ডেনিম,খাদি, সিল্ক, কটনসহ নানা কাপড়ে অভিনব সব নকশার পোশাক ছিল প্রশংসনীয়। প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যাপক নাদিয়া তাসনিম প্রিয়া জানান, এটি আসলে প্রতিবছরে পঞ্চম সেমিস্টারের ‘কালেকশন ডেভেলপমেন্ট’ কোর্স। ছাত্রদের নিজের মতো করে কাজ করার সুবিধা থাকে। ম্যাটেরিয়াল সোর্সিং থেকে প্রোডাকশনের কস্ট শিট তৈরি, কস্ট প্রাইস নির্ধারণ মায় ফাইনাল প্রোডাকশন—সবই হাতে–কলমে করতে হয়।
থিম বা ইন্সপিরেশন নির্ভর কালেকশনে তারা ঠিক করে নেয় কোন ধরনের কাপড়ে কাজ করবে এবং কী ধরনের পোশাক ওরা তৈরি করবে। প্রত্যেককে ছয়টি করে পোশাক উপস্থাপন করতে হয়। পরের দুটি সেমিস্টারের একটিতে ম্যাস প্রোডাকশনের জন্য ডিজাইন করতে হয় এবং অন্যটিতে পুরোপুরি হেরিটেজ নিয়ে কাজ করতে হয়।
প্রদর্শনী শুরু হয় দুপুর ১২টায়। বিএফএস ২২১ ব্যাচের ৩৪ জন শিক্ষার্থী তাঁদের স্বতন্ত্র নকশায় পোশাক প্রদর্শন করেন। প্রাথমিক নির্বাচনে ৯-১০টি নকশা উপস্থাপন করে সেখান থেকে প্রত্যেকের ছয়টি করে পোশাক প্রদর্শনীতে স্থান পায়। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে মুড বোর্ড সাজিয়েছেন, যার মধ্যে অভিনবত্ব ছিল লক্ষণীয়। প্রতিটি পোশাক তৈরির আগে তাদের ভাবনা ও উপকরণ নিয়ে গবেষণা করতে হয়েছে। পোশাকের কাপড়, নকশা–উপকরণ ইত্যাদি সবকিছুই রিসার্চ বুকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হয়।
শিক্ষার্থীদের পোশাকে আপসাইক্লিং, রিসাইক্লিং যেমন দেখা গেছে, তেমনি পরিবেশসচেতনতার বার্তাও নজরে এসেছে। দেশি হেরিটেজ মোটিফ নিয়ে কাজ করেছেন দুজন শিক্ষার্থী। শাড়িতে বয়নশিল্পীদের জীবন হ্যান্ডপেইন্ট করা হয়েছে। অন্যদিকে টেরাকোটা মোটিফকে নানাভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একাধিক মাধ্যমে। সাদা, লাল ও বাদামি রঙের ব্যবহার চোখে পড়েছে। ঐতিহাসিক মনুমেন্টকে কেন্দ্র করে থিমেটিক পোশাক সংগ্রহে দেখা যায় নুড রঙের ব্যবহার। রোমান কলোসিয়ামকে থিম করে একটি পোশাক ছিল দৃষ্টিনন্দন। ময়ূর, গোলাপ, সমুদ্র, মডেস্ট মুসলিম এমন সব থিমে পোশাকে দেখা যায় এথনিক, ওয়েস্টার্ন ও ফিউশন।
মেহজাবিন আক্তার ঝুমুর পোশাকে টেরাকোটা মোটিফকে তুলে ধরেছেন। অ্যাপ্লিকে, হান্ডস্টিচ ও এমব্রয়ডারিতে ভ্যালু অ্যাড করা হয়েছে।
কথা আহমেদ কাজ করছেন বর্ণিল সব পোকার মোটিফে। তাঁর ‘মুড বুকে’ দেখা যায় একটি পোশাক তিনভাবে পরা যাবে। কথার কাকেলশনের পোশাক পিকে ফেব্রিকে ডিজিটাল প্রিন্টের ওপর এমব্রয়ডারি করে তাতে বাটন ও বিডস ব্যবহার করা হয়েছে। কোনোটায় বিডসের ওপর গ্লু দিয়ে নকশা করা, আবার কোনোটায় কারচুপি করা।
ডিপ্রেশন ও মেন্টাল হেলথ থিমে সাদা ও কালোর সমন্বয়ে ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের পোশাক তৈরি করেছেন নাজনিন নিপা।
মাহরিন সুপ্তির প্রেরণা হয়েছে ফ্যাশন আইকন ‘প্রিন্সেস ডায়না’, যিনি ফর্মাল ওয়্যার পরতেন যা তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ, সে কারণেই তাঁকে নিয়ে কাজ করা, স্যাটিন, পলিয়েস্টার আর কটনের মিশেলে সাবলিমেশন প্রিন্টে ভ্যালু অ্যাড করেছেন। দুটো স্কার্টে আই লিড ব্যবহার করা হয়েছে; যেটা ওয়েস্টার্ন ফ্যাশনে ব্যবহার করা হয়, যা বাংলাদেশে অতটা প্রচলিত নয়।
ইরহানা জাহিন রিহা ফ্যাশনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে উৎসাহী হয়েছেন। তিনি মেয়েদের পিরিয়ডকালীন আরাম ও স্বস্তিদায়ক পোশাক নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে সময়টায় আমরা চাই একটু স্বস্তিদায়ক পোশাক পরতে। পোশাকে পিলো ফিল দেবার জন্য বেল্ট ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে ওয়াশেবল ডায়াপার ব্যবহার করা হয়েছে যা চাইলে ধোয়া যাবে, ডেনিম ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাটেরিয়াল হিসাব যা খুব আরামদায়ক আর নরম, মূলত পিরিয়ডের সময়ের মুড সুইংকে এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ডেনিমের সাদা ও নীল রঙের মাধ্যমে। দেখা যায় মেয়েদের জন্য যে প্যান্ট রয়েছে, সেগুলোর পকেট ছোট হয়, তাই বড় পকেট দিয়েছি যাতে আরাম হয়, কিছু পকেটে রাখা যায়। ডায়াপারের সঙ্গে মাইক্রোওয়েভ রিইউজেবল হটব্যাগ আছে, যা ওভেনে দিলেই গরম হয়ে যাবে, যেকোনো জায়গায় বহন করা যাবে। পিরিয়ডের সময় আরামদায়ক অনুভূতি দেবে।’
নওশিন নিয়াজ কাজ করেছেন ফাস্ট ফ্যাশনের ইমপ্যাক্ট নিয়ে, তিনি মায়ের শাড়ি রিসাইকেল করে স্লো ফ্যাশনকে তুলে ধরেছেন। খাদি ফেব্রিক, মিক্স ফেব্রিকের ওপরে মায়ের পুরোনো টাঙ্গাইল শাড়ি প্যাচওয়ার্ক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মুড বুকে দেখা গেল ‘দ্য সাসটেইনেবল টুমরো’ শিরোনাম।
চেতনা ভদ্র কাজ করেছেন পরিবেশের ওপর মানুষের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে। বানরের ওপর ল্যাব টেস্ট, পাখির বাসার ডিম ভাঙা, গাছ কাটা, পাখির পালক তুলে নেওয়া, বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রীর জন্য প্রাণীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা এসব থিমকে প্রতিবাদের ভাষায় পোশাক তৈরি করেছেন তিনি।
সারিয়া আক্তার অরণী কাজ করেছেন তাঁতিদের জীবনযাত্রা নিয়ে। খাদি কাপড় ব্যবহার করছেন পোশাক ও শাড়িতে দেশীয় মোটিফে। নকশিকাঁথা ও বিডসের কাজ চোখে পড়ে। তাঁতিদের সাসটেইনেবল ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মেলাতে আধুনিকতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়কেই তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নবীন ডিজাইনারদের এই পোশাক আসলেই অনুপ্রেরণাদায়ক। আশা করা যায়, আগামী সেমিস্টারগুলো যত অতিবাহিত হবে, ডিজাইনার হিসেবে এই নবীনদের দক্ষতা আরও শাণিত হবে।
ছবি: লেখক