বাঙালির নববর্ষ মানেই শুধু ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়া নয়, এটি আত্মপরিচয়ের এক বর্ণময় প্রকাশ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রবাসী বাঙালিরা আয়োজন করে থাকেন বৈশাখের উৎসব। বাংলাদেশ থেকে সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে, ক্যালিফোর্নিয়ার ফলসামে প্রতিবছরের মতো এবারও আয়োজিত হয়েছে বৈশাখী মেলা। আয়োজক গ্রেটার স্যাক্রামেন্টোর বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক সংগঠন আনন্দমেলা। ২০০৮ সাল থেকে ‘আসুন আনন্দ ছড়াই’ স্লোগানে তারা করে আসছে এই আয়োজন।
‘এসো এসো প্রাণের উৎসবে’, এই রবীন্দ্রবাণীতে অনুপ্রাণিত আয়োজনজুড়ে ছিল দেশপ্রেম, নারী জাগরণ, তারুণ্যের সৃজনশীলতা আর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
আনন্দমেলার বর্ষবরণ পর্ব শুরু হয় ‘এসো হে বৈশাখ’ গানে। এরপরই শ্রদ্ধা নিবেদন চলে ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ পরিবেশনার মাধ্যমে। নজরুলের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ এবং নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ পাঠে উঠে আসে সমসাময়িক বিপ্লবের চেতনা।
২০২৫ সালের মার্চে বাংলাদেশের শিশু আছিয়ার মৃত্যু এবং নারী অধিকার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশিত হয় ‘জাগো নারী জাগো’ কবিতা ও নৃত্যের যুগলবন্দী। ‘নারীর স্বীকারোক্তি’ এবং নৃত্যনাট্য ‘জাগো নারী বহ্নিশিখা’ ছিল নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার উচ্চারণ।
বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হয়ে উঠছে প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম। শতাধিক শিশু-কিশোর দেশীয় পোশাকে, পতাকা আর প্ল্যাকার্ড হাতে অংশ নেয় বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায়। আনন্দমেলার কর্ণধার নাজমুস সাকিব, ফলসাম শহরের মাননীয় মেয়র সারা অ্যাকুইনোসহ অনেকেই শিশু-কিশোরদের সঙ্গে যোগ দেন।
মঞ্চে পরিবেশিত হয় ‘আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ ও ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ গানে নৃত্য। বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘ঝুন ঝুন ময়না’ পুতুলনাচ, যেখানে ছয় শিশুশিল্পী অংশ নেয় ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের ভঙ্গিতে। এ ছাড়া ছিল ‘চলো সবাই জীবনের আহ্বানে’ এবং ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’ গানের সঙ্গে শিশু-কিশোরেরা নৃত্য পরিবেশনা করে। শিশুদের জন্য কুইজ প্রতিযোগিতা এবং উন্মুক্ত পারফরম্যান্স ‘যেমন খুশি তেমন সাজোর’ আয়োজনে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
এ বছর আনন্দমেলার মঞ্চে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি কালজয়ী সাহিত্য–চরিত্র মঞ্চে উঠে আসে: চারুলতা-ভূপতি (নষ্ট নীড়), নন্দিনী-রঞ্জন (রক্তকরবী) ও অমিত-লাবণ্য (শেষের কবিতা)। স্থানীয় শিল্পীদের অভিনয়, গান ও কবিতার সংমিশ্রণে উপস্থাপনাটি দর্শকেরা দারুণভাবে উপভোগ করেন।
সংগীতায়োজনে ছিল লোকজ ও আধুনিকতার মেলবন্ধন। একদিকে ছিল রবীন্দ্রসংগীত, শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজার গান; অন্যদিকে ছিল জেমস, ফিডব্যাক, লোপামুদ্রা ও সমসাময়িক ফোক-রক পরিবেশনা। কোক স্টুডিও বাংলার ‘সন্ধ্যাতারা’ ও ‘দেওরা’ গানের সঙ্গে নাচ ও তরুণীদের ‘রিলস’ স্টাইলে সমবেত পরিবেশনা দর্শক মাতিয়ে তোলে।
প্রতিবারের মতো এবারও ছিল ২৫টির বেশি স্টল। যেখানে ছিল দেশীয় পোশাক, হাওয়াই মিঠাই, গয়না, খাবার আর বাংলা বই। হলসজ্জা, আলোকসজ্জা, ফটোবুথ ও পরিবারমুখী আয়োজন—সব মিলিয়ে ভেনু রূপা নিয়েছিল এক টুকরো বাংলাদেশে।
সফল এই আয়োজনে ছিলেন একঝাঁক তরুণ সংগঠক, অভিজ্ঞ উপদেষ্টা ও নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবক। তাঁদের সমবেত প্রয়াস ও ভালোবাসাই এই আয়োজনকে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা।
আনন্দমেলা শুধুই একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসরত বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের প্ল্যাটফর্ম। আগামী বছর ১৪৩৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখকে কেন্দ্র করে আবারও ঐতিহ্যের উদ্যাপন হবে বলে আগেভাগেই আনন্দমেলা পরিবারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ছবি: আনন্দমেলা পরিবার