর দিয়ে যত্ন করে তৈরি করা হয় বলে জানান ব্র্যান্ডটির স্বত্বাধিকারী সোহানা শোভা।
মেলায় ঢুকে একদম শেষের দিকে এসে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড গেরোর স্টলে ঢুকলে যে কারোরই মন ভালো হয়ে যাবে। ছিমছামভাবে সাজানো হয়েছে তাঁদের পণ্যগুলো। কুরুশকাঁটার তৈরি দুল, মালা, ব্রেসলেট আছে এখানে। জার, ওয়াল হ্যাংগিং, ব্যাগের মতো পণ্যগুলো পাওয়া যাবে এখানে।
এর পাশেই আছে পোশাক ও গয়নার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা ব্র্যান্ড ‘অণূভা’স । তাদের কালেকশনে সুতির কুর্তি, ব্লাউজ, আরামদায়ক বটম, সিল্কের স্কার্ফ ছাড়াও আছে রূপার নাকছাবি ও দুলের মতো গয়না।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড হৈম এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার যাত্রার মেলায় অংশ নিয়েছে। তাদের সিগনেচার পণ্য হলো শাড়ি। পূজা কালেকশন নিয়ে ব্র্যান্ডটি তাদের পসরা সাজিয়েছে মেলায়।
ভিন্ন রং ও নকশায় সাজানো শাড়িগুলোর মধ্যে ফেব্রিক হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে সুতি, হাফসিল্ক, জর্জেট ও টিস্যু। প্রাচীন বাংলার লোকশিল্প তুলে ধরা হয়েছে তাদের একটা শাড়িতে। লাল জমিনের শাড়ির পাড়জুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ব্লক করা সাদা আলপনা। এ ছাড়া বেশ কিছু শাড়িতে ফ্লোরাল মোটিফের ব্লক করা আছে। তাদের প্রিমিয়াম কোয়ালিটির টিস্যু শাড়িগুলোও উৎসবধর্মী।
শাড়ি নিয়ে কাজ করে এমন আরেকটি ব্র্যান্ড হলো ‘আর্টেমিস’। সুতি, মসলিন, সিল্ক, অরগাঞ্জা ছাড়াও নানা ধরনের ফেব্রিকের শাড়ি আছে তাদের কালেকশনে। এ ছাড়া কিছু ফ্লোরাল প্রিন্টের অরগাঞ্জা স্কার্ট এনেছে তারা মেলায়। অন্যদিকে যাঁরা হ্যান্ডলুম পণ্য ভালোবাসেন, তাঁরা উঁকি মারতে পারেন ‘পূর্ণাঙ্গীনি’ র স্টলে। হ্যান্ডলুম কটন, সিল্ক, মসলিনের মতো ফেব্রিকগুলো আছে তাদের আয়োজনে। ভেজিটেবল ডাই ও টাইডাই করা পোশাকের মধ্যে শাড়ি, ওড়না, স্কার্ফ, থ্রি–পিসগুলো ব্র্যান্ডটির সিগনেচার পণ্য।
আমুতে পাওয়া যাচ্ছে গয়না থেকে শুরু করে নোটবুক, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস, নানা ডিজাইনের টোটব্যাগ, সানগ্লাস আর ঘর সাজানোর পণ্য।
এই ব্র্যান্ডের সুন্দর দিক হলো, তারা অনেকজন উদ্যোক্তার পণ্য নিয়ে কাজ করে। অনেক উদ্যোক্তাই শোরুম নিয়ে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না কিংবা শুধু অনলাইনে পেজ আছে; তাঁদের জন্যই আমু এই উদ্যোগ নিয়েছে।
এ ছাড়া যাঁরা ঘর সাজাতে বেশ ভালোবাসেন, তাঁরা ‘ক্রিয়েটিভ জুট’-এর স্টলে একবার যেতে পারেন। আর প্যাচওয়ার্ক, গামছার পোশাক নিয়ে বসেছে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘অর্ঘ্য’। পাওয়া যাচ্ছে পাট, ফেব্রিক, কড়ি, পমপমের মতো নানা ধরনের উপাদানে হাতে তৈরি গয়নাও।
সব মিলিয়ে যাত্রার উদ্যোগে এই মেলা সত্যিই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে একধরনের যোগসূত্র স্থাপন করেছে। বৃষ্টির দিনটি উপভোগ করতে একবার চাইলে মেলার শেষ দিনে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন, মন্দ লাগবে না। দেশীয় পণ্য কেনার পাশাপাশি গানবাজনা উপভোগ করা আর পরিচিত মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হতে পারে এখানে। আজই চলে যান বনানী ই ব্লকের ৬৩ নম্বর বাড়িতে। মেলা চলবে আজ রাত ১১টা পর্যন্ত।
ছবি: অনিক মজুমদার