
আলোচনা সভায় মূল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন ফ্যাশন উদ্দ্যোগ–এর প্রতিষ্ঠাতা, ফ্যাশন ডিজাইনার ও সাসটেইনেবিলিটি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট গবেষক ও দেশি ব্র্যান্ড সাদাকালোর সহপ্রতিষ্ঠাতা তাসনিম শাহিন। তিনি তাঁর আলোচনায় বাংলাদেশের ফ্যাশন শিল্পে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার, নৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়া, শ্রমিক কল্যাণ এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ব্যবসা মডেলের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সেই সঙ্গে কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ক গবেষণা পত্রের উপাত্ত তুলে ধরেন।

আলোচনার প্রারম্ভে কে ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী খালিদ মাহমুদ খান বলেন, সাসটেইনেবিলিটি নিয়ে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচন করে থাকি কিন্তু ফলপ্রসূ কিছুর জন্য আরও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সেকারনেই আজকের আলোচনা যেখানে সাসটেইনেবিলিটি গবেষক তাসনিম শাহিন তাঁর গবেষণা উপাত্তগুলো তুলে ধরবেন।

মূল আলোচক তাসনিম শাহিন বলেন, বাংলাদেশি ফ্যাশন শিল্পে সাসটেইনেবিলিটি বা টেকসই চর্চা এখন আর ঐচ্ছিক নয় এটি সময়ের বড় দাবিতে পরিণত হয়েছে। একসময় ফ্যাশন ছিল স্টাইল, ট্রেন্ড ও নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম। ফাস্ট ফ্যাশনের কারণে ফ্যাশন শিল্প বিশ্বের অন্যতম দূষণকারী শিল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পোশাক উৎপাদনের জন্য প্রচুর পানি ও রসায়নিক ব্যবহার, টেক্সটাইল বর্জ্য ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাড়ছে।
সম্ভাব্য উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি ডেনিম জিনস তৈরি করতে প্রায় ৭,০০০–১০,০০০ লিটার পানি লাগে যা দিয়ে আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে একজন মানুষের এক দশকের পানীয় পানি মিলতে পারে। ফাস্ট ফ্যাশনের ব্যবসায়িক মডেল দ্রুত ট্রেন্ড, কম দাম ও অত্যাধিক উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। এটি শুধুমাত্র বাজারে পোশাকের আমদানি আর ব্যয় কমানো নয়, এটি একটি নীতিগত পরিবর্তন, যা বাজারের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। তিনি এইচ এন্ড এম, জারা, ফর এভার টুয়েন্টি ব্র্যান্ডের কথা উল্লেখ্য করেন। পরিবেশগত ক্ষতির পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকও। দেশের লোকাল ফ্যাশন, কারুশিল্প ও নিজস্ব ডিজাইনের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে, কেনাকাটার অভ্যাস পরিবর্তিত হচ্ছে এবং দ্রুত তৈরি পোশাকগুলো থেকে লোকাল সৃজনশীলতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ।

উপাত্তটি বিশ্লেষণে বলা হয়, সাসটেইনেবিলিটি শুধু রিসাইক্লিং বা ইকো-ফ্রেন্ডলি ট্যাগ নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সিস্টেম যেখানে পরিবেশগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব দিককে বিবেচনায় নিতে হয়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র উপকরণ পরিবর্তন বা প্রযুক্তিগত সমাধান দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়; এটি শিক্ষাব্যবস্থা, নীতিনির্ধারণী স্তর এবং ভোক্তার আচরণের সুষম পরিবর্তন ছাড়া মিটবে না।
শুধু উৎপাদিত পোশাকের মান বা বিপণন নয় ভবিষ্যতের ফ্যাশন পেশাজীবীদের এনভায়রনমেন্টাল, লেবার ও এথিক্স, অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বোঝার মতো দক্ষতা সৃষ্টি করতেই সাসটেইনেবিলিটির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, আলোচনায় বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক উৎপাদক দেশ হওয়ায় এখানকার সিদ্ধান্ত ও চর্চা বৈশ্বিক পর্যায়েও প্রভাব ফেলতে পারে। সঠিক নীতিমালা, শিক্ষা ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারলে বাংলাদেশ টেকসই ফ্যাশনের একটি আন্তর্জাতিক উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন, ফ্যাশনে সাসটেইনেবিলিটি বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত গবেষণা, ধারাবাহিক আলোচনা এবং উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ ও মানবিক শিল্পব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ব্যক্তি ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বক্তারা ফ্যাশন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের পাশাপাশি দেশীয় তাঁত ও হস্তশিল্পভিত্তিক ব্যবহারিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।

উপাত্ত উপস্থাপনার পর অনুষ্ঠিত মতবিনিময় পর্বে অংশ নেন রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ, সাদাকালোর স্বত্বাধিকারী আজহারুল হক আজাদ, সুরঞ্জনার স্বত্বাধিকারী তৃপ্তি নূর, ট্যানের তানিয়া ওয়াহাব, খুঁতের কর্ণধার ফারহানা হামিদ আত্তি, মিতার গল্পের মাসুমা মিথিলা, সিগনেট, আট কুঠরি নয় দরজার হাফসা মোসলেম, কাপড় ই বাংলার মুরসালিন আহমেদ মিথুন এবং অন্যরকমের রোকসানাসহ আরও অনেকে।
আয়োজকদের মতে, এ ধরনের আলোচনা বাংলাদেশের ফ্যাশন শিল্পে সাসটেইনেবিলিটি বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের টেকসই চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করবে।