রাজধানীর গুলশান–তেজগাঁও লিংক রোডের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে সম্প্রতি বসেছিল আর্কা ফ্যাশন উইকের সামার আসর। ফ্যাশনপ্রেমী ও ফ্যাশনিস্তাদের জমজমাট এই আয়োজনে ছিল মার্কেটপ্লেস, ডিজাইন ল্যাব, ফুডকোর্ট, সেমিনার আর ফ্যাশন শো। তবে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে টাঙ্গাইল তাঁত নিয়ে প্রদর্শনী।
‘টাঙ্গাইল বয়নকাব্য’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে প্রতিদিনই ছিল আগ্রহী মানুষের ভিড় । সাতজন প্রতিভাবান শিল্পী এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন।
টাঙ্গাইলের তাঁতিদের গল্প আর ইতিহাস নিয়ে সাজানো এই প্রদর্শনীর কিউরেটর ছিলেন শিল্পী জুয়েল এ রব।
প্রদর্শনীটি শুরুর আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে শিল্পী জুয়েল জানান, ‘আমরা সব শিল্পীকে নিয়ে প্রথমে টাঙ্গাইলে তাঁতিদের কাছে যাই। সেখানকার তাঁতিদের কারখানায় গিয়ে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিই। সেই সঙ্গে তাঁত কমিটির প্রধানদের সঙ্গেও কথা বলি। অবস্থাসম্পন্ন তাঁত ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অন্যান্য তাঁতির সঙ্গেও আমরা আলাপ করি। টাঙ্গাইল শাড়ি কীভাবে এলো, পূর্বপুরুষেরা কীভাবে এই তাঁত তৈরি করতেন, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বা দেশভাগ পরবর্তী সময়ে তাঁদের অভাব, তাঁরা কেন চলে গেলেন, কী ধরনের সমস্যায় তাঁদের পড়তে হয়েছে—এমন সব গল্প এই প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে নানা মাধ্যমে ।’
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে বুননের শৈল্পিকতায় পরিপূর্ণ একটি গ্রাম। বংশপরম্পরায়, বসাক সম্প্রদায় টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তাদের মধ্যে মহাদেব বসাক নৈশোদা গ্রামের প্রাচীনতম তাঁতি।
৯ বছর বয়সে মহাদেব তাঁর বাবাকে হারানোর পরে, কাকার সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন। নিষ্ঠা এবং দক্ষতার সঙ্গে তিনি সাত দশকের বেশি সময় ধরে অগণিত শাড়ির কাপড় বুনেছেন। এই প্রক্রিয়াও ফ্রেমবন্দি করে তুলে ধরা হয়েছে প্রদর্শনীতে।
জুয়েল এ রব জানান, ‘১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বসাক পরিবারের অনেক তাঁতি চলে গেছেন টাঙ্গাইল অঞ্চল ছেড়ে । কাজ ও খাবারের অভাব, ব্যবসার নিরাপত্তার অভাব, পরিবহন–সংকট , সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাজনৈতিক কারণ আর কাজের অবমূল্যায়নের জন্য তারা অনেকেই ভারতে চলে যান। সব গল্পই প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।
এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে টাঙ্গাইল তাঁতের আদি, বর্তমান আর ভবিষ্যতের অবস্থা। সেই সঙ্গে শিল্পীরা এই শিল্পকে কীভাবে দেখতে চায় এবং ভবিষ্যতে এই টেক্সটাইল থেকে কিছু করা যায় কি না, সেটিও উঠে এসেছে ।
মূলত, তাঁতিদের জীবনের প্রতিটি জায়গা, বুননের পরতে পরতে যত গল্প লুকানো থাকে, সেটির ভিজ্যুয়াল রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে এই প্রদর্শনীতে।
পেইন্টিং থেকে শুরু করে রিসার্চ পেপার, টাঙ্গাইল তাঁতের মোটিফ, ফটোগ্রাফির মতো মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে পুরো বিষয়টি।
টাঙ্গাইলের তাঁতের কাপড় বা পাড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে খনার বচনের কালজয়ী কথাগুলো, প্যাচওয়ার্ক আর্ট ব্যবহার করে টাঙ্গাইল শাড়ি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্যাটার্ন আর তাঁত বোনার শব্দ নিয়ে করা হয়েছে পিকজারাইজেশন।
সব মিলিয়ে এই প্রদর্শনীতে সবার আগ্রহ ছিল দেখার মতো।
ছবি: অনিক মজুমদার