পৌষের আগমনী বার্তা নিয়ে গুলশান লেক পার্কে পৌষ উৎসব
শেয়ার করুন
ফলো করুন

গুলশান সোসাইটি ও ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি)-এর যৌথ আয়োজনে ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সৌজন্যে গুলশান সোসাইটি পার্কে লোকজ আমেজে দেশীয় ফ্যাশনে উদযাপিত হয়ে গেলো ‘পৌষ উৎসব’। বাংলা সংস্কৃতি ও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে নগর জীবনে নতুনভাবে উপস্থাপন করাই ছিল এই উৎসবের মূল লক্ষ্য। সকালে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় উদ্বোধনী নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।

এরপর তামান্না রহমানের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) নির্দেশনায় লোকনৃত্য, ডলি মন্ডলের পরিবেশনায় বাউল সংগীতসহ সারাদিন জুড়ে চলেছে নৃত্য ও সংগীতের বৈচিত্র্যময় আয়োজন। উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ ছিল দুই পর্বে আয়োজিত দেশীয় বয়নশিল্পভিত্তিক ফ্যাশন শো।

বিজ্ঞাপন

বিকেল তিনটায় দেশীয় ডিজাইনারদের পোশাক প্রদর্শনীর মাধ্যমে শুরু হয় প্রথম পর্ব।
দ্বিতীয় পর্বে এফডিসিবির ডিজাইনারদের অংশগ্রহণে দ্বিতীয় পর্বের ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট ১৮ জন ফ্যাশন ডিজাইনারের নকশার শাড়ি প্রদর্শিত হয়, যেখানে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের নান্দনিক রূপ।
ফ্যাশন শোর প্রথম পর্বে অংশ নেন আফরিন ইলা—দ্য জামদানি, নকশা মিস্ত্রী বাই শ্রাবণী, মসলিন সানজিদা হক, ফারহান এ আহসান—টাঙ্গাইল, সিল্ক হ্যান্ড প্রিন্ট বাই নিঝু, সীবনী বাই আবেদা খাতুন মিতুল, সিমিলী রহমান—মসলিন, মুনমুন—জামদানি এবং ফারজানা রিপা—নকশীকাঁথা ও প্রাকৃতিক ডাই।

দ্বিতীয় পর্বে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের ৯ জন ডিজাইনার অংশ নেন। তাঁরা হলেন লিপি খন্দকার, শৈবাল সাহা, মাহিন খান, ইমাম হাসান, ফাইজা আহমেদ, শাহরুখ আমিন, রোকসানা, সাদিয়া রুপা ও রিমা নাজ।ফ্যাশন শোয়ের কোরিওগ্রাফার হিসেবে ছিলেন ইমরান আলী সিকদার। প্রদর্শিত প্রতিটি নকশায় ফুটে ওঠে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের বৈচিত্র্য। টাই-ডাই, খাদি, জামদানি, মসলিন, রেশম, নকশীকাঁথা, কারচুপি, টাঙ্গাইল হ্যান্ড পেইন্ট, প্রাকৃতিক ডাই ও রাজশাহী সিল্ক—এসব উপকরণ ও কৌশলের সৃজনশীল প্রয়োগ দেখা যায় ডিজাইনারদের পোশাকে। এবারের আয়োজনে কেবল শাড়ির নকশাই উপস্থাপন করেন ডিজাইনাররা।

বিজ্ঞাপন

ডিজাইনার ইমাম হাসান বলেন, দেশীয় ট্র্যাডিশনাল ডিজাইনাররা স্বতন্ত্রভাবে দেশীয় বয়নকে শাড়িতে তুলে ধরেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি খাদি নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর ভাষায়, খাদির ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। ‘হোপ ফর টুমরো’ থিমে গোধূলি ও সূর্যাস্তের গোল্ডেন আওয়ারের রঙকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে এই নকশাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ডিজাইনার আবেদা খাতুন মিতুল বলেন, তিনি দেশীয় বয়নে কৃষ্ণচূড়ার নকশা নিয়ে কাজ করেছেন। ভারতীয় ও পাকিস্তানি কাপড়ের ওপর নির্ভরতা কমাতে দেশীয় বয়নে ফিউশন অপরিহার্য বলে তিনি মনে করেন।

নকশা মিস্ত্রীর ডিজাইনার শ্রাবণী বলেন, আজকের ফ্যাশন শোতে তিনি শিবোরি ও নকশীকাঁথা নিয়ে কাজ করেছেন। স্লো ফ্যাশনের ধারণা থেকে নকশীকাঁথাকে নতুনভাবে তুলে ধরাই তাঁর উদ্দেশ্য। হারিয়ে যেতে বসা নকশীকাঁথাকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে ফিরিয়ে আনতে তিনি ডেনিমের ওপর নকশীকাঁথার কাজ করেছেন। পুরোনো টেক্সটাইল ও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সঙ্গে ফিউশন করলে মানুষ নতুন করে আগ্রহী হবে বলেও তিনি জানান। ডিজাইনার শাহরুখ আমিন বলেন, সবুজের আবহে এবারের ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে। বিজয়ের মাসে লাল-সবুজ সবসময়ই আবেগ জাগায়। তাঁর মতে, আজকের আয়োজনে পিঠাপুলির আয়োজন, দেশীয় ক্রাফট, চায়ের আড্ডা, গান এবং দেশীয় তাঁতের ফ্যাশন শো—সব মিলিয়ে এটি ছিল প্রকৃত বাঙালিয়ানার উদযাপন।

ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও স্টুডিও মায়াসিরের স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার মাহিন খান বলেন, ‘পৌষ উৎসব নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা অনেক দিনের। পৌষ মানেই বাংলার উৎসবমুখর সময়। গ্রামগঞ্জে এই সময় নানা আয়োজন ও মেলা বসে। সেই আবহ শহরে ফিরিয়ে আনতেই এই আয়োজন। কারুশিল্প ও বয়নশিল্পের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও রেখেছি, যেন উৎসবটি পরিপূর্ণ হয়।’বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকজ ও গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক নগর সংস্কৃতির একটি সুন্দর সেতুবন্ধন তৈরিই আজকের এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য।

পৌষ উৎসব আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলার সংস্কৃতি চর্চা ও সাংস্কৃতিক চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে ১৮৪৩ সালের ২১ ডিসেম্বর, বাংলা পৌষ মাসের ৭ তারিখে এই উৎসবের সূচনা হয়। লোকনৃত্য, সংগীত, শিল্প ও সংস্কৃতির সম্মিলনে পৌষমেলার বিস্তার ঘটান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনের সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা বাউল সংগীত, লোকগীতি, লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত এবং মণিপুরী নৃত্যের পরিবেশনা উপভোগ করছি।

ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের জেনারেল সেক্রেটারি  শৈবাল সাহা বলেন, ‘নতুন ধান কাটার পর গ্রামবাংলায় যে পিঠাপুলির উৎসব হয়, শহরের যান্ত্রিক জীবনে সেই আমেজ আমরা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি।

গ্রামবাংলার সেই উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতেই আমাদের এই উদ্যোগ।’বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের কারুশিল্প ও লোকজ নকশা নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই কারুশিল্পের অগ্রগতি, লোকজ সংস্কৃতির প্রচার, প্রসার, সংরক্ষণ ও পুনর্জাগরণের জন্য সাংস্কৃতিক চেতনা জাগ্রত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

উৎসবের স্টলগুলোতে ছিল দেশের নানা প্রান্তের লোকজ ঐতিহ্য ও কারুশিল্পের সমাহার। পাট ও কাঁসা-পিতলের সামগ্রী, সোনারগাঁয়ের কাঠের পুতুল, জামদানি ও হাতপাখা, সিরাজগঞ্জের তাঁত, টাঙ্গাইলের শাড়িসহ বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে।

সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে হাতে বোনা শীতলপাটি এবং রাজশাহী থেকে শখের হাঁড়ি নিয়ে অংশ নেন কারুশিল্পীরা। গ্রামবাংলার শীতকালীন উৎসব মানেই পিঠাপুলি সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে উৎসবে ছিল দুধ চিতই, নকশি পিঠাসহ নানা ধরনের পিঠার আয়োজন। পাশাপাশি ঝাল মাংস, বিভিন্ন স্বাদের চা ও শীতকালীন মুখরোচক খাবারও পরিবেশন করা হয়।

গুলশান সোসাইটির কালচারাল সেক্রেটারি শ্রাবন্তী দত্ত পরিশেষে পরিশেষে শিল্পীবৃন্দ, ড. তামান্না রহমান, শর্মিলা ব্যানার্জি, ডলি মণ্ডল, শঙ্করজি, স্যামুয়েল পুলক, লাবিক কামাল গৌরবসহ সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

এরপর তামান্না রহমানের নির্দেশনায় মণিপুরী নৃত্য আলেখ্য এবং লাবিক কামাল গৌরব ও তার দলের পরিবেশনায় লালনগীতি পরিবেশিত হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া এই উৎসব চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সৌজন্যে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের সহযোগিতায় ছিল রাঁধুনী, বার্জার ও বাটা। সারাদিন ধরে বিভিন্ন জেলার কারুশিল্পী ও মাস্টার আর্টিজানদের অংশগ্রহণে গুলশান লেক পার্ক পরিণত হয় এক প্রাণবন্ত গ্রামীণ উৎসবমেলায়।

ছবি: হাল ফ্যাশন

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬: ১০
বিজ্ঞাপন