দ্রুত শিল্পায়ন আর জলবায়ু পরিবর্তনের চাপে বদলে যেতে থাকা উপকূলীয় জনপদ মাতারবাড়ী। কক্সবাজারের এই দ্বীপাঞ্চলের মানুষের জীবন, স্মৃতি, শিকড়, ভূমি উচ্ছেদ আর ভবিষ্যতের মানচিত্রকে কেন্দ্র করেই সম্প্রতি আয়োজন করা হয়েছে ব্যতিক্রমী ভিজ্যুয়াল আর্টস প্রদর্শনী ‘Matarbari Tales–Home Is Where The Heart Is’। বয়ন, চলচ্চিত্র ও লেখার মাধ্যমে মাতারবাড়ীর মানুষের জীবিত অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।

এই প্রদর্শনী তুলে ধরছে মাতারবাড়ীর মানুষের নিজের ভাষায় বলা গল্প। এই বহুমাত্রিক এই আয়োজনে ছিল বই প্রকাশ, গবেষণা পর্যালোচনা এবং কমিউনিটিনির্ভর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী।
ব্যতিক্রমী এই ভিজ্যুয়াল আর্টস প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছে দুটি ভিন্ন স্থানে—কক্সবাজারের মাতারবাড়ী হাইস্কুল এবং ঢাকার দ্বীপ গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর কিউরেটর ছিলেন মাহেনাজ চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশ থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ক্লাইমেট ফিউচারস: সাউথ এশিয়া কর্মসূচির গ্র্যান্টপ্রাপ্ত একজন গবেষক ও কিউরেটর হিসেবে সুযোগ পেয়েছেন।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের ক্লাইমেট ফিউচারস একটি আন্তর্জাতিক কর্মসূচি, যার লক্ষ্য সৃজনশীল শিল্প ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি ও কার্যকর উদ্যোগকে সহায়তা করা। এই কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে অনুদান দেওয়া হয়।

সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, মাহেনাজ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এই প্রদর্শনী গড়ে উঠেছে একটি কমিউনিটিনির্ভর শিল্প প্রকল্প হিসেবে, যেখানে স্থানীয় অভিজ্ঞতা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু সচেতনতার ভাবনা একত্র হয়েছে।
প্রদর্শনীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল মাতারবাড়ীর একটি বিশাল টেক্সটাইল আর্ট ম্যাপ, যা ছয়জন স্থানীয় নারীর সুনিপুণ হাতে তৈরি নকশি সেলাইয়ের মাধ্যমে নির্মিত।


এই ম্যাপের মাধ্যমে তাঁদের ছোটবেলার স্মৃতি, মাতারবাড়ীর ভূগোল এবং সেখানে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের ছাপ সেলাইয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মাতারবাড়ীর পুরোনো ও নতুন নানা গল্পও ছবির মাধ্যমে প্রদর্শনীর অংশ ছিল।
এ ছাড়া মাতারবাড়ীর কমিউনিটির শিক্ষার্থীরা তৈরি দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
শিক্ষার্থীরা এপলবক্স ফিল্মের সহযোগিতায় একাধিক কর্মশালায় অংশ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও লেখালেখির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এই অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছে এই দুই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।

একই সময়েই এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে ছোটগল্প সংকলন ‘Matarbari Tales’, যা মাতারবাড়ী হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের লেখা। বইটিতে তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা, হারানো ভূমি, স্মৃতি এবং স্বপ্নকে সরাসরি নিজের ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রদর্শনীর কিউরেটর ও ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার মাহেনাজ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের গ্র্যান্টপ্রাপ্ত একজন হিসেবে আমার লক্ষ্য ছিল দ্রুত শিল্পায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিত অভিজ্ঞতাকে শিল্প, গল্প ও যৌথ স্মৃতির মাধ্যমে তুলে ধরা।

এই প্রদর্শনী প্রমাণ করে—প্রতিটি বলা গল্প, প্রতিটি সেলাইয়ের ফোঁড় আসলে একধরনের প্রতিরোধ এবং মাতারবাড়ীর ভবিষ্যৎ মানচিত্র তৈরির এক জরুরি ধাপ।’ ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর মারইয়া রহমান বলেন, ‘ভিজ্যুয়াল আর্ট জলবায়ু সংকটকে গভীরভাবে বোঝার এক অনন্য মাধ্যম। এই প্রদর্শনী কেবল একটি শিল্প আয়োজন নয়, এটি মাতারবাড়ীর মানুষের স্মৃতি, ক্ষতি, সংগ্রাম ও আশার একটি জীবন্ত দলিল।’