
ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রিন্টমেকিং বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিল্পী প্রফেসর সৈয়দ আবুল বার্ক্ আলভী, প্রখ্যাত শিল্পী ও সাবেক প্রধান ডিজাইনার (বাংলাদেশ টেলিভিশন) আবদুল মান্নান এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টমেকিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. রশিদ আমিন। এ ছাড়া ছিলেন অনেক আমন্ত্রিত অতিথি, তাঁরা সবাই এই জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পকর্মগুলো উপভোগ করেন।

কানাডায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে পা রাখেন শিল্পী জিসান হক। তিনি জানান, প্রায় ৪৫ বছর ধরে কানাডায় বসবাস করছেন। কিশোর বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য মন্ট্রিয়লের চিলড্রেনস হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর জীবনের বাঁক বদলায়। সেই শহরেই তিনি খুঁজে পান জীবনের স্বাধীনতা, নিজের মতো করে বাঁচার শক্তি ও আত্মবিশ্বাস। প্রদর্শনীর শিল্পকর্মে উঠে এসেছে সেই লড়াই, একাকিত্ব, ভালোবাসা পাওয়া এবং নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের গল্প।

জিসান হক বলেন, ‘একটু ভালো কথা, একটু আদর—এই ছোট ছোট বিষয়ই মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। আমি নিজে তা শিখেছি।’
তাঁর বাবা আবু জাফর জিয়াউল হক ছিলেন একজন শিল্পী। শৈশবে বাবার আঁকা দেখেই জিসানের মনে শিল্পের প্রতি গভীর টান জন্মায়। একসময় নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতে পার্কে বসে স্কেচ করা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে সেই অভ্যাসই রূপ নেয় শিল্পী হয়ে ওঠার যাত্রায়।
শিক্ষাজীবন প্রসঙ্গে জিসান হক জানান, তিনি মূলত শেফ হতে চেয়েছিলেন এবং সে লক্ষ্যেই পড়াশোনা করেন। শুরুতে ফ্যাশন ডিজাইন পড়ার ইচ্ছা থাকলেও ব্যয় বেশি হওয়ায় সে পথ থেকে সরে আসতে হয়। পরবর্তী সময়ে কানাডিয়ান সরকারের সহায়তায় ফ্রেঞ্চ কুইজিন কুকিং কোর্সে তিন বছর মেয়াদি স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতালিয়ান ফিউশন কুইজিন রেস্তোরাঁ ‘কাইয়োটি’-তে হেড শেফ হিসেবে কাজ করেন। সেখানে কাজের ফাঁকে ছবি আঁকতেন তিনি। সেই আঁকাগুলো দেখে এক গ্যালারির স্বত্বাধিকারী তাঁকে প্রদর্শনীর প্রস্তাব দেন। এভাবেই ১৯৮৭ সালে তাঁর শিল্পীজীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।

শিল্পীর পরিবারও প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে এই প্রদর্শনীতে অংশ নেয়। জিসান হকের স্বামী রিচার্ড পিজন এবং তিন ছেলে কাইল, জোশুয়া ও লুকাস প্রথমবার বাংলাদেশে এসে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। বড় ছেলে কাইল বলেন, এই শিল্পকর্মগুলো শুধু কানাডার জীবন নয়, বাংলাদেশের শিকড় এবং অন্যান্য দেশের প্রভাবও একসঙ্গে তুলে ধরে। তাই ‘ইনভেনশন অব লাইফ’ নামটি একেবারেই যথার্থ।’

মা ভালো রাঁধুনী নাকি ভালো শিল্পী—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তিনি দুটোতেই অসাধারণ। তিনি আমাদের শুধু শিল্পকলা শেখাননি, শিখিয়েছেন কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন যাপন করতে হয়। আমরা মন্ট্রিয়লের উত্তরের বিস্তৃত প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়েছি, যেখানে প্রকৃতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। সেই দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটাতে কাটাতেই তিনি আমাদের শিল্প, রান্না এবং মানুষের সঙ্গে হৃদয় খুলে মিশে থাকার মূল্যবোধ শিখিয়েছেন।’

তরুণ শিল্পীদের উদ্দেশে জিসান হকের পরামর্শ, ‘অন্যের কাজ অনুকরণ করবেন না। নিজের মতো করে কাজ করুন, যেটা ভালোবাসেন, সেটাই আঁকুন। ধৈর্য ধরে এগোলে একদিন নিজেই আরও ভালো শিল্পী হয়ে উঠবেন।’
ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে অনুভূতি ও আত্মার ভাষা নির্মাণ করা এই প্রদর্শনী দর্শকদের কাছে ছিল কেবল দেখার নয়, বরং অনুভব করার এক গভীর শিল্প-অভিজ্ঞতা।